কত দূর যেতে পারবে বাংলাদেশ?
দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের 'গলার কাঁটা' হয়ে বিঁধে ছিল আইসিসি ট্রফি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। না পারছিল ফেলতে, না পারছিল গিলতে। এক রকম অস্বস্তি হয়ে তা বিরাজ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সেই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
কিন্তু আবারও যে দুঃসহ সেই স্মৃতি ফিরে আসবে, এমনটা ভাবতে পারা যায়নি। আসলে ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না-ও থাকতে পারে। পারে না বলেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট বাংলাদেশকে তেমন পরীক্ষার মুখোমুখি ফেলে দেয়। যা রীতিমতো বিব্রতকর। এবারও বাংলাদেশকে আইসিসি ট্রফির সময়কার 'দোস্ত'দের সঙ্গে গ্রুপ পর্বে খেলতে হবে। এই পর্ব উতরাতে পারলে 'সুপার টুয়েলভ' খেলার যোগ্যতা অর্জন করা যাবে।
অবশ্য বাংলাদেশ দুই যুগ আগের কঠিন সেই দিনগুলো পিছনে ফেলে এসেছে। ওমান, পাপুয়া নিউগিনি, স্কটল্যান্ডের মতো চুনোপুঁটি দলগুলোকে পাত্তা দেওয়ার মতো অবস্থায় এখন নেই। তারপরও বাংলাদেশকে যে গ্রুপ পর্বে এই দলগুলোর সঙ্গে খেলতে হয়, তা নিশ্চয়ই সম্মানজনক নয়।
এতদিনে সরাসরি খেলার হিম্মত অর্জন করতে পারলে এমন অসম্মানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নবীন দেশ আফগানিস্তান যদি নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও সরাসরি খেলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া ক্রিকেট এমন এক অনিশ্চয়তার খেলা, অনেক সময় পচা শামুকে পা কেটে যায়। তেমনটা হলে সেই লজ্জা কখনও মুছে ফেলা যায় না। যে কারণে কোনো প্রতিপক্ষকেই দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই।
তবে এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে খেলাটাকে বাংলাদেশ মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। অর্থাৎ এ নিয়ে তেমন একটা টেনশন নেই বললেই চলে৷ প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দলগুলোর সঙ্গে খেলবে, শক্তি ও সামর্থ্যের দিক দিয়ে তারা ঢের ঢের দুর্বল। অবশ্য সব কিছুরই তো একটা ইতিবাচক দিক থাকে৷ এই দলগুলোর সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের এক ধরনের ওয়ার্মআপ হয়ে যাবে। ওয়ার্মআপ ম্যাচের চেয়েও প্রতিযোগিতামূলক এই ম্যাচগুলো বাংলাদেশকে অতিরিক্ত সক্ষমতা এনে দিতে পারে৷
মরুর দেশ ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যে পিচে খেলা হবে, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খেলতে অভ্যস্ত নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম পর্বে খেলাটা বাংলাদেশের জন্য পয়মন্ত হয়ে উঠতে পারে। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশাটা বেশ বড়। স্বপ্ন অনেক দূর যাওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম পর্বে খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স সঞ্চার করেছে নতুন আশাবাদের। জিম্বাবুয়ে সফর দিয়ে সাফল্যের যে ধারার সূত্রপাত ঘটে, তা অব্যাহত থাকে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও। জিম্বাবুয়েকে ২-১ ম্যাচে হারানোর পর সফরকারী অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ এবং নিউজিল্যান্ডকে ৩-২ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। ১৩ ম্যাচের মধ্যে জয়ী হয় ৯টিতে৷ যদিও জয়ের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারতো, তারপরও এক বছরে এতগুলো ম্যাচ জয়ের কৃতিত্ব এবারই প্রথম। টানা তিনটি সিরিজ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
যদিও অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড পূর্ণাঙ্গ শক্তির দল ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশ খেলেছে নিজেদের সুবিধাজনক পিচে। তাতে হয়তো বিজয়ের পরিপূর্ণতা পাওয়া যায় নি। তবে যে কোনো জয় বা সাফল্যই হয়ে উঠে উজ্জীবনের জীয়নকাঠি। তা বাড়তি শক্তি যোগানোর উৎস হয়ে ওঠে। দলকে করে তোলে আত্মবিশ্বাসী। সর্বোপরি তিনটি সিরিজে শক্তি ও দুর্বলতা পরিমাপ করে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার সুযোগ পেয়েছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখার কারণ একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে তরুণ দলও বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে নাসুম আহমেদ, মোহাম্মদ নাইম, আফিফ হোসেন, মেহেদী হাসান, শরিফুল ইসলাম, নুরুল হাসান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, শামীম হোসেনরা আলোচনায় উঠে আসেন, তাদের মাঝে নতুন এক বাংলাদেশকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
