ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

মাশরাফিকে ছাড়াই ঘটে গেল এত ঘটনা, ফল কি ভাল হবে?

আরিফুর রহমান বাবু | প্রকাশিত: ০২:৪২ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

‘মাশরাফি বিন মর্তুজা’- বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম, বিরাট নক্ষত্র। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অপরিহার্য চরিত্র। দেশের ক্রিকেটের একটা বড় অংশ জুড়ে যার অবস্থান। এ মুহূর্তে যাকে ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট কল্পনা করাও কঠিন।

কারণ এখনো তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশ যে একটি মাত্র শাখায় ভাল খেলে, বড় দলকে হারায় এবং বিশ্ব আসরে ওপরের দিকে জায়গা করে নেয়- সেই ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি। বিশ্বকাপ আর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের মিশনগুলোর নেতাও মাশরাফি।

শুধু ক্রিকেটার, পেস বোলার, শেষ দিকের উইলোবাজ, সাহসী নেতা আর অধিনায়কই নন- সব কিছু ছাপিয়ে ব্যক্তি মাশরাফি, মানুষ মাশরাফি, সহযোগী ক্রিকেটারদের ভাই মাশরাফি, প্র্যাকটিস, ড্রেসিং রুম, টিম বাস-টিম হোটেল আর মাঠের মাশরাফি যে সতীর্থদের সবচেয়ে কাছের আপনজন। কখনও বড় ভাই, কোন সময় অভিভাবক। কখনও বা পরম নির্ভরতা।

কাউকে এতটুকু খাট না করে বলা, সবার অবদান, ভূমিকা ও আত্মনিবেদনকে মানদণ্ড ধরলে মাশরাফি বিন মর্তুজাই হচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক নম্বর, অবিসংবাদিত নেতা। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম যোদ্ধা, সেনাপতি আর সেরা অধিনায়ক। যাকে ছাড়া টিম বাংলাদেশকে কল্পনাও করা যায় না।

শুধু জাতীয় দলের কথা বলা কেন, মাশরাফিকে ভাবা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের মাঝি। যার সুগঠিত আর শক্ত হাতে মানায় দেশের ক্রিকেটের হাল। কেউ কেউ তাকে আগামী দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাণ্ডারি বলেও ভাবেন। কিন্তু হায়! দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটে গেল সেই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মাশরাফিকে ছাড়াই।

প্রথমে ১১, পরে আরও দুটি বেড়ে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলন, সংগ্রামের ডাক দেয়া ধর্মঘট ডাকলেন তারই সহযোগী আর অনুজপ্রতিম ক্রিকেটাররা। যাদের পুরো বহরের নেতা ভাবা হত তাকে, যে দলটি তার নেতৃত্ব ছাড়া ভগ্ন-জীর্ন এক দল বলে হতো পরিগনিত- সেই দল হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, তাও তাকে ছাড়া।

সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ক্রিকেটাররা নিজেদের ন্যায্য পাওনা দাবিতে সোচ্চার কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য- এতে ছিলেন না মাশরাফি। যার সবার আগে সব কিছুৃ জানার কথা, যিনি এই সাহসী অভিযানের নেতৃত্ব দিতে পারতেন- তিনিই নেই! তাকে ছাড়াই হয়ে গেল এতবড় আন্দোলন, ধর্মঘট। কয়েক দফা বৈঠক হলো। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তাও চললো কয়েক পশলা।

কিন্তু হায় একবারও দেখা মিললো না মাশরাফির। এ যে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন।

ভাবছেন কী জানি শাসক দলের এক শক্তিশালী এমপি বিসিবির সভাপতি, আরেক সাংসদ বোর্ড পরিচালক- তাই বুঝি মাশরাফি এরকম বড়সড় মুভমেন্ট থেকে দূরে। না, না! তা ভাবার কোনো কারণ নেই। মাশরাফি সংসদ সদস্য হবার আগে যেমন ছিলেন, এখনও ঠিক তেমনি। তার আচার আচরণ, কথাবার্তা, স্বভাব এবং চলাফেরা ঠিক আগের মতই আছে।

তাই শাসক দলের এমপির তকমা গায়ে এঁটে ক্রিকেটারদের স্বার্থ সংরক্ষণ আর ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে তিনি হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলে মাশরাফিকে ক্রিকেটারদের আন্দোলন থেকে দূরে, বহুদূরে রাখা হয়েছে। তাকে জানানোই হয়নি তারই ছোট ভাইরা এতবড় আন্দোলনে যাচ্ছে, ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছে আর মাঠের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।

মাশরাফি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না ভেতরে ভেতরে এত কিছু হচ্ছে। একজন ক্রিকেটারও তাকে কিছু জানাননি। আর তাই মাশরাফির দেখা মেলেনি। তিনি যে ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনে, সংগ্রাম আর ধর্মঘটের ডাকে ছিলেন না- তার প্রমাণ তো ২১ অক্টোবর রাতে মাশরাফির ফেসবুক স্ট্যাটাস।

