ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে, স্পিন ছেড়ে পেসার, অতঃপর ৮ উইকেট শিকারি ইমরান
‘টেস্টের কথা বাদ। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই ৮ উইকেট শিকারের ঘটনা আছে মাত্র একটি। সে দুর্লভ কৃতিত্বটি লঙ্কান ফাস্ট বোলার চামিন্দা ভাসের। ২০০১ সালে (৮ ডিসেম্বর) কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮ ওভার বল করে ৩ মেডেনসহ মাত্র ১৯ রান দিয়ে ৮ উইকেট দখল করে রেকর্ডের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন এই বাঁ-হাতি পেসার।
এরপর আরও ১১জন একবার করে ৭ উইকেট দখল করলেও ভাসের মত ৮ উইকেট ঝুলিতে পুরতে পারেননি আর কেউ। একবার ভাবুন! ৫০ ওভারের ক্রিকেটে হাজারো ম্যাচে যে দুর্লভ কৃতিত্বটি ঘটেছে মাত্র একবার, সেই একদিনের ক্রিকেটে ঢাকা লিগে এক ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার তাহলে কতটা কঠিন হতে পারে?
অথচ, জেনে অবাক হবেন বাংলাদেশের এক বোলারের ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের একটি-দুটি নয়, তিন তিনটি আসরে ৮ উইকেট শিকারের অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে।
তিনি কে হে? তিনি কি ধরনের বোলার, পেসার নাকি স্পিনার? তবে, তিনি একা নন, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে দু’জন মাত্র বোলার আছেন, যাদের এক ম্যাচে ৮ উইকেট শিকারের অসামান্য কৃতিত্ব আছে। সেই দু’জনের একজন হলেন ‘সারোয়ার ইমরান।’ বর্তমান প্রজন্ম তাকে চেনে শুধুই একজন কোচ হিসেবে। তিনবার ৮ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনিই।
অন্যজন তরুণ ডানহাতি পেসার, ইয়াসিন আরাফাত মিশু। ২০১৮ ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেটে ১৪ মার্চ ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলি স্টেডিয়ামে আবাহনীর বিপক্ষে গাজী গ্রুপের হয়ে ৪০ রানে ৮ উইকেট দখল করেন ইয়াসিন আরাফাত মিশু।
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে নিয়মিত প্রতিষ্ঠিত ও বড় দলকে কোচিং করান সারোয়ার ইমরান। বিপিএলেও স্থানীয় যে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র কোচ বেশিরভাগ কোচিং করানোর সুযোগ পেয়েছেন, তারও অন্যতম এই সারোয়ার ইমরান।
তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খুঁটিনাটি যাদের নখদর্পনে তাদের কাছে অবশ্য সারোয়ার ইমরানের এক অন্য ছবি আঁকা আছে। তাদের কাছে কোচ সারোয়ার ইমরান মানেই বিকেএপির সাবেক কোচ, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, আল শাহরিয়ার রোকন, নিয়ামুর রশিদ রাহুলের মত একঝাঁক মেধাবি ক্রিকেটারের গুরু ও মেন্টর।
সে সাথে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের সত্যিকার অবকাঠামোবিহীন, অপ্রস্তুত অবস্থায় অগোছালো বাংলাদেশ টেস্ট দলের প্রথম কোচ হিসেবেও সারোয়ার ইমরানের আছে এক অন্যরকম পরিচিতি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে সেটাই শেষ নয়। এরপরও একাধিকবার জাতীয় দলের নেপথ্য কারিগর হওয়ার রেকর্ড আছে সারোয়ার ইমরানের। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে চরম ভরাডুবির পর টিম বাংলাদেশের বেসামাল অবস্থা, ঠিক তখন কোচ ইমরানের ওপরই অল্প সময়ের জন্য দল পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব বর্তেছিল। দেশের মাটিতে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টিভিএস কাপ এবং ভারতের সাথে সিরিজে ইমরানই ছিলেন দলের প্রধান কোচ।
দুই পাকিস্তানি কোচ মহসিন কামাল আর আলি জিয়ার কোচিং এবং খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে আইসিসির দুই সহযোগি সদস্য কানাডা এবং কেনিয়াসহ সব ম্যাচ হেরে (বৃষ্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়েছিল) দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ।
সেই ভাঙ্গাচোরা ও চরম অগোছালো এবং শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলা দলের প্রশিক্ষকের কঠিন দায়িত্ব বর্তায় সারোয়ার ইমরানের কাঁধে। খালেদ মাহমুদ সুজন হন নতুন অধিনায়ক। ইমরান-সুজনের হত ধরে খাদের কিনারা থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ আবার হাঁটতে শেখে ডেভ হোয়াটমোরের কোচিংয়ে। ইমরানের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে যুক্ত হন হোয়াটমোর।
এছাড়া বাংলাদেশ যে এসএ গেমস এবং এশিয়ান গেমস ক্রিকেটে (দুটোই ২০১০ সালে) দু’বার স্বর্ণপদক বিজয়ী হয়, কাকতালীয়ভাবে সেই দু’বারই বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন ইমরান। কিন্তু বড় অংশ যাকে একজন সফল কোচের প্রতিমূর্তি হিসেবে চেনে ও জানে, সেই মানুষটিরও যে ক্রিকেটার হিসেবে অনেক বড় সাফল্য আছে, তা জানেন ক’জন?
