একটি নয়, সচল হওয়া চাই সব চাকাই
এক চাকার গাড়ির খুব মানানসই এক উদাহরণ ক্রিকেটেই আছে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের সবশেষ বিশ্ব আসরে দলীয় পারফরম্যান্সের নিক্তিতে মাপলে সেটি বাংলাদেশ দলই। এর বাকি সব চাকা অচল না হলেও খুব সচলও ছিল না। একটি চাকা আবার এমন গতিশীল ছিল যে পারলে একাই দূরন্ত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যায় দলকে! সেই এক চাকার নাম সাকিব আল হাসান।
কিন্তু সব চাকা সচল না হলে সেটি শেষপর্যন্ত লক্কড়ঝক্কড় এক গাড়িই। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাংলাদেশও এর কাছাকাছিই। ব্যক্তিগত ঝলকের গুণপূজারী ক্রিকেটে দিনের শেষে যেখানে দলীয় সাফল্যেই খোঁজা হয় স্বার্থকতা, সেখানে দুই বছর আগে লেখা হয়েছিল ব্যর্থতার করুণ এক উপাখ্যানই।
এমন নয় যে অন্যদের ব্যাটে-বলেও বিক্ষিপ্ত আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায়নি। তবে সে আলোর তীব্রতায় ক্রিকেট বিশ্বের চোখ অতটা ধাঁধিয়ে যায়নি, যতটা গিয়েছিল সাকিব আল হাসানের পারফরম্যান্সে। তার মতো অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা ছিল না আর কারো ব্যাটেই। এর সঙ্গে দারুণ কার্যকরী বোলিং যোগ হয়ে এই অলরাউন্ডারের কীর্তি মানবীয় সামর্থ্যের সীমাও প্রায় ছাড়িয়ে যাচ্ছিল।
৬০৬ রান ও ১১ উইকেটের যুগলবন্দীতে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারের অন্যতম দাবিদারও হয়ে উঠেছিলেন সাকিব। অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পরও তার অনন্য সে স্বীকৃতির আনন্দে ভাসতে না পারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরকালীন আফসোসের প্রতিশব্দই হয়ে উঠেছে একরকম।
তা নিয়ে ভক্তকূলে প্রতিবাদের ঝড়ও বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটিও তো সত্যি যে সাকিবের মতো ঝড় বইয়ে দেওয়া পারফরম্যান্স আর কারো ছিল না বলে দলীয় সাফল্যের ফুলও সেভাবে ফোটেনি। চারজন ছাত্রের মধ্যে তৃতীয় হওয়াতে যেমন কৃতিত্ব নেই, দশ দলের মধ্যে অষ্টম হওয়াটাও তেমনই। দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট প্রশাসন অবশ্য এটিকে প্রকাশ্যে ব্যর্থতা বলে আখ্যা দেয়নি।
আবার সেই বিশ্বকাপের পরপরই ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসকে চাকরিচ্যূত করতেও বিলম্ব করেনি। যা ছিল একরকম ব্যর্থতা মেনে নেওয়াই। ওই ব্যর্থতায় একাই আলোর মশাল জ্বেলেছেন সাকিব। নিজের আলোয় আলোকিত হয়েছেন কিন্তু সে আলো দলকে সেভাবে রাঙাতে পারেনি। পারলে ২০১৫-র ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা দলকে ‘ব্যাক বেঞ্চার’ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরতে হয় না।
আরেকটি বিশ্বকাপ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন ২০১৯ থেকে এই শিক্ষা নেওয়ার দাবিও থাকছে যে গাড়ি পুরোদমে ছোটাতে সব চাকারই সমান সচল হওয়া চাই। সাকিবের মতো এক চাকার ওপর নির্ভরশীলতায় কোনো ভরসা নেই।
ভরসা থাকলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এতদিন ধরে ব্যর্থতার পাকচক্রে পড়ে থাকতে হয় না বাংলাদেশকে। সেই ২০০৭ সালের প্রথম আসরে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে শুরু করেছিল বাংলাদেশ, পরের পাঁচ আসরে মূল পর্বে জয় নেই আর একটিও।
অথচ এই সংস্করণের বিশ্বকাপেও ঠিকই পারফরম্যান্সের দ্যূতি ছড়িয়ে গেছেন সাকিব। কুড়ি-বিশের বিশ্ব আসরে পারফরম্যান্সের দিক থেকে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলছেন শুধু তিনিই। সম্প্রতি আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা দশ পারফরমারের একটি তালিকা করেছে। তাতে অবলীলায় ঠাঁই করে নেওয়া বাংলাদেশের অলরাউন্ডারের দুর্ভাগ্যের কথাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি তারা।
দশজনের মধ্যে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যাঁর দল কখনো সেমিফাইনাল খেলেনি। অথচ আগের ৬ আসর মিলিয়ে পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদি ছাড়া ৫০০ রান ও ৩০ উইকেটের ‘ডাবল’ আছে শুধু সাকিবেরই। ৫৪৬ রান ও ৩৯ উইকেট নিতে আফ্রিদি যেখানে খেলেছেন ৩৪ ম্যাচ, সেখানে মাত্র ২৫ ম্যাচেই সাকিবের রান ৫৬৭ এবং উইকেট ৩০টি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সব কয়টি আসরেই অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা আটজনের একজন এই অলরাউন্ডার নিশ্চিতভাবেই পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা রাখতে মুখিয়ে থাকবেন। চাইবেন ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি করতেও।
তার কাছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহর আশা অবশ্য আরো বেশি। এক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন যে, ‘২০১৯ বিশ্বকাপের চেয়েও ভালো করবে সাকিব।’
কিন্তু সাকিবের একা ভালো করাই যে দলীয় সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়, সবশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দলের অংশ হিসেবে মাহমুদউল্লাহ নিজেই এর সাক্ষী। সে ভাবনা থেকেই সম্ভবত বলে রেখেছেন, ‘আমি সবার অবদান চাই।’
মানে সাকিবের মতো সচল চাকা হয়ে ওঠার দাবি এবার তার সবার কাছেই!
আইএইচএস/