যেখানে জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক পরিষ্কার নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, ক্রিকেটারদের আন্দোলনের ব্যাপারে তাকে কিছুই জানানো হয়নি, তিনিও অন্য সবার মতো খবর দেখেই জানতে পেরেছেন। ফলে এ ব্যাপারে

ধরা যাক, এটি ক্রিকেটারদের রুটি-রুজির আন্দোলন নয়। জাতীয় দলের টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি দলের প্র্যাকটিস চলাকালীন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, কোন বোর্ড পরিচালক আপত্তিকর কথা বলেছেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করেছেন। তার প্রতিবাদের ক্রিকেটাররা তাৎক্ষণিকভাবে একটি অবস্থান নিয়েছেন এবং রীতিমত আন্দোলন ডেকে বসেছেন। এর প্রতিকার চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়ার সাথে কথাও বলেছেন।

তাহলে মানা যেত। কারণ মাশরাফি এখন আর টেস্ট খেলেন না, টি-টোয়েন্টি থেকে নিয়েছেন অবসর। সেই দুই ফরম্যাটের কোন ক্যাম্পে তার থাকার কথাও নয়। সেই ক্যাম্পে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ঘটার পর তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া এবং মুভমেন্টে তার থাকার কথাও না।

কিন্তু এবারের ঘটনা তো আর তা নয়। একদম সাজানো গোছানো আন্দোলন। নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠার এক আন্দোলন। যার বড় অংশই হলো নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির দাবি। সেটাকে অনৈতিক ও অন্যায্য দাবি বলার কোনো সুযোগ নেই। কেউ তা বলছেনও না। এমনকি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও বলেননি। বরং বলেছেন, ক্রিকেটাররা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি যে সব দাবি তুলেছেন, তা সমাধানযোগ্য। আমরা তা মেনে নিব। মোটামুটি মেনেও নিয়েছেন। আন্দোলনের নেতা সাকিব আল হাসানও মেনেছেন আমরা মোটামুটি খুশি।

এখন প্রশ্ন হলো, যেখানে ক্রিকেটাররা প্রিমিয়ার লিগের খোলা ও স্বাধীন দলবদলের দাবিতে সোচ্চার, বিপিএলে বিদেশিদের সঙ্গে স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের এত বিশাল ফারাক কেন? তা বন্ধ করে স্থানীয় ও ভিনদেশি ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকে একটা ভারসাম্য আনার দাবি উঠেছে, জাতীয় লিগের ম্যাচ ফি প্রায় দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর প্রসঙ্গে উঠে এসেছে- সেখানে মাশরাফি থাকবেন না, তাকে জানানোই হবে না, এটা কী হয়?

আজ যারা আন্দোলন করেছেন, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির দাবিতে সোচ্চার- মাশরাফি কি তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন কখনও? এমন কোন নজির কি আছে, যে মাশরাফি ক্রিকেটারদের আয়-উন্নতির কথা ভাবেন না। তাদের প্রতি তার মায়া, স্নেহ, ভালবাসা নেই?

কেউই বলতে পারবেন না। অতিবড় মাশরাফি বিরোধীও মানছেন মাশরাফি শুধু মাঠে সাহসী যোদ্ধা আর সফল অধিনায়ক নন। একজন আদর্শ নেতা। তার উপস্থিতি আর সম্পৃক্ততা গোটা দলের চেহারা পাল্টে দেয়। যিনি অধিনায়কের চেয়েও বড় কিছু। যার আচার আচরণ, উদার মানসিকতা এবং ভালবাসা-ভাললাগা সার্বজনীন। যিনি নিজের চেয়ে সব সময় অন্যদের কথাই ভাবেন বেশি। আর তা ভাবেন বলেই সবাই মাশরাফি ভাই বলতে অজ্ঞান ছিলেন।

তাই প্রশ্ন জাগে এবার কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, মাশরাফিকে ছাড়াই এতবড় আন্দোলনে নেমে গেলেন সাকিব, তামিম, মুশফিক-রিয়াদরা? তারা বার কয়েক নিজেদের মাঝে বৈঠক করেছেন, ৬০-৭০ জন ক্রিকেটার একসঙ্গে বসে নিজেদের কর্মসূচি ঠিক করেছেন, ‘ওয়ে অব একশন’ স্থির করেছেন। আন্দোলনের ভাষা কী হবে, কয় দফা দাবি দেয়া হবে? বোর্ডের সাথে না বসে কোন লিখিত দাবিদাওয়া পেশ না করে সরাসরি প্রেসের সাথে কথা বলে চারিদিকে একটা সাড়া ফেলার এবং বোর্ডকে নাড়া দেবার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মাশরাফির মত নেতাকে ছাড়া।

