ব্যাটিং-বোলিংয়ের চেয়ে ফিল্ডিং ব্যর্থতাই বেশি ভুগিয়েছে টাইগারদের
কেউ কেউ তিন ম্যাচ জয়ের হিসেব কষে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরমেন্সকে বড় করে দেখতে চাচ্ছেন; কিন্তু তারা ভুলেই যাচ্ছেন, ১৯৯৯ সালে এই যুক্তরাজ্যে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ দুই ম্যাচ জিতেছিল। এরপর ২০০৭ সালে তিনটি, ২০০১১ সালে ঘরের মাঠে তিনটি এবং ২০১৫ সালেও সমান তিন ম্যাচেই জয় নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিল টাইগাররা।
হ্যাঁ, এবারের পারফরমেন্সটা একটু বেশিই নজর কেড়েছে মূলতঃ দুটি কারণে। প্রথম কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৩৩০ রানের বিরাট স্কোর গড়ে জয় পায় বাংলাদেশ। তারপর দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সাথে প্রায় সমান সমানে লড়েও শেষ দিকে গিয়ে হেরে বসে।
ইংল্যান্ডের সাথে তিন নম্বর ম্যাচে ৩৭৬ রানের হিমালয় সমান স্কোরের জবাবেও ৩০০’র কাছাকাছি গিয়ে হার মানা। আর চতুর্থ খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ৩২১ রানের বিরাট ও চ্যালেঞ্জিং টার্গেট ছুঁয়ে ফেলা। আর তাতেই সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এর সাথে যোগ হয় সাকিবের দূর্দান্ত এক নৈপুণ্য। অস্ট্রেলিয়ার সাথে পাঁচ নম্বর ম্যাচে গিয়ে ৪১ রান করার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পরপর সেঞ্চুরি করে রীতিমত হই চই ফেলে দেন সাকিব।
তখন থেকে সাকিব বন্দনায় মেতে ওঠে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে রান তাড়ার ম্যাচ দুটি ছাড়া পুরো বিশ্বকাপে একবারও ওপেনিং ভাল হয়নি। দুই ওপেনার তামিম-সৌম্য ওই দুই ম্যাচেই যা করার করেছেন। আর মুশফিক-লিটন ও মাহমুদউল্লাহ মাঝে মধ্যে সহায়ক ভূমিকা নিলেও ধারাবাহিকতার অভাব ছিল পরিষ্কার।
এরপর আর তিন অংকে পৌঁছাতে না পারলেও সাকিব শেষ ম্যাচ পর্যন্ত ব্যাট ও বল হাতে ঠিকই পারফর্ম করে যান; কিন্তু যতই সময় গড়াতে থাকে, ততই অনুজ্জ্বল হতে থাকে টিম পারফরমেন্স। শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় সম্ভাব্য একটি জয় হয় হাতছাড়া। একটি পয়েন্টও যায় কমে।
সে কারণেই শেষ দুই ম্যাচে ভারত আর পাকিস্তানের সাথে জয় জরুরি হয়ে দেখা দেয়; কিন্তু ওই দুই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই পারফরমেন্সের গ্রাফ আরও নিচে নামে। এর মধ্যে ভারতের সাথে শেষ দিকের বোলিংটা ভাল হলেও ব্যাটিংয়ে সাকিব ছাড়া বাকি সবার দায়িত্বহীন ব্যাটিংয়ে সম্ভাব্য জয়ের সুযোগ হয় হাতছাড়া। সর্বেশেষ পাকিস্তানের সাথে শেষ খেলায় বোলিং আর ব্যাটিং- দুই বিভাগেই ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয়।
ওই দুই ম্যাচে মোস্তাফিজ পরপর ৫ উইকেট দখল করলেও নির্মম সত্য, সেই বোলিংটা দলের তেমন কোন কাজে আসেনি। তার নিজের পরিসংখ্যান ও রেকর্ডই যা উজ্জ্বল হয়েছে। খুব লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, শুরুর সাথে শেষেটার কি অস্বাভাবিক গরমিল!
প্রথম চার ম্যাচে দুই জয় আর এক লড়াকু হার ছিল যে দলের, সেই বাংলাদেশ পরের চার ম্যাচে হারলো তিন ম্যাচে। আর একটি মাত্র জয়, তাও আসরের সবচেয়ে দূর্বল-আনকোরা আফগানিস্তানের সাথে।
প্রায় মাঝামাঝি সময় সম্ভাব্য চারে থাকা, তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামা এবং শেষ পর্যন্ত দশ দলের মধ্যে আট নম্বরে জায়গা হওয়া। কেউ কেউ হয়ত আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলছেন, ‘খারাপ কি, ভালই তো খেলেছে; কিন্তু আসলে চুলচেরা বিশ্লেষণে টাইগাররা মাঠে বাঘের হুঙ্কার দিতে পেরেছে কম। কালে ভদ্রে। যা আসলে ব্যর্থতাই।
অনেক সম্ভাবনার এমন করুন পরিণতি, মেলানো কঠিন। অনেকেই এ ব্যর্থতার কারণ খুঁজছেন। কোন জায়গায় ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ? ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল? অনেক বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞরাও মাশরাফি বাহিনীর শেষ পরিণতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এটা প্রমোশন নয় ডিমোশন বলছেন অনেকেই। এর কারণ খুঁজতে গেলে, একটু ভেতরেই যেতে হবে। খালি চোখে মনে হবে সাকিব একাই যা করার করেছেন। বাকি কেউ তাকে সাপোর্ট দিতে পারেননি। সময়ের দাবি মেটানো সম্ভব হয়নি। হোক তা ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিংয়ে, যখন যা করা একান্তই দরকার ছিল, তা করা সম্ভব হয়নি। ঘুরিয়ে বললে তা পারেননি টাইগাররা।
ওপেনিংয়ে তামিম-সৌম্য নিজেদের করণীয় কাজের ৫০ ভাগও করতে পারেননি। মুশফিক, লিটন, রিয়াদ আর মোসাদ্দেকের মাঝেও ছিল ধারাবাহিতার অভাব। তারাও গড়পড়তা দলকে ৬০-৬৫ ভাগের বেশি দিতে পারেননি। ওদিকে অধিনায়ক মাশরাফি ছিলেন বল হাতে একদমই অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ-অকার্যকর। আট ম্যাচে তার উইকেট মোটে ১টি।
গত চার-পাঁচ বছরে যিনি নিয়মিত শুরুতে, না হয় মাঝ পথে ভাইটাল ব্রেক থ্রু এনে সময়ের দাবি মিটিয়েছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আর বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের রানের গতি নিয়ন্ত্রনে রাখার কাজেও ছিলেন এক নম্বর। অথচ বিশ্বকাপে সেই মাশরাফি কিছুই করতে পারেননি। গ্রেড-২ ইনজুরি নিয়ে খেলেছেন। বোঝাই গেছে বল করতেই কষ্ট হয়েছে তার। তাইতো আট ম্যাচে উইকেট মাত্র একটি। আর রানও দিয়েছেন গড়পড়তা সাড়ে ছয়-সাতের মত করে।
মাশরাফির এ অনুজ্জ্বলতা মেটাতে অন্তত একজন পেসারের বোলিং কার্যকরিতা দরকার ছিল। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, কেন মোস্তাফিজ তো ভালই করেছেন। হ্যাঁ, উইকেট প্রাপ্তিকে মানদন্ড ধরলে ভালই করেছেন।
মোস্তাফিজ ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ দুই ম্যাচে ৫+৫ (১০) উইকেট করে পেয়েছেন। ওই ২০ উইকেট পেতে এ পেসার ৮ ম্যাচে ৭২.১ ওভার বল করে রান দিয়েছেন ৪৮৪। ওভার পিছু যা প্রায় পৌনে ৭ (৬.৭০)। উইকেট শিকারে অনেক ওপরে জায়গা পেলেও মোস্তাফিজ কিন্তু মাশরাফির ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারেননি। মাশরাফি অন্য সময় যে কাজগুলো করে দলকে সার্ভিস দিয়েছেন, সেই কাজটিই হয়নি এবারের বিশ্বকাপে।
সাইফউদ্দীনের নামের পাশেও জমা পড়েছে ১৩ উইকেট; কিন্তু তার পক্ষেও মাশরাফির জায়গা নেয়া সম্ভব হয়নি। সেটা খালিই ছিল। সাইফউদ্দীন প্রচুর রান দিয়েছেন। তার ওভার পিছু রান উঠেছে ৭.১৮ করে।
মোটকথা সব ফরম্যাটে যার ব্যাট সবচেয়ে সচল, যিনি রান তোলায় সবার ওপরে সেই তামিমের অস্বাভাবিক অনুজ্জ্বলতা, মুশফিকের স্বাভাবিকের চেয়ে কম ভাল খেলা, রিয়াদের অনুজ্জ্বলতার সাথে অধিনায়ক মাশরাফির বোলিং অকার্যকরিতার মিশেলে বাংলাদেশ অনেক অভিজ্ঞ ও পরিণত দল নিয়েও এবারের বিশ্বকাপে পারেনি।
এর সাথে যোগ হয়েছে চরম বাজে ফিল্ডিং আর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রতিপক্ষের প্রধান ব্যাটসম্যানদের ক্যাচ ফেলে দেয়া। একবার হলে তাও একটা কথা ছিল। তিন ম্যাচে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা তিন-তিনজন বড় ব্যাটসম্যানের ক্যাচ ফেলেছেন। তিনটি ক্যাচ মিসই ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে।
বেশ ক’টি ভাইটাল রান আউটের চান্সও কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এর বাইরে মিস ফিল্ডিং, ঠিকমত বল ধরতে না পারা, ফিল্ডার ব্যাকআপ করছে কিনা, না দেখে থ্রো করে প্রায় ম্যাচে প্রতিপক্ষকে ১০ থেকে ১৫টি অতিরিক্ত রান দেয়াও ছিল ব্যর্থতার আরও একটি কারণ।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে মাত্র ১০ রানে ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলে তাকে জীবন দিয়েছিলেন সাব্বির রহমান রুম্মন। জীবন পাওয়া ওয়ার্নার ১৬৬ রানের বিশাল ইনিংস খেলে টাইগারদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন। ভারতের বিপক্ষে রোহিত শর্মা এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে বাবর আজমের ক্যাচও বেরিয়ে গেছে ফিল্ডারদের হাত ফষ্কে।
এ আসরে যার ব্যাট খোলা তরবারি, যিনি প্রায় প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করে পাঁচ-পাঁচটি সেঞ্চুরির মালিক, সেই রোহিত শর্মাও বাংলাদেশের সাথে ১০ রানে জীবন পেয়েছেন। তামিম ইকবালের হাতে বেঁচে গিয়ে ঠিক সেঞ্চুরি (১০৪) হাঁকিয়ে তবেই ফেরেন রোহিত। ভারত পায় বড় সড় স্কোরের বড় উপাদান।
শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে আবার ক্যাচ মিস। তাও একটি নয় দু’টি। পাকিস্তান ব্যাটিং স্তম্ভ ও এক নম্বর ব্যাটম্যান বাবর আজমের দু’দুটি ক্যাচ গেল হাত ফষ্কে। প্রথমবার মোস্তাফিজের বলে মোসাদ্দেক ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে লোপ্পা ক্যাচ ফেলেছেন। ৫৭ রানে বেঁচে যাওয়া বাবর আজম অফ স্পিনার মিরাজের বলে ৬৫ রানে কট বিহাইন্ড হবার হাত থেকে বেঁচে যান মুশফিকের গ্লাভস থেকে।
বাবর আজম (৯৮ বলে ৯৬) ওয়ার্নার ও রোহিত শর্মার মত সেঞ্চুরি করতে না পারলেও বাংলাদেশের বড় ক্ষতি করে যান। বাবর যখন প্রথম জীবন পান তখন ২৫ ওভার শেষে পাকিস্তানের রান ছিল ২ উইকেটে ১১৫। সেখান থেকে তারা চলে যায় ৩১৪-তে।
এটাই শেষ নয়। যে নিউজিল্যান্ডের সাথে ২৪৪ রানের মাঝারী পুজি নিয়েও জয়ের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল, সেই কিউই ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসনের নিশ্চিত রান আউটের সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার চরম মাশুল গুনতে হয় বাংলাদেশকে। ওই ম্যাচে ২৪৪ রান নিয়ে শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াই করা বাংলাদেশের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করেন উইলিয়ামসন।
৮ রানে নিশ্চিত রান আউটের হাত থেকে বাঁচেন নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন। রান নিতে গিয়ে পিচের অর্ধেকটার বেশি পার হয়ে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া উইলিয়ামসনের গতি প্রকৃতি দেখে ও বুঝে ব্যাটসম্যান প্রান্তে কিপার মুশফিকের দিকে থ্রো করেন তামিম। অতি উৎসাহি মুশফিক কিপিংয়ের ব্যাকরণ ভেঙ্গে উইকেটের পিছনে না রেখে সামনে হাত নিয়ে এসে চরম ভুল করে বসেন। বল আসার আগে তার গ্লাভসের ওপরে কনুইংয়ে আশপাশে লেগে আগে ভাগে বেলস পড়ে যায়। রান আউটের আবেদনে টিভি রিভিউ চেয়ে বেঁচে যান উইলিয়ামসন। টিভি রিপ্লেতে ধরা মুশফিকের কনুই তামিমের থ্রো আসার আগেই বেলস ভেঙ্গে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের করা ২৪৪ রানের জবাবে কিউইদের রান তখন মোটে ২ উউকেটে ৬১। ১২ নম্বর ওভালের খেলা চলছি। ওই সময় উইলিয়ামসন আউট হলে বাংলাদেশ অনেক সামনের পায়ে এগিয়ে অসতো। ব্ল্যাক ক্যাপ্সরা ততটাই ব্যাকফুটে চলে যেত।
কিন্তু কিউই ক্যাপ্টেন পরে ৪০ রান করেন এবং রস টেললের সাথে ১০৫ রানের এক বড় ও অতি দরকারী-কার্যকরি জুটি গড়ে বসেন। সেটাই কাল হয়ে দেখা দেয়। এভাবেই হাতের মুঠোয় আসা সুযোগগুলো নষ্ট হওয়ায় প্রকারান্তরে ম্যাচ হয়েছে হাতছাড়া। আর তাই শেষ পর্যন্ত অষ্টম হয়ে দেশে ফিরে গেছে মাশরাফির দল।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর