‘রানা, এটা কি করলি!’
সাল ২০০৭, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তখন সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজে। মাঠে নামবে ভারতের বিপক্ষে, ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সব মনোযোগ তখন থাকার কথা ছিলো হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ রফিকদের ওপর। কিন্তু না।
ঠিক আগেরদিন দেশে ঘটে গিয়েছিল মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনা। যা কেড়ে নেয় জাতীয় দলের ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার প্রাণ। যার বয়স তখন মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন! সঙ্গে প্রাণ হারান সতীর্থ ক্রিকেটার সাজ্জাদুল হাসান সেতুও।
ক্রিকেটজাতি হিসেবে যখন বিশ্বকাপের উল্লাসে মেতে ওঠার কথা সকলের, তখন ১৭ মার্চের সকালে দেশবাসী দেখল শীর্ষস্থানীয় এক দৈনিকের চার শব্দের শিরোনাম, ‘রানা, এটা কি করলি!’
অনুজ মানজারুল রানার মৃত্যুতে হতবাক সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল লিখেছিলেন সেই কলাম। যা আক্ষরিক অর্থেই ছিলো পুরো জাতির প্রশ্ন। মাত্র ২২ বছর বয়সে এটা কী করলেন, রানা?
দিনটি ছিলো ১৬ই মার্চ, শুক্রবার। আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। পরদিন নিজেদের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের মুখোমুখি হবে হাবিবুল বাশারের দল। সে ম্যাচের জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছে পুরো দল।
হঠাৎই দেশ থেকে একটি ফোন কল পেলো দল। সেই ফোন কলে পাওয়া খবরে মুষড়ে পড়ল পুরো দল। ড্রেসিংরুমে জড়ো হওয়া সকল খেলোয়াড়দের মধ্যে তখন নিশ্চুপ নীরবতা।
২০০৭ বিশ্বকাপের ঘোষিত স্কোয়াডে জায়গা হয়নি বাঁহাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার মানজারুল ইসলাম রানার। তাই দেশে বসেই নিজ শহর খুলনাতেই নিজের নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। বাইকপ্রিয় রানা নিজের প্রিয় মোটরবাইকে করেই অনুশীলনে যাওয়া আসা করতেন।
১৬ই মার্চের দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অনুশীলন শেষে বাইকে চেপে বসেন মানজারুল ইসলাম রানা। পেছনে চাপিয়ে নিলেন জাতীয় লিগে তার সতীর্থ খেলোয়াড় সাজ্জাদুল হাসান সেতুকে। যাচ্ছিলেন দুজন শহরের অদূরে প্রিয় এক হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে।
কিন্তু তাঁদের বাইকটি খুলনার বালিয়াখালি ব্রিজের কাছে আসতেই বিপরীত দিক থেকে আসা এক অ্যাম্বুলেন্সের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলে ইন্তেকাল করেন জাতীয় দলের অন্যতম নিয়মিত সদস্য মানজারুল ইসলাম রানা। গুরুতর আহত সেতুকে হাসপাতালে নেয়ার পর তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালীন সময়ে রানার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন। যার ফলে সর্বকণিষ্ঠ প্রয়াত টেস্ট ক্রিকেটারের জায়গায় বসে যায় মানজারুল ইসলাম রানার নাম।
দুর্ঘটনার খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই খবর পেতে দেরি হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় দলের। দলের অন্যতম নিয়মিত একজন সদস্যের এই আকস্মিক মৃত্যুর খবরে পুরো দলে তখন শোকের ছায়া। কেউ কথা বলার পর্যন্ত সাহস পাচ্ছিলেন না।
ঠিক পরদিনই আবার নামতে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে। রানার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, নিজের ভাইসম মাশরাফি বিন মর্তুজা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী হলো আসলে। ঘটনার আকস্মিকতায় শোকবিহ্বল হয়ে গেলেন তিনি। গায়ে তখন প্রচণ্ড জ্বর।
অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাশরাফি, খেলতি পারবি?’ এমন প্রশ্ন শুনে যেনো ক্ষেপে গেলেন মাশরাফি, তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘কী কলেন সুমন ভাই? খেলতি পারবো না কেন? রানার জন্যি খেলতি হবে।’
পরদিন রানার শোককে শক্তিতে পরিণত করে শক্তিশালী ভারতকে ঠিকই হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ দল, করেছিল বিশ্বকাপের শুভসূচনা। সে ম্যাচে বল হাতে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন রানার জন্য খেলতে নামা মাশরাফি বিন মর্তুজাই।
সদা হাস্যোজ্জ্বল রানা ছোটো-ছোটো দুষ্টামিতে মাতিয়ে রাখতেন পুরো ড্রেসিংরুম। ২০০৩ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া মানজারুল ইসলাম রানা চার বছরে খেলেছিলেন ৬টি টেস্ট এবং ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ।
এর মধ্যে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ০-২’এ পিছিয়ে থাকা সিরিজে তার অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের কল্যাণেই ৩-২ ব্যবধানে জিতে যায় বাংলাদেশ দল। সিরিজটিতে খাঁদের কিনারায় থাকা বাংলাদেশ দলকে একা হাতে জিতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
একই দিনে মৃত্যুবরণ করা অন্য ক্রিকেটার সাজ্জাদুল হাসান সেতু কখনও জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ না পেলেও, নিয়মিতই খেলতেন জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট।
মানজারুল ইসলাম রানার স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার শহর খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের একটি স্ট্যান্ডের নাম বদল করে রাখা হয়েছে ‘মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড’। বেঁচে থাকলে যে স্টেডিয়ামে আজো খেলে বেড়াতেন রানা, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ স্বর্গলোকে বসে সেই স্টেডিয়ামে নিজের নাম খোদাই করা স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তাঁকে।
এসএএস/এমএস