কখনো ব্যাট হাতে, কখনও বল হাতে তারা যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েন, তাতে দৃশ্যমান হয় সাহসী, প্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা ক্রিকেটারদের প্রতিচ্ছবি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে যারা অবিচলিত ও নিরাসক্তভাবে লড়াই করতে পারেন, দলকে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারেন, তাদের প্রতি আস্থা তো রাখাই যায়। সঙ্গত কারণেই জ্বলে উঠেছে আশার প্রদীপ। লড়াকু, বেপরোয়া ও ইতিবাচক মানসিকতার এই ক্রিকেটারদের নিয়ে স্বপ্ন দেখাই যেতে পারে।
প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারদের পাশাপাশি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমানরা যথারীতি দেখিয়েছেন চমৎকার নৈপুণ্য। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স বিশ্বকাপে বড় সাফল্য পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে।
এই দলে আরো আছেন পরীক্ষিত ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, লিটন দাশ, তাসকিন আহমেদ। যদিও তামিম ইকবালের না থাকায় ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের দুর্বলতা কতটা কাটিয়ে উঠা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। তাছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটে কোনো সংস্করণে এই প্রথম দলভুক্ত হয়েছেন সাতজন নবীন ক্রিকেটার। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো বড় মঞ্চ যে কোনো ক্রিকেটারের জন্য কঠিন এক ঠাঁই। আর নবীনদের জন্য তো নিজেকে মেলে ধরা মস্ত এক চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাসী এক বাংলাদেশকে দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেটানুরাগীরা। কোনো অঘটন না ঘটলে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ সেরা হয়েই 'সুপার টুয়েলভ'-এ খেলবে, এমনটা আশা করা যেতেই পারে। সেক্ষেত্রে গ্রুপ টুতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হবে ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান এবং সম্ভবত নেদারল্যান্ডস।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেমিফাইনালে খেলতে হলে বাংলাদেশ এই গ্রুপে সেরা দুই দলের মধ্যে থাকতে পারবে কি না? উত্তর হতে পারে, থাকতে পারে কিংবা না-ও পারে। ক্রিকেট তো আর সরল অঙ্ক নয় যে সহজেই হিসাব মিলানো যাবে৷ খেলতে হবে মাঠে। প্রতিদিনই নতুন সমীকরণের মুখোমুখি হতে হবে। একটুখানি বেহিসেবি হলেই অঙ্ক মিলানো যায় না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আশানুরূপ কিছু করতে পারেনি। তাহলে বাংলাদেশকে নিয়ে কেন বড় স্বপ্ন দেখা?
'সুপার টুয়েলভ'-এর গ্রুপ টুর সবার সঙ্গে বাংলাদেশের জয়ের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু সেটা তো ধারাবাহিক নয়। হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে ওঠা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু সর্বশেষ তিনটি সিরিজে বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে, তাতেই বিস্তৃত হয়েছে স্বপ্নের পরিধি।
ছোট সংস্করণের এই ক্রিকেটে সাফল্য পেতে হলে বুকের পাটা অনেক বড় হতে হয়। খেলতে হয় বেপরোয়াভাবে৷ ব্যাটসম্যান হলে কোনো বোলারকে আর বোলার হলে কোনো ব্যাটসম্যানকে তোয়াক্কা করা যাবে না। এক/দুই ওভারেই পাল্টে দেওয়া যায় খেলার ধারা। এই সামর্থ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দেখাতে পেরেছেন।
তাছাড়া দলে আছেন অ্যাগ্রেসিভ, ডিপেন্ডবল, কনসিসটেন্ট ক্রিকেটাররা। আছেন ঠাণ্ডা মাথার দক্ষ ফিনিশারও। স্পিন ও পেসের সমন্বয়ে বোলিংয়ে আছে যথেষ্ট ভেরিয়েশন। পাওয়ার ক্রিকেট খেলার জন্য একটা দলে যে ধরনের বৈচিত্র্য থাকা প্রয়োজন, বাংলাদেশের এবারের দলটি তার চমৎকার দৃষ্টান্ত।
সেই আলোকেই এই দলটি নিয়ে বড় ধরনের সাফল্য পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যদিও প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতা কখনো মেলে, কখনো মেলে না, তারপরও সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে যে উপলব্ধি করে নেওয়া যায়, তাতে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এক রকম উচ্চাশা। এখন দেখা যাক, সেই উচ্চাশা নিয়ে কত দূর যেতে পারে বাংলাদেশ?
আএইচএস/