তাইবুর ভবিষ্যদ্বাণী বনাম মাহমুদের আশা
দেশের সব ক্রিকেট পিয়াসীর মনে যে আশাটা লুকিয়ে আছে সঙ্গোপনে তা প্রকাশ্যে এনেছেন তাতেন্দা তাইবু। জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক সেদিন বলেছেন, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সামনে ভালো একটা ‘সুযোগ’ আছে। সুযোগটা শিরোপা জয়ের।
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের একসময়ের ‘বিস্ময় বালক’ এখন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) কোচ। যে দেশ তার কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে, হতেই পারে সে দেশের ক্রিকেট দলের জন্য একটু বেশি ভালো ভালো কথা বলেছেন তাইবু। বিদেশি কোচরা এ দেশে এসে যেমনটা সাধারণত বলেন আরকি!’
তাইবু না হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, খালেদ মাহমুদের তো দরকার নেই সেটি বলার। তেমন কিছু বলে বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ও ক্রিকেট বোর্ডের এই পরিচালকের কোনো ব্যক্তিগত লাভেরও সুযোগ নেই। তাইবুর মতো অতটা স্বপ্নচারী না হয়ে মাহমুদ বাংলাদেশ দলের সামনে এঁকে দিয়েছেন সেমিফাইনালের গণ্ডি।
মাহমুদের কাছে সেমিফাইনালে ওঠাটাই বাস্তবোচিত লক্ষ্য, কেননা আমিরাত ও ওমানের কন্ডিশন অনেকটাই নিজেদের ঘরের মাঠের মতো। তারওপর বাংলাদেশ দলে রয়েছেন ছয়টি টুর্নামেন্ট খেলা মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। অন্য কোনো দলেই সবগুলো বিশ্বকাপ খেলা এত বেশি খেলোয়াড় নেই।
সাকিব ও মোস্তাফিজুর রহমান একেবারে সদ্যই এই আরব আমিরাতে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলে টুর্নামেন্টে যোগ দিয়েছেন, এটাও দলের জন্য হবে প্লাস পয়েন্ট। সবচেয়ে বড় কথা, আগের টুর্নামেন্টগুলোতে করা সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দল মাঠে সঠিক প্রয়োগ ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাবে বলেই বিশ্বাস করেন মাহমুদ।
বাংলাদেশ দলের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা আছে, এমনটা কিন্তু ‘পয়েন্ট ব্লাঙ্ক’ বলেননি তাইবু। কথার নিচে যোগ করেছেন একটি পাদটিকা- মাঠে চাই পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন। প্রতিটি দলই নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। থাকে পরিকল্পনা-ক, পরিকল্পনা-খ, পরিকল্পনা-গ।
প্রথম পরিকল্পনা কাজে না লাগলে যাওয়ার কথা দ্বিতীয় পরিকল্পনায়, সেটি কাজে না লাগলে তৃতীয়টিতে। আগের ছয়টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই পরিকল্পনা-বাস্তবায়ন ঠিকঠাক করতে না পারায় শুরুতেই বিসর্জন হয়েছে বাংলাদেশের স্বপ্ন। আর ভুল? সে তো অনেকবারই কাঁটা হয়ে বিঁধেছে বুকে।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ‘সুপার টেনে’ ভারতের কাছে ১ রানে হারের সেই হৃদয়বিদারক গল্প আমাদের মনে থাকবে অনন্তকাল। শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১১ রানের প্রয়োজনীয়তা ৪ উইকেট হাতে রেখে ৩ বল থেকে ২ রানের সমীকরণে নামিয়ে এনে মুশফিকুর রহিম আগাম জয়ের উৎসব করে ফেলেছিলেন। তারপর হলো কী? বাকি তিন বলে তিন উইকেট নেই। বাংলাদেশের হার শেষ পর্যন্ত ১ রানে।
সেই ঘটনার পর প্রায় ছয় বছর হতে চলল, ক্রিকেটে এখনো যে বাংলাদেশের পরিণতিবোধের অনেক অভাব, সে কথা বোঝাতে ভারতীয়রা ব্যাঙ্গালুরুর ম্যাচটিকে টেনে আনে। আমাদের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালো লাগে ওদের।
২০০৭ প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা। ‘সুপার এইটে’র ম্যাচে জয়াসুরিয়া, জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকারা, দিলশানদের শ্রীলঙ্কাকে ১৪৭ রানে বেঁধে ফেলার পর শ্রীলঙ্কার পক্ষে বাজি ধরার মতো লোক খুবই কম ছিল। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে সেদিন ভিনদেশি কোনো সাংবাদিক খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর যিনি বাংলাদেশের নামে জয়ধ্বনি দেননি।
অথচ আশরাফুলের দল কী করল? ২৫ বল বাকি থাকতে ৮৩ রানে অলআউট, হার ৬৪ রানে। কী হতশ্রী ব্যাটিং, কী ভুলভাল শট নির্বাচন। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ঘরে ফেরার প্রচণ্ড তাড়া, যত দ্রুত সম্ভব ধরতে হবে বিমানের উড়ান।
এখানেই সত্যিটা জ্বলজ্বল করে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ‘বড়’ হয়ে উঠতে পারেনি। মানে পরিণত হয়ে উঠতে এখনো অনেক বাকি। মাহমুদের দৃষ্টিতে যেটি ভুল না করার প্রত্যয়, টাইবুর কথায় সেটিই মাঠে ঠিকঠাক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার।
