টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, এই শব্দগুলোর ব্যাপক ব্যবহার রাজনীতিতে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবী প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসে এই তিনটি শব্দ। সমান সুযোগের এই যে দাবী, এটা নিয়ে বিতর্ক ওঠে প্রায়শই। অনেক ক্ষেত্রেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আবেদনও হারায়। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সগৌরবে টিকে আছে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’।
এই আসরে কেউই ফেবারিট নয়, বিপরীতক্রমে সবাই ফেভারিট। উদাহরণ হিসাবে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা ধরা যাক। ওয়ানডে বিশ্বকাপে গত ছয় আসরের মধ্যে চারবারই শিরোপাধারী অস্ট্রেলিয়া। যদিও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখনো শিরোপা জিততে পারেনি প্রবল পরাক্রম অজিরা। আবার গত ছয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে একবারও সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে পারেনি ক্যারিবীয়রা। অথচ এই ওয়েস্ট ইন্ডিজই কিনা, একমাত্র দল হিসাবে দু’ দুবার জিতেছে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
এবার বিশ্বকাপ মূলপর্বে আয়োজক দেশ নাই। আর এতে করে, শিরোপা রেসে বেড়ে গেল আরো একটা প্রতিদ্বন্দী দেশের সংখ্যা! এটা কোন হেঁয়ালি নয়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এটাই চরম বাস্তবতা। আজ অবধি এই আসরে শিরোপা জয়ের স্বাদ পায়নি কোন আয়োজক দেশ। ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ত ভার্সনের ছয় বিশ্বকাপে পাঁচবারই ফাইনালে উঠতে পারেনি কোন আয়োজক দেশ।
আয়োজকদের দুর্দশা অনুধাবন করার জন্য খুব বেশিদুর যাওয়ার দরকার নাই। একমাত্র দল হিসাবে দু’বার ট্রফি জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১২ ও ২০১৬)। বলা বাহুল্য দুবারই ক্যারিবীয়রা শিরোপা উৎসব করেছে ঘরের বাইরে। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় আর ২০১৬ সালে ভারতে।
মজাটা হচ্ছে, ঘরের আয়োজনে সেমিফাইনালেও জায়গা করে নিতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্য চ্যাম্পিয়নদের বেলায়ও একই ব্যাপার। ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা আসরে (২০০৭)। আবার নিজের উঠোনে ২০১৬ সালের আসরে ফাইনালের নাগাল পায়নি ভারত।
২০১০ সালে, ইংল্যান্ড শিরোপা উৎসব করেছে আটলান্টিকের পারে ক্যারিবীয় মুল্লুকে। অথচ তার আগের বছর নিজের ঘরে সেমিফাইনালেও পৌঁছাতে পারেনি ইংলিশরা। আয়োজকরা ফাইনালে উঠতে পারে না এই অপবাদ কেবল ঘুচিয়েছে শ্রীলঙ্কা। ২০১২ সালের নিজের উঠোনে ফাইনালে উঠেও রানার্সআপ ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লংকানদের। তারা শিরোপা জিতেছে ঢাকায় ( ২০১৪ সালে)।
সব খেলাধুলায়ই বিশেষ করে ক্রিকেটে একটা দেশের কিংবা একটা দলের সেরা সময় থাকে। আর ওই সেরা সময় কাজে লাগানোর মধ্য দিয়েই আসে বড় বড় অর্জন। এক্ষেত্রে সাক্ষাত ব্যাতিক্রম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। যেমন বলা যায় ক্রিকেটে ১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকে তিন তিনবার ওয়েস্টইন্ডিজ কিংবা গত দু’দশকের অস্ট্রেলিয়া।
সত্তর ও আশির দশকে ক্যারিবীয়রা ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে তিনবার। এরমধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুবার। টেস্ট ক্রিকেটেও তারাই ছিল নাম্বার ওয়ান। গত দু’দশকে একই কথা খাটে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও। বেশিরভাগ সময়ই এক নম্বর অজিরা। দলটি ওয়ানডে বিশ্বকাপও জিতেছে সর্বাধিকবার। আর এই দু’দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের পতন হার মানিয়েছে কালজয়ী বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র পড়ন্ত বস্তুর সুত্রকেও। অথচ সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে সর্বাধিকবার। আর এই সংস্করণে অস্ট্রেলিয়া এখনো ট্রফিশূন্য।
টি- টোয়েন্টি ক্রিকেটে র্যাংকিং শুধুই যে একটা সংখ্যা, এটা বুঝতে প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। যেমন হালের র্যাংকিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয় নম্বরে। ক্যারিবীয়দের উপরে আছে আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা। এই র্যাংকিংয়ের আদৌ কী কোন মূল্য আছে? র্যাংকিংয়ের হিসাব ধরে ক্যারিবীয়দের খরচের খাতায় রাখার দুঃসাহস দেখানোর মত একজনকেও কী পাওয়া যাবে?
