তলানিতে পাঠিয়ে আবার আশরাফুলই টেনে তুলেছিল : আফতাব
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে জয় বলে কথা। তাও প্রথম জয়। যা আজ পর্যন্ত মূল পর্বে একমাত্র জয় হয়েও আছে বাংলাদেশের জন্য।
সেই জয় নিয়ে কথা উঠলেই সবাই আশরাফুলের কথা বলেন। আশরাফুলের ২০ বলে ৫০ হাঁকানো, যা তখনকার সময়ের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সবচেয়ে দ্রততম ফিফটি।
আশরাফুলের ২৭ বলে করা ৬২ রানের ইনিংসটিকে নিয়ে যত হইচই, তার ছিটেফোঁটাও হয় না অন্যদের পারফরমেন্স নিয়ে; কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো- সে জয়টি আসলে ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। সে ম্যাচে প্রথম বল হাতে সৈয়দ রাসেল অনেক মাপা ও নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে শুরু থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের হাত খুলে খেলা থেকে বিরত রাখেন। এরপর দুই স্পিনার সাকিব (৪/৩৪) ও আব্দুর রাজ্জাক (২/২৫) একের পর এক উইকেটের পতন ঘটালে ক্যারিবীয়রা ১৬৪’তে গিয়ে থামে।
কিন্তু ১৬৫ রানের জয়ের টার্গেট তো আর আশরাফুলের একার ৬২ রানের হ্যারিক্যান ইনিংসে ছোঁয়া সম্ভব হয়নি। আরও অবদান ছিল। সেই অবদানটি রাখেন আফাতাব আহমেদ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যার সাহসী, তেজোদ্দীপ্ত, সাবলীল ও চোখ জুড়ানো ফ্রি-স্ট্রোক প্লে’র ভক্ত অনেকেই।
সেদিন আফতাব নিয়েছিলেন সহায়ক ভূমিকা। আশরাফুলের সাথে তৃতীয় উইকেটে ১০৯ রানের পার্টনারশিপ গড়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। জাগো নিউজের সাথে আলাপে সে ম্যাচ নিয়ে কথা বলেছেন আফতাব। জানিয়েছেন ম্যাচ পরিস্থিতি কী ছিল? তারা কিভাবে ক্যারিবীয়দের বধ করেছিলেন? সেখানে কার ভূমিকা কী ছিল? সবই তুলে ধরেছেন আফতাব।
সে ম্যাচের স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে গিয়ে আফাতাব প্রথমেই বলেন, আমরা প্রথমে ফিল্ডিং করছিলাম। বোলাররা সবাই- বিশেষ করে সৈয়দ রাসেল, রাজ্জাক ভাই আর সাকিব খুব ভাল বোলিং করছিল। ১৫-১৬ ওভার যেতেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রন প্রায় আমাদের হাতের মুঠোয়। ওই সময় মনে হচ্ছিল যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৩০-এর ঘরে আটকে রাখবো। তখন আসলে খেলার অবস্থাও ছিল তেমন। আমাদের বোলিং ছিল টাইট। ফিল্ডিংও হচ্ছিল শার্প।
ওই অবস্থা থেকে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের পক্ষে ১৩০-১৪০ রানের বেশি করা ছিল খুবই কষ্টের; কিন্তু সেখান থেকে শেষ ৩ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনেক রান করে ফেললো। সেটা কিভাবে? ক্যারিবীয়রা আশরাফুলের শেষ দুই ওভারে হাত খুলে খেলে রানের গতি অনেক বাড়িয়ে দিল। যে ম্যাচে ১৩০-১৪০ এর বেশি হবার কথা না। সে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর দাঁড়লো ১৬৪। আশরাফুলের ওপর দিয়েই গেল যত ঝড়-ঝাপটা।