সারোয়ার ইমরান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র বোলার যিনি প্রথম বিভাগে খেলার আগে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ, এরপর ঢাকার মূল ক্রিকেট লিগ তথা সিনিয়র ডিভিশন লিগ (এখন যেটা প্রিমিয়ার লিগ, তখন সেটা হতো ২০ দল নিয়ে) এবং প্রথম বিভাগ লিগ- এই তিন পৃথক লিগেই একবার করে এক ম্যাচে ৮ উইকেট দখলের অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
২০-২২ বছরের যুবা ইমরান প্রথম ৮ উইকেট দখল করে হইচই ফেলে দেন ঢাকার দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে। সময়কাল ১৯৯৮৪-৮৫। এখন যেটা শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ, তখন সেটা ছিল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ। তখন জুনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট লিগ হতো ওই মাঠে। সেখানে পুরনো ঢাকার ইস্ট এন্ড ক্লাবের বিপক্ষে ৫.২ ওভার বোলিং করে ৮ রানে হ্যাটট্রিকসহ ৮ উইকেটের পতন ঘটান গুলশান ইয়্যুথের হয়ে খেলা ইমরান। তার বিধ্বংসী বোলিংয়ে ইস্ট এন্ড ক্লাব অলআউট হয়ে যায় মাত্র ২০ রানে।
যারা ভাবছেন দ্বিতীয় বিভাগ লিগে ৮ উইকেট শিকার আর এমন কি? তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরেক বড় বিস্ময়! তখনকার প্রধান ক্রিকেট লিগ, যেটাত মোহামেডান, আবাহনীসহ ঢাকার প্রধান ২০টি ক্লাব অংশ নিত, সেই ঢাকা সিনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পূর্ব মাঠে শান্তিনগরের বিপক্ষে ৮ উইকেট দখল করে ইমরান।
ওই ম্যাচেও ৮ ওভারের স্পেলে হ্যাটট্রিকসহ ১০ রানে ৮ উইকেট ঝুলিতে পুরে সবাইকে অবাক করে দেন গুলশান ইয়্যুথের মিডিয়াম পেসার ইমরান। শান্তিনগর তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি। সেই দলের বিপক্ষে ইমরানের এক ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার ছিল অনেক বড় ঘটনা। এরপর ১৯৯০-১৯৯১ সালে প্রথম বিভাগে উদিতির হয়ে সাধারণ বীমার বিপক্ষে আবারও ৮ উইকেট দখল করেন ইমরান। সেটাও গুলশান ইয়ুথের হয়ে মিরপুর সিটি ক্লাব মাঠে।
যিনি দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগের পাশাপাশি ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের শীর্ষ লিগে এক ম্যাচেও ৮ উইকেট শিকারের অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারি- সেই সারোয়ার ইমরানে সাফল্যের গল্পের কিন্তু একটি বড় অংশ এখনো বাকি রয়ে গেছে। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ঢাকার ক্রিকেটে যার দখলে তিনবার ৮ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব আছে, সেই সারোয়ার ইমরান কিন্তু হঠাৎ করেই ক্রিকেটার বনে গেছেন।
সারোয়ার ইমরানের প্রথম জীবনে শখ ছিল ফুটবলার হবেন। পুরনো ঢাকার লালবাগ এলাকার নামী ফুটবলার ও পরে কোচ মোহাম্মদ মালার মুসলিম ইনস্টিটিউটের হয়ে খেলার স্বপ্ন ছিল তার। দুই মৌসুম প্র্যাকটিসও করেছেন। ফুটবলই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। ক্রিকেটার হবেন, এমন কোন ইচ্ছেই ছিল না।
এরপর এক বন্ধুর হাত ধরে হঠাৎ জাতীয় কোচ আলতাফ হোসেন (প্রয়াত সাবেক জাতীয় কোচ)- এর অনূর্ধ্ব-১৯ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন এবং কোচ আলতাফ হোসেনের হাত ধরেই ক্রিকেটে চলে আসেন তিনি।