এই নতুন সংস্করনে ক্রিকেটের ছোট ছোট অনুষঙ্গের মধ্যেও আছে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’র জোরাল উপস্থিতি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে মনে করা হয় ব্যাটারদের খেলা। উইলোবাজরা চার-ছক্কার বৃষ্টি ঝরাবেন আর বোলাররা সংখ্যাপূরণ করবেন ওভারের।
অথচ বাস্তবে দেখা গেল, ব্যাটারদের সঙ্গে সমানতালেই পাল্লা দিচ্ছেন বোলাররা। ২০০৭ সালের প্রথম আসরের কথাই ধরা যাক। কোন বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথমবারের মত মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। ৪ ওভারে মাত্র ২০ রান খরচায় ৩ উইকেট শিকার করে ফাইনাল সেরা হলেন ইরফান পাঠান। ওই ফাইনালে সবচেয়ে বড় বিস্ময় হয়ে ওঠেন অখ্যাত পেসার যোগিন্দর শর্মা।
চ্যাম্পিয়ন হতে শেষ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ১৩ রান। স্ট্রাইকে সেট ব্যাটসম্যান মিসবাহ-উল হক। ভারত অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনি বল তুলে দিলেন যোগিন্দর শর্মার হাতে। বাকিটা ইতিহাস। শর্মা প্রথম বলটি করলেন ওয়াইড। পরের বল ডট। পরের ডেলিভারিতে ছক্কা মারলেন মিসবাহ। শিরোপা থেকে পাকিস্তান এক ছক্কা দুরে। হাতে চার চারটি বল।
কিন্তু পরের বলেই ফাইন লেগে ধরা পড়লেন ৩৮ বলে ৪৩ রান করা মিসবাহ। রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল ৫ রানে জিতে শিরোপা উৎসব করল ভারত। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক যোগিন্দর শর্মার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে মাত্র ৪ ওয়ানডে আর ৩ টি-টোয়েন্টি খেলার মধ্য দিয়েই।
এই মারাকাাটারি ক্রিকেটেও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে বোলাররা ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিচ্ছেন নিয়মিতই। ২০১২ সালের টুর্নামেন্টের ফাইনালে ফেরা যাক। মাত্র ১৩৭ রানের পুঁজি নিয়ে স্বাগতিক লংকানদের ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলাররা। ৩.৪ ওভার বোলিং করে মাত্র ৯ রান খরচায় ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন সুনীল নারিন। এই ফরম্যাটেও বোলাররা ম্যাচের নিয়ন্ত্রক , এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যায়।
আর এই ব্যাটে-বলের ঝাঁঝই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আবেদনকে করেছে সার্বজনীন। সাধারণভাবে মনে করা হয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে লেগ স্পিনাররা অচল আনি। শেন ওয়ার্ন পরবর্তী ক্রিকেটে লেগ স্পিনাররা হয়ে উঠলেন অনাদরের সন্তান। কিন্ত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দিনকে দিনই বাড়ছে লেগ স্পিনারদের গুরুত্ব। হাল আমলের রশিদ খানরা বিবেচিত হচ্ছেন তুরুপের তাস হিসাবে।
ক্রিকেট বিনোদনে বয়সীদের ঠাঁই হবে কিনা শঙ্কা ছিল এনিয়েও। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কঠিন পরিস্থিতিতে কার্যকর ভুমিকা রাখছেন বয়সীরাই। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়ে মাঠ ছাড়ছেন বিজয়ীর বেশে। ২০১৬ সালে সর্বশেষ আসরে ৩৫ বছর বয়সী মারলন স্যামুয়েলসের ঝলকানী এখনো অনেকের স্মৃতিতেই টাটকা। খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে ম্যাচ শেষ ওভারে নিয়ে যান স্যামুয়েলস। ৬৬ বলের ইনিংসে অপরাজিত থাকেন ৮৫ রানে। টানা চার ছক্কা মেরে শেষ ওভারের নায়ক অবশ্য কার্লোস ব্র্যাথওয়েট।
তবে ম্যাচের নায়ক স্যামুয়েলস। পান ম্যাচ সেরার পুরস্কার। মিরপুরে ২০১৪ সালের ফাইনালে ৩৭ বছর বয়সী কুমারা সাঙ্গাকারার শেষ তুলির আঁচড়, দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যুগযুগ ধরে। কঠিন উইকেটে ঠান্ডা মাথায় ৩৫ বলে ৫২ রানে অপরাজিত থেকে বিরাট কোহলিদের স্বপ্ন কেড়ে নেন সাঙ্গাকারা।
পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সর্বোপরি ছোট পরিসরের এই ক্রিকেট একটা নির্দিষ্ট ছকে আটকে থাকেনি। সর্বক্ষেত্রেই সমান সুযোগের যে দাবি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে তা মানবকুল কতদিনে পৌঁছাতে পারবে, সেটা অন্যপ্রসঙ্গ। তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’র ধারণাটি ছোট পরিসরের ক্রিকেটে বেশ বড় আকারেই প্রতিভাত।
আইএইচএস/