বিশ্বকাপ জিততে না পেরেও অন্যরকম এক উইলিয়ামসন!
একটি দল রাউন্ড রবিন লিগে দোর্দন্ড দাপটে খেললো। যাকে তাকে হারালো বড় ব্যবধানে। একটি ছাড়া সব দলের বিপক্ষে জয়ের পরও (অন্য এক ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত) সেমির যুদ্ধে হেরেই পত্রপাট বিদায় নিল- কেন যেন এ নিয়ম মানতে বড্ড আপত্তি বিরাট কোহলিদের।
তাইতো নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের ফরম্যাট বদলের আর্তি ভারত অধিনায়কের কন্ঠে। বিরাট কোহলির ভাবটা এমন, রাউন্ড রবিন লিগ বা গ্রুপ পর্বে প্রায় ৯০ ভাগ সাফল্য দেখানোর পর একটা দল সেমিফাইনালে হেরেই বিদায় নিবে, এ আবার কেমন আইন? তাতে সারা আসর ভাল খেলে একদিন খারাপ খেলার কারণেই বিদায় নিতে হয়।
তারচেয়ে যদি আইপিএলের আদলে ‘কোয়ালিফায়ার-১, ২ আর এলিমিনেটর পর্ব থাকে, তাহলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন বা সবার ওপরে থাকা দলটি ফাইনালের আগে একবারের বদলে দুবার সুযোগ পায়। এবার ৯ খেলার ৭টিতে জেতা ভারত অধিনায়কও সেমির যুদ্ধে হারার পর ওই নিয়ম চালুর আহ্বান জানালেন।
অনেকেরই ধারনা ছিল, নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনও হয়ত সেরকম কিছু বলবেন। খেলা শেষে প্রেস মিটে হয়ত বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোর সুবাদে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন- এই আইনের কঠোর সমালোচনা করবেন। আইসিসির চৌদ্ধ গোষ্ঠি উদ্ধার করবেন এবং দাবি করবেন, আমরা এক অদ্ভুত আইনের করুন ‘বলি’ হলাম। এই অদ্ভুত নিয়মই কেড়ে নিল আমাদের বিশ্বকাপ। পুরো ম্যাচে ৫০ ওভারের লড়াই আর সুপার ওভারে রান সমান থাকার পরও কম বাউন্ডারি হাঁকিয়েছি বলে আমাদের হারতে হলো। ’
কেউ কেউ ভেবোছিলেন উইলিয়ামসনকে হয়ত প্রেস মিটে রীতিমত বিদ্রোহীর বেশ ও রুপে দেখা যাবে। তিনি সংবাদ সন্মেলনে ঢুকেই হয়ত বলে দিবেন, ‘ধিক্কার জানাই। প্রতিবাদ জানাই। এ আবার কেমন আইন? আমরা এ নিয়ম মানি না। মানবো না।’ কিন্তু সে ধারনা অমুলক। ভুল।
আপাদমস্তক নিপাট ভদ্রলোক, বিনয়ী নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক সে পথ দিয়ে হাঁটলেন না। এমন কোন বিতর্কিত মন্তব্যে না গিয়ে উইলিয়ামসন বললেন, ‘আসলে এটাতো নিয়মের মধ্যেই হয়েছে। এটা সত্যি আমার এ সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তবে ম্যাচ টাই হবার পর থার্ড আম্পায়ার আলিম দা’র এসে জানালেন, সুপার ওভারও যদি রান সমান হয়ে যায় তাহলে যে দল বেশি চার হাঁকাবে তারাই বিজয়ী হবে।’
এ আইনও আজ করা হয়নি। আগেই করা। এর বেশি আর কিছু না বলে শেষ করলেন কিউই ক্যাপ্টেন। তবে যে ভাবটা উহ্য থাকলো, তাতে বোঝা গেল একটা আক্ষেপ আছে। তবে মৌখিক অভিযোগ-অনুযোগে জানানো থেকে বিরত থাকাই হত উত্তম।
বিশ্বকাপ বিজয়ী দলের অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান খেলা ও পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান শেষে প্রেস বক্সে এসেছিলেন ট্রফি হাতে হাসি মুখে। বিশ্বজয়ের উল্লাসে। নিশ্চয়ই ভাবছেন নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসন প্রেস মিটে এসেছিলেন হতাশায় মুষড়ে, কান্না ভেজা চোখে। শারীরিক অভিব্যক্তিতে নিশ্চয়ই ছিল সব হারানোর বেদনা। যন্ত্রনা।
হয়ত তাই। ৫০ ওভারের নির্ধারিত লড়াই আর সুপার ওভারে গিয়ে রানে সমান সমান থেকেও বাউন্ডারি কম হাঁকানোর মানদন্ডে বিশ্বকাপ জিততে না পারা যে সব হারানোর মতই দুঃখের। কষ্টের!