এর আগে ফুটবল, ভলিবল আর হ্যান্ডবল খেলেছেন ইমরান। হ্যান্ডবলে ঢাকার প্রথম বিভাগ লিগেও খেলেছিলেন। এছাড়া ছিলেন অ্যাথলেটও। জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যাল) হয়ে আন্তঃকলেজ স্পোর্টসে সারা বাংলাদেশে শর্টপুটে প্রথম হয়েছিলেন। সেই ইমরান হঠাৎ ১৯৭৮ সালে ফুটবল ছেড়ে চলে আসলেন ক্রিকেটে।
সেখানেও আছে আরেক গল্প। ছেলে বেলায় পাড়ার ক্রিকেটে তিনি ছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আর অফ স্পিনার। কোচ আলতাফ হোসেনই তাকে অফ স্পিনার থেকে পেস বোলারে রুপান্তরিত করেন। তাকে বলেন, ‘তোমার হাইট ভাল, ফিটনেস আছে, দম আছে প্রচুর। তুমি পেস বোলিং করো।’ এরপর পেস বোলার হিসেবেই ঢাকা লিগে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান আজকের সফল কোচ সারোয়ার ইমরান।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ভারতের যে সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার সবচেয়ে বেশি দিন খেলে মাথায় বল লেগে মৃত্যুবরণ করেন, সেই রমন লাম্বা আবাহনীর হয়ে প্রথম বছর খেলতে এসে ইমরানকেই তখনকার ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের বোলিং ‘ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ছেলেটির পেস আছে। আউট সুইংটাও করাতে পারে বেশ।’
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এমন অসাধারণ বোলিং নৈপূণ্য যার, পরিসংখ্যানের খাতায় এক ম্যাচে সর্বাধিক ৮ উইকেট শিকারের দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারি ইমরান কখনো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি। অথচ ইমরানের পাড়া আজিমপুর কলোনীর সমসাময়িক ও বন্ধুপ্রতিম গোলাম নওশের প্রিন্স এবং গোলার ফারুক সুরু ঠিকই জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে আইসিসি ট্রফি এবং ওয়ানডে খেলে ফেলেছেন; কিন্তু ইমরান তা পারেননি।
কেন পারেননি? সারোয়ার ইমরানের নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক সে না পারার গল্প, ‘আসলে ক্রিকেটার হবার ইচ্ছেই ছিল না। প্রথম জীবনে ফুটবল ছিল ফাস্ট চয়েজ। মালা ভাইয়ের কোচিংয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউটের হয়ে নিয়মিত অনুশীলন করেছি। ভলিবল খেলতাম। হ্যান্ডবলেও ফার্স্ট ডিভিশনে খেলেছি। অ্যাথলেটিকসও করেছি। শর্টপুটে আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। তারপর প্রয়াত ও শ্রদ্ধেয় আলতাফ ভাইয়ের হাত ধরে ক্রিকেটার হয়েছি। তিনিই আমাকে অফ স্পিন বোলিং ছেড়ে পেস বোলিং করার পরামর্শ দেন। এছাড়া ঢাকা লিগে ভাল বোলিং করলেও জাতীয় দলে খেলার সেই ইচ্ছাই ছিল না আমার।’
এরপর ইমরান বলেন, ‘নিজের প্রশংসা নয় বিশ্বাস করুন, সত্যি বলতে কি এখন মনে হয় আমারও সামর্থ্য ছিল জাতীয় দলে খেলার। আমার যে বোলিং মেধা ছিল, তাতে বিশ্বাস করি আমিও খেলতে পারতাম জাতীয় দলে। আর একজন আদর্শ পেসারের যে দুটি বড় অপরিহার্য্য উপাদান দরকার, সেই উচ্চতা আর ফিজিক্যাল এ্যাবিলিটি দুটিই ছিল আমার। তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে এবং সিরিয়াস থাকলে হয়তো আমিও জাতীয় দলের পেসার হিসেবে খেলতে পারতাম। কিন্তু আসলে সে ইচ্ছে, দৃঢ় সংকল্পই ছিল না। ভীষণ ফাঁকিবাজ ছিলাম। প্র্যাকটিসেও ফাঁকি দিতাম। কষ্ট করতাম না। নেটেও খুব বেশি সিরিয়াস ছিলাম না। ঠিকমত প্র্যাকটিস না করেও ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে গেছি আমি।’
এআরবি/আইএইচএস