আদতে দুজনের কথা গিয়ে মেলে একই বিন্দুতে, যাকে বলে দল হিসেবে পরিণতিবোধ, ম্যাচুরিটি। ভারতীয়রা এই ম্যাচুরিটির প্রসঙ্গ তুলে আমাদের একটু মানসিক কষ্ট দেয় ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা মিথ্যা নয় যে দল পরিণত না হলে বড় সাফল্যের প্রতিশ্রুতি মেলে না।
ক্রিকেট খেলাটা রহস্য করতে খুব ভালোবাসে। এটির দৈর্ঘ্য যত কমে সে তত বেশি রহস্যময়। সে জন্যই বলা হয় সংক্ষিপ্ততম সংস্করণ টি-টোয়েন্টিতে বড় দল ও ছোট দলের মধ্যে ব্যবধান তেমন থাকে না। ছোট দলের কাছে বড় দলের হার মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তারপরও দিনশেষে ক্রিকেট বড় দলের গলাতেই বিজয়মালা পরায়। পঞ্চাশ ওভারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে আজ পর্যন্ত কোনো ছোট দল বিজয়মঞ্চে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারেনি। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের যে ক’টি বিশ্বকাপ হয়েছে, তাতেও কোনো ছোট দলের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে ছয়টি শিরোপা। রহস্যময় ক্রিকেট ‘ক্রিকেটের ব্রাজিল’ অস্ট্রেলিয়াকে কোনো শিরোপা না দিয়ে একমাত্র দল হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিজয়মালা পরিয়েছে দু’বার।
একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজের গা থেকে পলেস্তারার মতো খসে পড়েছে অতীতের গৌরব। তবু তারা কীভাবে জিতে নেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দু’দুটি শিরোপা? অনেকেই হয়তো বলবেন দলটি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লেও ক্রিকেট-ঐতিহ্য হারায়নি। আর হারতে হারতে যখন মনে পড়ে যায়, আমরা একদা সম্রাট ছিলাম, তখনই তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অসাধারণ ক্রিকেটের কয়েকটি ঝলক। আর তাতেই মাথায় ওঠে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
সংক্ষিপ্ত ক্রিকেটে শিরোপা জয়ের জন্য কয়েকটি ঝলকই যথেষ্ট। আরেকটি মত হতে পারে, এখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো এত বেশি ‘বিগ হিটিং’ ব্যাটসম্যান অন্য কোনো দলে নেই। ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড, কালোর্স ব্র্যাথওয়েট, এভিন লুইস- কী সব বিগ হিটার ক্যারিবীয় দলে! ওরা ছক্কা মারেন, মনে হয় যেন টেবিলের ওপার থেকে টেবিল টেনিসের বল পেটাচ্ছেন।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে যেভাবে টানা চারটি ছক্কা মেরে ব্র্যাথওয়েট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়েছেন, সেটি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রূপকথা হয়ে গেছে। চার ছক্কার উল্টোদিকে থাকা ইংল্যান্ড পেসার বেন স্টোকস এখনো যদি ব্র্যাথওয়েটকে দু:স্বপ্নে দেখে রাতের ঘুম নষ্ট করেন বলার কিছু থাকে না।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিগ হিটিংও সাফল্যের অন্যতম উপকরণ। কেউ কেউ বলতে পারেন বাংলাদেশ দলে এমন বিগ হিটার কোথায় যিনি কব্জির অনায়াস মোচড়ে বল মাঠের বাইরে আছড়ে ফেলবেন? এ দলের বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান যে সর্বশক্তি দিয়েও সীমানার কাছে পর পর টানা দুটি বল ফেলতে পারেন না।
না, বিগ হিটিং কাজে লাগে কিন্তু ওটাই সব নয়। দরকার আসলে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিং। টি-টোয়েন্টি চার-ছক্কার ক্রিকেট ঠিক আছে, তবে এটি ব্যাটসম্যানের স্কিলেরও পরীক্ষা নেয়। সেই স্কিল মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক, সাকিবের আছে। পূর্বসূরি আশরাফুল, আফতাবদেরও ছিল।
ওটাকেই কাজে লাগিয়ে আশরাফুল-আফতাবরা এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই বধ করেছিলেন জোহানেসবার্গের মাঠে। দিনটি ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। সেই জয়ের পর অনেকদিন হয়ে গেল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা আরো ২৪টি ম্যাচ খেলেছি, বড় দলের বিপক্ষে আর জয় পাইনি।
নির্দিষ্ট করে বললে পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর ১ মাসেরও বেশি সময়। এবার কি আসবে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ জয়? তা এলে খালেদ মাহমুদের আশা বা টাটেন্ডা টাইবুর ভবিষদ্বাণী সত্যি হতেও পারে।
আইএইচএস/