কাপালির দুই দশক আগেই বাংলাদেশের হয়ে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি
আচ্ছা বলুন তো, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিকটি কার? বোদ্ধা কিংবা বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকের যে কেউ বলে চট করে বলে দেবেন, কে আবার ‘অলক কাপালি!’ এই ব্যাটিং অলরাউন্ডারই তো বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক করেছেন। আর সেটাও তো আজকের কথা নয়। প্রায় দেড় যুগ আগে ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে করা।
এছাড়া বাংলাদেশের অফস্পিনার সোহাগ গাজীরও আছে টেস্ট হ্যাটট্রিক। এই অফস্পিনার ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একই ম্যাচে শতরানের পাশাপাশি হ্যাটট্রিকের কৃতিত্ব দেখান। পাশাপাশি ওয়ানডেতেও এক গন্ডা হ্যাটট্রিক আছে বাংলাদেশের বোলারদের।
সেই তালিকায় আছেন শাহাদাত হোসেন রাজিব, আব্দুর রাজ্জাক, রুবেল হোসেন, তাইজুল ইসলাম আর তাসকিন আহমেদের নাম। এই পাঁচ বাংলাদেশি বোলার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাটট্রিকম্যান।
কিন্তু জানেন কি, ওপরে যাদের নাম বলা হলো তার বাইরে আরও একজন বাংলাদেশি বোলারের হ্যাটট্রিক আছে। ভাবছেন, বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা বোঝানো হয়েছে বুঝি। নাহ! মোটেও তা নয়। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনিও একজন সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার এবং তিনিও বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়েই হ্যাটট্রিক করেছেন। সেটাও আজ থেকে অনেক অনেক আগে; অলক কাপালির প্রথম হ্যাটট্রিকের প্রায় দুই দশক (১৯ বছর) আগে, ১৯৮৪ সালে।
তিনি কে? কোন বাংলাদেশি বোলার কোথায়, কার বিপক্ষে তিন যুগ আগে হ্যাটট্রিক করেছিলেন? তা কি জানা আছে? নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তিনিও বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার এক বীরসেনানী। জাতীয় দলের হয়ে দুটি আইসিসি ট্রফি খেলেছেন। জাতীয় দলের পক্ষে ৫টি ওয়ানডে ম্যাচেও অংশ নিয়েছেন।
নাম তার গোলাম ফারুক চৌধুরী। তবে ক্রিকেট পাড়ায় তিনি সুরু নামেই অধিক পরিচিত। পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার এই গোলাম ফারুক সুরুই বাংলাদেশ জাতীয় দলের পক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিকটি করেছেন এবং সেটা ১৯৮৪ সালে।
এটুকু শুনে নিশ্চয়ই মনে খটকা লেগেছে। ১৯৮৪ সালে তো বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়নি। কাজেই ওয়ানডে ম্যাচে হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আবার ১৯৮৪ সালে তো আইসিসি ট্রফির আসরও বসেনি। ভীষণ গোলমেলে ঠেকছে, তাই না? তাহলে গোলাম ফারুক সুরু জাতীয় দলে হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন কোথায়, কোন আসরে, কার বিরুদ্ধে?- এমন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে নিশ্চয়ই।
তাহলে শুনুন, গোলাম ফারুক সুরু ১৯৮৪ সালে যে টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের পোশাকে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছেন সে আসরটির নাম ছিল দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেট। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এ আসরের নাম শুনে ও জেনে থাকবেন। এটি আসলে ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর অংশগ্রহণে এক ক্রিকেট আসর।
১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ার মাটিতে এসিসি ট্রফি (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ভুক্ত আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে) বিজয়ের আগে, এই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ান ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জিতেই নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথমে এসিসি পরে ৯৭’তে আইসিসি ট্রফি বিজয়ের মধ্য দিয়ে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিয়েছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশে হওয়া ১৯৮৪ সালের প্রথম দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ান ক্রিকেটে সব ম্যাচ জিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন রকিবুল, ইউসুফ বাবু, নেহাল, লিপু, বাদশাহ, দিপু চৌধুরী, সামি, ওয়াহিদ, আজহার আর সুরুরা।