আমরাও মনের দিক থেকে অনেক দুর্বল হয়ে পড়লাম এবং বলতে পারেন আশা ছেড়েই দিলাম। ভেবে রেখেছিলাম ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ রান তাড়া করতে হবে। যা হয়ত করা সম্ভব; কিন্তু সেখানে টার্গেট দাড়ালো ১৬৫। অনেক বড় স্কোর। অনেক টাফ।
আসলে তখন ১৬০ প্লাস মোটামুটি উইনিং স্কোর। ওই ১৬০ প্লাস রান দেখে আমরা বলাবলি করলাম, ‘এটা অনেক রান। ভাবটা এমন হয়ত পারবো না।’
এরপর আমরা ব্যাটিংয়ে নামলাম। দুই ওপেনার তামিম আর নাজিম (নাজিমউদ্দীন) শুরুতে আউট হয়ে গেল। তখন আমরা আরও আশাহীন হয়ে গেলাম। মনে হলো আর বুঝি হলো না।
তারপর কি হলো? কিন্তু অসাধারন এক ইনিংস খেললো আশরাফুল। আমি আর আশরাফুল জুটি গড়লাম। আশরাফুল আমাকে বললো ধরে ধরে খেল। আমিও দলের প্রয়োজনে শটস খেলার লোভ সামলে বাহারি ও চটকদার মার ছেড়ে একদিক আগলে রাখার কাজে মনোযোগী হলাম। অপর দিকে আশরাফুল খেললো তার মতো। একদম ঝড়ো ইনিংস যাকে বলে। যা যা মারলো সব পারফেক্ট হলো। কী যে সব অসাধারণ শটস খেললো, চোখ চেয়ে দেখার মত।
একদম ম্যাচ জেতানো ইনিংস। ও ইচ্ছেমত শটস খেলতে থাকলো। আমি ক্যারি করার চেষ্টায় মন দিলাম। আর শেষ পর্যন্ত আমি ফিফটি (৪৯ বলে ৬২ নট আউট) পার করে একদিক ধরে রেখেই এভাবে এক সময় পৌঁছে গেলাম জয়ের বন্দরে। ধরা দিল এক অবিস্মরণীয় জয়।’
আফতাব জানালেন শেষ পর্যন্ত জয়ের আনন্দে ভাসলেও ওই ম্যাচের আগে তাদের যত চিন্তা ছিল ক্রিস গেইলকে নিয়ে। কারণ বাংলাদেশের সাথে ম্যাচের আগে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক বিধ্বংসী শতক উপহার দিয়েছিলেন গেইল; তাই চিন্তা ছিল গেইল না আবার সেঞ্চুরি করে বসেন, গেইলের সেঞ্চুরি মানেই চার ও ছক্কার ফুলঝুড়ি। আর বোলিং-ফিল্ডিংয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া। যতি তাই হয় তাহলে তো আর জয়ের কোন সম্ভাবনাই থাকবে না, তখন কী হবে?
বারবার মনে হচ্ছিল গেইল না আবার আমাদের সাথে সেঞ্চুরি করে ফেলেন। তাহলে তো রান পাহাড় টপকাতে হবে। তখন যদি আমরা রান পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ি; কিন্তু সৈয়দ রাসেল ওই বিপজ্জনক উইলোবাজকে একদম শুরুতে সম্ভবত শূন্য রানে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের স্বস্তি ফিরিয়ে আনলো। আমরা চড়াও হলাম ক্যারিবীয় উইলোবাজদের ওপর।
১৬ ওভার পর্যন্ত প্রায় পুরো ইনিংসেই আমাদের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখে কোনঠাসা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু আশরাফুলের শেষ দুই ওভারে ইচ্ছে মত মেরে সেই ম্যাচেই স্কোর ১৬০-এর ঘরে নিয়ে গেল ক্যারিবীয়রা। তখন ওই স্কোরকে মোটামুটি ধরা হতো উইনিং স্কোর। আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম পারবো না। কিন্তু বাস্তবে পেরেছি। সে অসামান্য জয়টি আসলে সম্ভব হয়েছিল আশরাফুলের দুর্দান্ত আর ঝড়ো উইলোবাজিতে।’
এআরবি/আইএইচএস