হয়ত ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল; কিন্তু কাল (রোববার) ১৪ জুলাই লর্ডসের ফাইনালের পর কিউই ক্যাপ্টেনকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের ঝানু ঝানু সাংবাদিকরাও ব্ল্যাক ক্যাপ্স অধিনায়ক উইলিয়ামসনের শরীরি অভিব্যক্তি দেখে আর তার কথা শুনে অবাক হলেন!
অবাক হবারই কথা। কারণ উইলিয়ামসন প্রেস কনফারেন্সে কথা বললেন একদম ঠান্ডা মাথায়। তারচেয়ে বড় মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই ছিল। ঠিক যেমনটা ছিল ফাইনালের আগের দিনের প্রেস কনফারেন্সে। ১৬ মিনিটেরও বেশি সময়ের প্রেস মিটে উইলিয়ামসন একবারের জন্য হা-পিত্যেশ করেননি।
ফর্সা মুখ না পারার দুঃখ-যন্ত্রনায় কাতর হননি। প্রায় সবক’টা প্রশ্নর উত্তর দিলেন হেসে হেসে। তার চেয়ে বড় কথা, সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নিজে অন্তত চার-পাঁচবার খুনসুটি করেলন। রসিকতার মিশেলে জবাব দিলেন। আর হেসে হেসেই কথা বললেন।
এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, আমার এখন দুটিই করণীয়। এক কান্না। দুই হাসা। তিনি কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পরে মনে হলো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার চেয়ে মনে হয় হাসা উত্তম। তাই মুখে হাসি আর আচরণে রসিকতা।
তবে দুটি প্রশ্নর জবাব দিতে গিয়ে স্বভাবসুলভ রসিকতা ও খুনসুটি করা থেকে যতটা সম্ভব বিরত থেকে খুব সংক্ষেপে অনেক ভারি জবাব দিয়েছেন উইলিয়ামসন। প্রশ্ন উঠলো, ফাইনালে কম বাউন্ডারি হাঁকানোর কারণে হেরে যাওয়া এবং বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হওয়া- কতটা দুঃখের, বেদনার ও কষ্টের?
তিনি তখন জানিয়ে দিলেন, ‘আমার এখন কান্না আর হাসা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? তাই হাসছি।’
প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসলো বিশ্বকাপ সেরা পারফরমার হবার বিষয়টিও। প্রশ্ন রাখা হলো, আপনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বকাপ ট্রপি উঁচিয়ে ধরার সুযোগ না পেলেও বিশ্বকাপ সেরা পারফরমারের পুরষ্কারটা ঠিকই পেয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার অনুভুতি বা প্রতিক্রিয়া কি?
সেখানেও ব্যতিক্রম কেইন উইলিয়ামসন। একদম ছোট্ট কিন্তু সাজানো গোছানো জবাব, ‘আসলে আমার মনে দলগত পারফরমেন্স অর্জন আর প্রাপ্তির তুলনায় সেটা নিছক গৌন। আমার কাছে দল, দলের পারফরমেন্স এবং সাফল্য অনেক বড়। আমরা একটা ইউনিট হিসেবে খেলেছি। নিজেদের বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। সেই দল চ্যাম্পিয়ন হলেই অনেক বেশি খুশি হতাম। আনন্দ পেতাম। ব্যক্তিগত অর্জন আসলে ওই দলীয় বিষয়গুলোর সাথে তুলনা করার মত নয়।’
প্রশ্ন ছিল মার্টিন গাপটিল ফর্মে নেই, তারপরও তাকে সুপার ওভারে ওপেন করতে পাঠানো হলো? আর তার স্লো রানিংয়ের কারণেই জয়সূচক ডাবলস নেয়া হয়নি আপনাদের। উল্টো গাপটিল দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে আউট হওয়ায় ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো।
তা নিয়েও কোন কটু কথা বলতে নারাজ উইলিয়ামসন। গাপটিলের এক প্রস্থ প্রশংসা করে উইলিয়ামসন শেষ করলেন এভাবে, ‘গাপটিল কিন্তু বেশ ভাল রানার। দৌড়াতেও পারে বেশ ভাল। হয়ত আজ হয়নি।’
ক্রিকেট খেলাটই হয়ত এমন। কবে কখন যে কি ঘটে? কেউ জানে না।
"We're gutted that it's not us but England had a very good campaign and they deserve the victory." #NZvENG | #CWC19 | #CWC19Final pic.twitter.com/yYrz4hC8Jb
— ICC (@ICC) July 15, 2019
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম