ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

ওয়ালশ পেয়েছেন অনেক, দিয়েছেন সামান্যই

আরিফুর রহমান বাবু | প্রকাশিত: ০৬:০৬ পিএম, ২৯ জুলাই ২০১৯

বিশ্বকাপ শেষ হবার পর খুব স্বাভাবিক নিয়ম ও রীতিতেই শুরু হয় ‘পোস্টমর্টেম।’ সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব দাঁড়িপাল্লায় মেপে ওজন করা হয়। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেবটাও মেলানো হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির গড়মিল হলে আর সাফল্যর চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারি হলে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান।

টিম বাংলাদেশেও এসেছে সেই শুদ্ধি অভিযান। দলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। ক্রিকেটারদের ওপর খড়গ নেমে না আসলেও টিম ম্যানেজমেন্ট তথা কোচিং স্টাফে বড় ধরনের রদবদল ঘটেছে।

হেড কোচ স্টিভ রোডস, পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ আর স্পিন বোলিং কোচ সুনিল জোশিকে বাদ দেয়া হয়েছে। হেড কোচ নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে জোরে সোরে। আর পেস বোলিং ও স্পিন কোচ নেয়ার কাজ শেষ।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ফাস্ট বোলার চার্লস ল্যাঙ্গাভেল্টকে করা হয়েছে পেস বোলিং কোচ। আর এক সময়ের অন্যতম বিশ্বসেরা বাঁহাতি স্পিনার সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে করা হয়েছে স্পিন বোলিং কোচ।

কোর্টনি ওয়ালশের বিদায় প্রায় অনিবার্যই ছিল। কারণ প্রায় তিন বছর (৩৫ মাস) পেস বোলারদের নিয়ে কাজ করলেও সে অর্থে এ ক্যারিবীয় নামী ফাস্টবোলার তেমন কিছুই করতে পারেননি। তার কোচিংয়ে সে অর্থে পেসারদের গুণগত মানের তেমন উন্নতি ঘটেনি।

নিজে ছিলেন বিশ্বমানের ফাস্টবোলার। মাইকেল হোল্ডিং-এন্ডি রবার্টস আর ম্যালকম মার্শালের মানের না হলেও ঠিক তার পরের সারিতেই তার অবস্থান। উইকেট শিকারকে মানদন্ড ধরলে ওয়ালশ দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাট মানে টেস্টে সর্বকালের অন্যতম সফল ও সেরা ফাস্টবোলার। ১৩২ টেস্টে ৫১৯ উইকেট যার নামের পাশে।

শ্রীলঙ্কার অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরলিধরন (১৩৩ ম্যাচে ৮০০), অস্ট্রেলিয়ান লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন (১৪৫ ম্যাচে ৭০৮), ভারতীয় লেগি অনিল কুম্বলে (১৩২ ম্যাচে ৬১৯), ইংলিশ ফাস্টবোলার জেমস অ্যান্ডারসন (১৪৮ ম্যাচে ৫৭৫), অজি ফাস্টবোলার গ্লেন ম্যাকগ্রাথের (১২৪ টেস্টে ৫৬৩) পর টেস্টে উইকেট শিকারে ওয়ালশ এখনো ছয় নম্বর। উইকেট শিকারে পাঁচ জনের পিছনে থাকলেও বেশি বেশি সময় ধরে টেস্ট খেলার রেকর্ড ধরলে ওয়ালশ থাকবেন আরও ওপরে। ওয়ানডেতেও খারাপ ছিলেন না, ২০৫ ম্যাচে আছে ২২৭ উইকেট।

৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ হয়ে এসেছিলেন ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে। আর গত ৫ জুলাই ইংল্যান্ডের লন্ডনের অভিজাত ভেন্যু ক্রিকেট মক্কা লর্ডসে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বিশ্বকাপ ম্যাচ দিয়েই আসলে ইতি ঘটেছে বাংলাদেশের ফাস্টবোলিং কোচ ওয়ালশের ৩৫ মাসের ক্যারিয়ার।

তিনি কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার। সে হিসেবে বেতন ভাতা ও আনুষাঙ্গিক সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন বেশ। ঠিক কত টাকা বেতন পেতেন? তার প্রকৃত অংক জানতে গিয়ে মিলেছে দু ধরনের তথ্য। এক পক্ষ বলছে, মাসিক নয়, ওয়ালশ বেতন পেতেন কর্ম দিবস হিসেবে। অর্থাৎ যতদিন কাজ করতেন, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অর্থ বেতন বাবদ জমা হতো। আর অন্য পক্ষর দাবি, ওয়ালশ মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার ডলার করে পেয়েছেন।

অর্থের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। অনেক। ১২ হাজার ডলার মাসে বেতন হলেও ওয়ালশ এক বছরে পেতেন ১ লাখ ৪৪ হাজার ডলার। আর ১৫ হাজার ডলার মাসে হলে বছরে তার বেতন দাঁড়াতো ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

একটা বিশাল অংকর অর্থ পেতেন এ ক্যারিবীয়ান। কিন্তু যদি হিসেব করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ওয়ালশের অর্জন সামান্যই। নিয়েছেন অনেক। পেয়েছেন প্রচুর। কিন্তু দিয়েছেন অনেক কম।

কাজে যোগদানের পর গত ৩৫ মাসে একজন ফাস্টবোলারও তৈরী করতে পারেননি ওয়ালশ। এমন কোন ফাস্টবোলারের নাম কেউ বলতে পারবেন না, যাকে একবাক্যে ওয়ালশের আবিষ্কার বলা যাবে।

তার মানের একজন বিশ্ব বরেণ্য ফাস্টবোলার, যিনি পেস বোলিংয়ের সম্ভাব্য প্রায় সব কলাকৌশল খুব ভাল জানেন, বোঝেন-অথচ তার কোচিংয়ে কেউ সে অর্থে কিছুই শেখেনি।

ছন্দায়িত রান আপ। একদম প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়ে আসা। আর শেষ দিকে মৌমাছির মত হুল ফুঁটানোর কাজে ওয়ালশ ছিলেন দারুণ দক্ষ। শরীর ও চোখে মুখে এতটুকু আগ্রাসন আর আক্রমণাত্মক রূপ না এনেও কি অনায়াসে প্রচন্ড গতিতে বল করতে পারতেন! ১৩৫ থেকে ১৪০-১৪২ কিলোমিটার গতিতে বল করতেন অবিরাম। সাথে দারুণ সুইং। দুই দিকে বল ম্যুভ করানোর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।

পেস বোলিং সহায় উইকেট পেলে তো কথাই নেই। নির্জীব পিচেও দারুণ জোরে বল করার পাশাপাশি নিখুত ইয়র্কার আর বাউন্সারে ব্যাটসম্যানকে নাস্তানাবুদ করতে পারতেন। তার অফস্ট্যাম্পের আশ পাশে পড়ে কখনো ভিতরে ঢোকা আর কোন সময় বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে কত ব্যাট ব্যাটসম্যান যে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে বোল্ড, লেগ বিফোর উইকেট আর উইকেটের পিছনে কট আউট হয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।

অথচ সেই মেধাবী, দক্ষ ফাস্টবোলার কোচ হিসেবে আসলে কি শিখিয়েছেন? তার কোচিংয়ে আদৌ ফাস্টবোলাররা কিছু শিখেছেন কি? সে প্রশ্নই চারিদিকে। ওয়ালশের কোচিংয়ে বাংলাদেশ দলের একজন ফাস্টবোলারেরও বলার মতো উন্নতি ঘটেনি। কারো বলের গতি বাড়েনি। ওয়ালশ কোচ হয়ে আসার আগে ১২৫-১২৭ কিলোমিটার গতি বল করতেন, ওয়ালশের কোচিংয়ে গতি বেড়ে ১৩০-১৩৫ হয়েছে-এমন একটি নজিরও নেই।

