‘আকরামের ব্যাটিং শ্রমিকের মত, নান্নু ভাইয়েরটা যেন শিল্পীর আঁচড়’
ফারুক আহমেদ, আতহার আলী, এনামুল হক মনি, জাহিদ রাজ্জাক মাসুম, নুরুল আবেদিন নোবেল, গোলাম নওশের প্রিন্স আর জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দুলু প্রমুখ ক্রিকেটারকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ৯০ দশকের পুরো সময় তারা ছিলেন দেশের ক্রিকেটের বড় তারকা। ব্যাট ও বল হাতে নৈপুণ্যের দ্যুতিতে তারাও আলো ছড়িয়েছেন প্রচুর।
কিন্তু কৃতিত্ব, অর্জন আর সাফল্যে তাদের ছাপিয়ে সবার ওপরে ছিলেন তিনজন ক্রিকেটার; মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আকরাম খান আর আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ধরা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র এই তিনজন।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে সন্দেহাতীতভাবেই দেশের ক্রিকেটের তিন শীর্ষ তারকা তারা। তিন সুপার স্টার। হোক তা ঢাকার প্রিমিয়ার ক্রিকেট, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, জাতীয় লিগ, দামাল স্মৃতি, শহীদ দিবস কিংবা বিজয় দিবস ট্রফি- ঘরোয়া ক্রিকেট মানেই নান্নু, আকরাম আর বুলবুলের জয়গান।
ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং করতে প্রায় সমান দক্ষতা ছিল তিনজনেরই। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতাও ছিল বেশ। পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছিলেন সমসাময়িকদের মধ্যে সেরা। প্রতিকুল অবস্থায় চাপের মুখেও ম্যাচ বের করে আনার সামর্থ্য এবং বিগ ম্যাচ টেম্পারামেন্ট ছিল যথেষ্ঠ।
তাই সেই ৮০’র দশকের শেষ ভাগ থেকে একটানা প্রায় এক যুগ ঢাকা লিগে নান্নু, আকরাম ও বুলবুলের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। জাতীয় দলের অগ্রযাত্রায়ও এ তিনজনই যথেষ্ঠ কার্যকর অবদান রেখেছেন।
নান্নু অবশ্য ১৯৮৬ সালের আইসিসি ট্রফি থেকে ৯৭’র ট্রফি বিজয়ী দলের অপরিহার্য্য সদস্য হিসেবে খেলেছেন। আর বুলবুল-আকরাম দেশের হয়ে প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলেন ১৯৯০ সালে হল্যান্ডে।
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি বিজয়েও বুলবুল, আকরাম ও নান্নুর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের সাথে চরম সংকটে শক্ত হাতে হাল ধরে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে দরকারি আর গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন আকরাম খান।
তবে মজার বিষয় হলো, ঢাকা লিগে এই তিনজন কখনো এক দলের হয়ে খেলেননি। আকরাম রেলওয়ে থেকে সেই যে আবাহনীতে নাম লিখিয়েছেন, সেখান থেকেই অবসরে। আর বুলবুলের আজাদ বয়েজ দিয়ে শুরু, এরপর ১০ বছরের বেশি সময় মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন। মাঝে এক দুই মৌসুম বিমানে খেললেও আবাহনীতে যোগ দেননি কখনো।
আর লালমাটিয়া থেকে আবাহনীর জার্সি গায়ে প্রথম বড় দলে নাম লেখানো নান্নু আবাহনী-মোহামেডান দুই বড় দলেই খেলেছেন। তবে বছরের হিসেব কষলে মোহামেডানে খেলেছেন অনেক বেশি।
কাজেই এ তিনজনের একটা অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল। ফ্যান-ফলোয়ার্সও ছিল প্রচুর। তখন তো ঘরোয়া ক্রিকেট মানে ঢাকা লিগই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কে বড়? নান্নু, আকরাম নাকি বুলবুল? কার ব্যাটিং সামর্থ্য বেশি? কে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা বেশি রাখেন? সংকটে দলের প্রয়োজনে কার ব্যাট বেীশ কার্যকর?
তা নিয়ে ভক্ত ও সমর্থকরাও প্রায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ক্রীড়া সাংবাদিক নোমান মোহাম্মদের সাথে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক নামী ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ফেসবুক ও ইউটিউব লাইভেও সেই কৌতুহলি প্রশ্ন উঠেছিল।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু দুজনকেই বড় ব্যাটসম্যান আখ্যা দিয়েছেন। সমসাময়িকদের মধ্যে ওই দু’জন যে ভালা তাও বলেছেন অবলীলায়।
কার ব্যাটিং কেমন ছিল? আপনি কাকে কোথায় কিভাবে রাখবেন? দর্শক, ভক্ত ও সঞ্চালকের কাছ থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে নান্নুকেই এগিয়ে রেখেছেন বুলবুল। সবার দেখা ও জানা, নান্নুর চেয়ে আকরাম একটু বেশি ডাকাবুকো। কোন কোন ক্ষেত্রে সাহসী। আক্রমণাত্মক। তবে বুলবুল তাদের দুজনের মধ্যে নান্নুর ব্যাটিং শৈলির ভক্ত। তার ধারনা নান্নুর ব্যাটিং ছিল বেশি শৈল্পিক। সৃজনশীল ও নান্দনিক।
বুলবুলে চোখে আকরাম নিজের সামর্থ্যকে উজাড় করে দিয়ে খেলতো। তবে তার সেই ব্যাটিংটা ছিল শ্রমিকের মত। ‘আকরাম ব্যাটিং করতো শ্রমিকের মত। আর নান্নু ভাই যখন ব্যাটিং করতেন, তখন মনে হতো যেন কোনো শিল্পী ছবি আঁকছে। নান্নু ভাইর ব্যাটিং শৈলি অনেক বেশি সাজানো-গোছানো। আমি তার কাছ থেকে ব্যাটিংয়ের বেশ কিছু সুক্ষ্ম বিষয় শিখেছি। নান্নু ভাই থেকে শিখেছি অফস্পিনে কিভাবে অফ সাইডে কভারের আশপাশ দিয়ে খেলে প্যাক্ড অনসাইড ফিল্ডিংয়ের ভিতরেও অফসাইডে খেলে রান করা যায়।’
এআরবি/আইএইচএস/