তখন ভারত-পাকিস্তানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কাও টেস্ট খেলত নিয়মিত। এ অঞ্চলে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করতে এবং প্রচার-প্রসার বাড়াতে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, যার নাম ছিল দক্ষিণ এশিয়া ক্রিকেট। ঐ টুর্নামেন্টের রবিন লিগে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে অনবদ্য হ্যাটট্রিক করেছিলেন মিডিয়াম পেসার গোলাম ফারুক সুরু।
দিনটি ছিল ১৯৮৪ সালের ১৩ জুন। খেলা হয়েছিল দেশের ক্রীড়াকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ম্যাচে ১০ রানে ৬ উইকেট শিকারের পথে একপর্যায়ে পরপর তিন বলে তিন উইকেটের পতন ঘটিয়েছিলেন সুরু। তিনি হ্যাটট্রিক পূরণ করেছিলেন এক নিখুঁত আউটসুইংয়ে। মিডল স্ট্যাম্পে পিচ পড়া ডেলিভারি সুইং করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সিঙ্গাাপুর ব্যাটসম্যান তাতে ব্যাট এগিয়ে দেন। বল ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে চলে যায় দ্বিতীয় স্লিপ আর গালির মাঝামাঝিতে। তখনকার চৌকশ ক্রিকেটার ইউসুফ রহমান বাবু অসামান্য ক্ষিপ্রতায় ডান দিকে শরীর মাটিতে ফেলে সে ক্যাচ ধরলেই হ্যাটট্রিক পূর্ণ হয় সুরুর।
সেদিনের সে উচ্ছল সুঠামদেহী তরুণ গোলাম ফারুক সুরু, এরপর জাতীয় দলের হয়ে তিনটি আইসিসি ট্রফি (১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০) খেলেছেন। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ৫টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডেও খেলেছেন। খেলা ছেড়ে সেই এডি বার্লোর হাত ধরে ঢুকেছেন কোচিংয়ে। এখন বিসিবির তালিকাভুক্ত কোচদের অন্যতম গোলাম ফারুক সুরু। বর্তমানে কাজ করছেন এইচপির ফাস্ট বোলিং কোচ হিসেবে।
জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে নিজের ক্যারিয়ার আর বাংলাদেশের উত্তরণ নিয়ে কথা বলার সময় সেই হ্যাটট্রিকসহ ১০ রানে সিঙ্গাপুরের ৬ ব্যাটসম্যানকে আউট করার স্মৃতিচারণ করেছেন সুরু।
তার কথা, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে ঐ দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেট আসরকে ঠুনকো, অতি নগন্ন মনে হতেই পারে। এখন আমরা ওয়ানডেতে প্রতিষ্ঠিত দল। বিশ্ব ক্রিকেটের বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করি। বিশ্বকাপে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলকে হারাই। কাজেই তিন যুগ আগে সিঙ্গাপুরের মত দলের বিপক্ষে আমাদের অতি সহজ জয় আর আমার হ্যাটট্রিক হয়তো এখন নেহায়েত সামান্য অর্জন বলেই মনে হতে পারে।’
‘তবে ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের ক্রিকেট আজকের জায়গায় রাতারাতি আসেনি। অনেকটা পথ লড়াই-সংগ্রাম করেই ধীরে ধীরে আজকের বাংলাদেশ। তখনকার প্রেক্ষাপটে ঐ সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হেসে খেলে জেতা, হ্যাটট্রিক, লাঞ্চের আগে খেলা শেষ করে দেয়ার সাফল্যগুলোই কিন্তু আমাদের সামনে হাঁটতে শিখিয়েছে। আমাদের ভাল খেলতে অনুপ্রাণিত করেছে। কাজেই আমার কাছে ঐ হ্যাটট্রিক ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার রসদ।’
তিন যুগ আগের কথা। সিঙ্গাপুরের সাথে হ্যাটট্রিকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ব্যাটসম্যানের নাম বলতে পারেননি সুরু, ‘যতদুর মনে পড়ে প্রথম ও শেষ শিকারটি ছিল কট বিহাইন্ড। আমি ম্যাচসেরা হয়েছিলাম। বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক শামিম কবির ভাই খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন। আমার হাতে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরস্কার তুলে দিতে দিতে ইংরেজীতে বলেছিলেন, মনে রেখ, এটাই শুরু। যেতে হবে অনেকদূর। সামনে বন্ধুর পথ। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আরও ভাল করতে হবে। আর বড়বড় বাধা অতিক্রম করতে হবে।’
সে ম্যাচের আরও দুটি স্মৃতি এখনও মনে দাগ কেটে আছে গোলাম ফারুক সুরুর, ‘এখনকার মত মোবাইল ছিল না তখন। হ্যাটট্রিকের পর আব্বার কথা খুব মনে পড়ছিল। টিম হোটেলে (হোটেল পূর্বানী) ফিরে রুম থেকে বাসায় ল্যান্ডফোনে কথা বলেছিলাম আব্বার সঙ্গে। আমার হ্যাটট্রিকের কথা শুনে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলেন আব্বা। বলেছিলেন, দারুণ পারফরমেন্স করেছ। আমরা খুব খুশি। আমাকে দেখতে চাইছিলেন। আমি বলেছিলাম আপনি দোয়া করেন। আমি টুর্নামেন্ট শেষ করে তবেই বাসায় ফিরব।’
‘এরপর সন্ধ্যায় হোটেলে দেখা করতে এসেছিল আমারই দুই প্রিয় বন্ধু প্রিন্স আর রঞ্জন (দুজনই সাবেক ক্রিকেটার)। ওদের সঙ্গে পূর্বানীর পেস্ট্রি শপে বসে ক্রিম রোল, পেস্ট্রি আর কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছিলাম। সেটাও ছিল তথনকার অল্প বয়সে এক অন্যরকম ভাললাগা।’
এআরবি/এসএএস/এমএস