ওয়ালশ হাতে ধরে সুইং শিখিয়েছেন। বাউন্সার ছোড়ার ক্ষমতা ছিল না একদমই, পরে তার কোচিংয়ে খাট লেন্থে ফেলে অনায়াসে বাউন্সারে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেয়া শিখেছেন কিংবা বিপজ্জনক ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানের ব্যাট ও প্যাড ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে উইকেট উপরে দেয়ার কৌশল রপ্ত করেছেন দলের কোনো বোলার-এমন একটি উদাহরণও কেউ দিতে পারবেন না।

তার কোচিংয়ে গত ৩৫ মাসে মাশরাফি বিন মর্তুজা, রুবেল হোসেন, শাহাদত হোসেন রাজিব, মোস্তাফিজুর রহমান, শফিউল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, কামরুল ইসলাম রাব্বি, আবু হায়দার রনি, মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন আর আবু জায়েদ রাহিরা জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন।

এর মধ্যে মাশরাফি, রাজিব, শফিউল-রুবেল তো অনেক আগেই জাতীয় দলে এসেছেন। বাঁহাতি মোস্তাফিজ আর ডানহাতি তাসকিনের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে ওয়ালশ আসার এক বছরের বেশি সময় আগে।

ওপরে যাদের কথা বলা হলো সেই ছয় জন যা শেখার, শিখেই জাতীয় দলে এসেছেন। নিজেদের সেরাটা উপহার দিয়েছেন ওয়ালশ দায়িত্ব নেবার আগেই। এদের প্রত্যেকের ম্যাচ ও ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার ওয়ালশ বাংলাদেশের কোচ হবার আগে।

বাকি মানে কামরুল ইসলাম রাব্বি, আবু হায়দার রনি, সাইফউদ্দীন ও আবু জায়েদ রাহির কেউ সেভাবে উন্নতি করতে পারেননি। গতি, সুইং তো নয়ই, ঘুরিয়ে বললে কোচ ওয়ালশের পরিচর্যা ও হাতের ছোঁয়ায় কারো বলের ধার বাড়েনি। বরং সবাই দিনকে দিন কেমন যেন চুপসে গেছেন।

যতই সময় গড়িয়েছে, ততই বলের ধার কমেছে সবার। মোদ্দা কথা, একজন পেসারেরও কোন চোখে পড়ার মত উন্নতি ঘটেনি। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে কি কাজ করলেন ওয়ালশ? তবে কি তিনি নিজে যা জানতেন, তার ছিঁটে ফোটাও ছাত্রদের শেখাতে পারেননি? নাকি তার শেখানো ফর্মূলা অনুসরণ করতে পারেননি বাংলাদেশের পেসাররা?

এ প্রশ্নর জবাব খুঁজতে গিয়ে মিলেছে দু ধরনের তথ্য। একটা পক্ষর দাবি, ওয়ালশ ছিলেন অলস। বেশির ভাগ সময় হাতে কলমে শেখানোর চেয়ে অবলোকন করা আর বোলারদের বোলিং পর্যবেক্ষণেই বেশি সময় ব্যয় করেছেন। হাতে কলমে শেখানোর প্রবণতাই ছিল কম। প্র্যাকটিসে ওয়ালশ হাতে ধরে রান আপ, ফলো থ্রু, সুইং, বাউন্সার আর ইয়র্কার ছোড়া দেখাচ্ছেন, শেখাচ্ছেন-এমন দৃশ্য তিন বছরে খুব কমই চোখে পড়েছে। মেধা নিয়ে কিছুই বলার নেই। নিজে ছিলেন অনেক বড় মাপের ফাস্টটবোলার। কিন্তু তার শেখানোর কৌশলও নাকি তেমন ভাল ছিল না।

সবচেয়ে বড় কথা, ফাস্টবোলিংয়ের ব্যবহারিক কৌশল খুব ভাল মত আত্মস্থ থাকলেও ফাস্টবোলিং কোচিংয়ে প্রথাগত প্রশিক্ষণ দেবার যে সব কায়দা-কৌশল, নানা ফর্মূলা দরকার, তা জানা ছিল না ওয়ালশের।