কিন্তু কেন? এ কেনোর জবাব মেলেনি। সেটা ক্রিকেটাররা দেননি, বিসিবিও না। বিসিবির দেয়াার আসলে দরকারও ছিল না। বোর্ড কর্তারা বরং মনে মনে খুশিই হয়েছেন, যাক বাবা এতবড় আন্দোলনে মাশরাফি স্ব-শরীরে নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ ভেবে চিলের পেছনে না ছোটা, একটু গভীর চিন্তার মানুষ মাশরাফির এই না থাকা এবং ক্রিকেটারদের এতকালের নেতা মাশরাফিকে ছাড়া আন্দোলন, সংগ্রাম ও ধর্মঘটের ডাক দেয়াকে ভাল চোখে দেখেননি। বরং তারা বিস্মিত হয়েছেন। বিশ্বাস করতে গিয়েও যেন বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন।

শেষ কথা হলো মাশরাফি এখনো জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক। যারা আন্দোলন করলেন তারা সবাই তার দীর্ঘদিনের সহযোগী। তার অধীনেই এক সময় তিন ফরম্যাটেই খেলেছেন। মাঠে, ড্রেসিংরুমে, প্র্যাকটিসে, টিম হোটেল আর টিম বাসে মাশরাফিই তাদের নেতা বলে গণ্য। এখন তাকে ছাড়া, তাকে কোন কিছুই না জানিয়ে বরং পাশ কাটিয়ে এতবড় আন্দোলন করলেন, তারপর সেই মাশরাফির নেতৃত্বে তারা যখন খেলতে নামবেন তখন কি একটু হলেও বিব্রতবোধ কাজ করবে না? ভেতরে একটুও কাঁটার মত বিঁধবে না?

আর যত বড় মনের উদার মানুষই হোন না কেন, মাশরাফি নিশ্চয়ই ফেরেশতা নন। রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তার কি ভিতরে এতটুকু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে না। তিনি কি একবারের জন্য ভাববেন না, আরে দল হিসেবে ভাল করতে, ওপরে উঠতে সবার আগে যাদের এক সুঁতোয় গাঁথার কাজ করলাম, যে দলটিকে নিজের পরিবারের মত ভেবে তাদের মাঠের পারফরমেন্স ভাল করতে নিজের সবকিছু ঢেলে উজার করে দিলাম, যাদের আয় উন্নতির কথা ভেবে বারবার বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে দেন দরবার করেছি, তারা অতবড় আন্দোলন-সংগ্রাম করলো আমাকে ছাড়া। তাহলে তো সবই বৃথা। আগামীতে আর কাদের কথা ভাববো? কাদের উন্নতির চিন্তা করবো?

এ ভাবনার উদ্রেক কি ঘটতে পারে না? তখন কী হবে? মাশরাফি মুখ ফুটে কিছু না বললেও ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার খুব ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানা মাশরাফি হতবিহ্বল, বিমূঢ়। তাকে ছাড়া তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী সাথী ও ছোটভাইরা এত কিছু করতে পারে- এটা কল্পনায়ও আসেনি।

তাকে যেন আন্দোলনে ডাকা না হয়, মাশরাফি ভাইকে যেকোন মূল্যে এই মুভমেন্ট থেকে দূরে রাখতে হবে- এমন কথা কি তার কানে যায়নি। তার মাঝে কি কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে না? আর সেটা কি বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে?

ভুলে গেলে চলবে না, তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভাল যে ফরম্যাটে খেলে, মাশরাফি সেই ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। সেই ফরম্যাটে যখন মাশরাফি এই সাকিব, রিয়াদ, তামিম মুশফিক, মিরাজদের নিয়ে খেলতে নামবেন- অবচেতন মনে কি একবারের জন্যও অন্য চিন্তার উদ্রেক ঘটবে না? সেটা নিশ্চয়ই ভাল কিছু বয়ে আনবে না।

এখন আগামীতে তাদের নিয়েই যখন মাঠে নামতে হবে, তখন যত শক্ত মনের আর পেশাদার মানসিকতার অধিকারিই হোন না কেন- মাশরাফির কি আর আগের সেই উদ্যম, প্রত্যয় আর সার্বজনীন মানসিকতা থাকবে? একটা দূরত্ব কি আর তৈরি হবে না? নিশ্চয়ই হবে। যে যাই বলুন না কেন, এ ঘটনার একটা সুদুরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। ক্রিকেটারদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়বে সন্দেহাতীতভাবে। সম্প্রীতি, ঐক্য আর সংহতিতেও ধরবে ফাটল।

দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সম্পদ আর চালিকাশক্তি যেমন ক্রিকেটাররা, আবার তাদের সাফল্যের মূল ও একমাত্রই ক্ষেত্রই কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেট। মাশরাফিকে ছাড়া আন্দোলন-সংগ্রাম করে আবার সেই মাশরাফির নেতৃত্বে মাঠে নেমে ৫০ ওভারের ফরম্যাটে তারাই কি নিজেদের সেরাটা দিতে পারবেন? এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়!

এআরবি/এসএএস/জেআইএম