ফাস্টবোলিং একটা শিল্প। এটা ক্রিকেট ম্যাচ জেতার সবচেয়ে বড় ও অতি কার্যকর অস্ত্র । কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটাতে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে হয়। একজন ফাস্টবোলারের শারীরিক সক্ষমতা, ফিটনেস দরকার সর্বোচ্চ। সেই সাথে দ্রুত গতিতে বল করা, বাড়তি গতির পাশাপাশি সুইং করানো, বাউন্সার ও ইয়র্কার ছোড়ারও কিছু সুনির্দিষ্ট কলাকৌশল আছে।

এসব বিষয়ে কোচিং করাতে হলে ঐ বিষয়ে শুধু ‘প্র্যাকটিক্যাল’ এক্সপেরিয়েন্স থাকলেই চলবেনা, ‘থিওরিটিক্যাল’ বিষয়গুলোও নখোদর্পনে থাকা একান্তই জরুরী। একজন বিশ্ব মানের প্রতিভাবান ফাস্টবোলার হিসেবে ওয়ালশ নিজে ঐ সব অপরিহার্য যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। কখন কোন উইকেটে কি করণীয়, মরা পিচে কেমন বোলিং করতে হবে, পেস বোলিং সহায় সিমিং কন্ডিশনে কি কি করলে সফল হওয়া যাবে, এগুলো নিজে বুঝতেন। জানতেন। কিন্তু কোচ হিসেবে ছাত্রদের শেখাতে শুধু নিজে জানলে আর পারলেই চলবেনা, কোচিং শাস্ত্রটাও ভাল জানা খুব জরুরী।

মোদ্দা কথা, খেলোয়াড়ি জীবনে যে যত মেধাবী, দক্ষ আর মেধাবী ও সফলই হোন না কেন, কোচ হিসেবে সফল হতে হলে ঐ বিষয়গুলোর শাস্ত্র, তত্ত্ব জানা এবং অন্যকে শেখানোর কলাকৌশল জানতে হবে। সেটাই ছিল না ওয়ালশের। বলার অপেক্ষা রাখেনা, ফাস্টবোলিং কোচিংয়ের তত্ত্ব শাস্ত্র তার তেমন জানা নেই। কারণ তিনি প্রথাগত কোচিংটা সেভাবে করেননি।

আজকাল ক্রিকেট নিয়ে নানা থিসিস হচ্ছে। সব কোচিং ম্যাথডের ওপর নিত্য নতুন কলা কৌশল আর শাস্ত্র তৈরি হচ্ছে। সেগুলো তেমন ভাল জানা ছিলনা ওয়ালশের। আর তার শেখানোর কৌশলও তেমন ভাল ছিল না। যে কারণে ওয়ালশের সময় টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি; কোন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পেস বোলারদের পারফরমেন্স ভাল হয়নি।

মোস্তাফিজ আর তাসকিনের উল্কার বেগে আবির্ভাব ওয়ালশ কোচ হয়ে আসার আগেই। কোথায় ওয়ালশের ছোঁয়ায় তারা বিশ্ব মানের ফাস্টবোলার হবেন, তা না হয়ে দিনকে দিন তাদের বলের ধার কমেছে। ইনজুরি গ্রাস করেছে। ওয়ালশ না পেরেছেন তাদের উন্নত করতে, না ফাস্টবোলারদের ফিটনেস লেভেল ঠিক রাখা ও ইনজুরি থেকে দূরে থাকার কোন কার্যকর দাওয়াই দিতে।

তাই ২০১৫ সালে স্পিনারদের সাথে পাল্লা দিয়ে দলের সাফল্যে অবদান রাখা পেসাররা ২০১৭ ‘র থেকে ধীরে ধীরে নুয়ে পড়েছেন। আজকাল তো নতুন বলে বল করার মত পেসারই নেই। ফিটনেস জনিত দূর্বলতার কারণে মাশরাফি আগের মত পারেননি। বাকিরাও নতুন বলে বল করতে প্রায় ভুলেই গেছেন। এ কারণেই ভুগছে ফাস্টবোলিং। প্রতিপক্ষ ওপেনিং জুটি ভাঙতে নাভিশ্বাস উঠছে। আর ব্রেক থ্রু পেতে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে স্পিনারদের দিকে।

এআরবি/এমএমআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন