মোস্তাফিজের হাত ধরে ভারতকে নাগালের মধ্যেই রাখলো বাংলাদেশ
মাশরাফি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না। অস্ট্রেলিয়ার সাথে যে ভুল হয়েছিল, তা যেন আর না হয়। আর শুধু একটা ডিপার্টমেন্টে ভাল করলেই চলবে না। বোলিং, ব্যাটিং আর ফিল্ডিং- তিন শাখাতেই ভাল করতে হবে। সেই ভালোর মাত্রা যেন হয় শতভাগ। তবেই আমাদের সম্ভাবনা থাকবে।’
কাল এজবাস্টনের প্রেস কনফারেন্সে বাংলাদেশ অধিনায়ক যখন বার কয়েক ভারতকে ফেবারিট, শক্তিশালী আর খুব সাজানো-গোছানো দল আর কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করছিলেন, ঠিক তখন এক বাংলাদেশি সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ‘আচ্ছা ক্যাপ্টেন, ভারতের পাল্লা ভারি। তা নয় মানা গেল; কিন্তু এমন কোন জায়গা বা ক্ষেত্র কি নেই যেখানে বাংলাদেশ এগিয়ে? কিংবা ভারত বধে আপনার নিজের কাছে কোন মন্ত্র বা দাওয়াই আছে?’
জবাবে মাশরাফি বলেছিলেন, ‘ঠিক এই মাঠে আগের ম্যাচে ইংলিশদের কাছে হারলেও ভারতের ব্যাটিং সামর্থ্য অনেক। বোলিংটাও দারুণ। ব্যাটিংয়ে টপ অর্ডারে (রোহিত-কোহলি) যারা আছেন তারা সেট হয়ে গেলে পরে আটকানো মুশকিল। কাজেই কোনরকম ভুল করা যাবে না। ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের তিন শাখায় শতভাগ উপহার দিতে হবে।’
অস্ট্রেলিয়ার সাথে ম্যাচে ওয়ার্নারের ক্যাচ ড্রপ আর রান আউটের চান্স মিস- এসব ঘটনার উদাহরণ টেনে মাশরাফি বলে ওঠেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সাথে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না কিছুতেই।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার চোখে ভারতই সবচেয়ে কঠিন ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এমন উক্তিই বলে দেয়, কোহলি, রোহিত আর ধোনিদের তিনি কোন পাল্লায় মাপেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে দল হিসেবে ভারত অনেক শক্তিশালী। ব্যাটিং-বোলিংটা বেশ সমৃদ্ধ এবং গোছানো। সেই দলকে হারাতে হলে আমাদের শুধু ভাল খেললেই চলবে না। এবারের বিশ্বকাপে আমরা এখনো যত ভাল খেলিনি, সেই না খেলাটাই কাল খেলতে হবে।’
ওপরের সতর্ক ও সাবধানবাণীগুলো লক্ষ্য করুন ভালভাবে। একজন অধিনায়ক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এরচেয়ে ভাল আর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন কিভাবে? কিন্তু যাদের জন্য বলা, তার সহযোগিরা কি তা পালন করতে পারলেন? বোলিং যেমন তেমন, ফিল্ডিং আর ক্যাচিং কি শতভাগ পারফেক্ট হলো?
এক রোহিত শর্মার ক্যাচটাই আফসোস-অনুশোচনার প্রতীক হয়ে থাকলো এই ম্যাচে। একবার ভেবে দেখুন ১০ রানে জীবন পাওয়া রোহিত শর্মা শেষ পর্যন্ত ১১৩.০৪ স্ট্রাইকরেটে ৯২ বলে করেছেন ১০৪। তার মানে তার যেখানে ১০ রানে সাজঘরে ফেরার কথা সেই তিনি ৯৪ রান বোনাস পেয়েছেন।
মানা গেল রোহিত শর্মা তখন আউট হলে হয়ত আর কেউ তেমন একটা ইনিংস খেলতেন। তা খেলতেই পারতেন; কিন্তু রোহিত শুরুতে আউট হয়ে গেলে ভারতের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গতো ১৮ রানে। তারপর উইকেটে গিয়ে যদি অধিনায়ক বিরাট কোহলিও সেঞ্চুরি করতেন, তাহলেও তো শুরুর ধাক্কা ও বিপর্যয় কাটাতে তাকে খেলতে হতো অনেক সতর্ক ও সাবধানে।
খুব স্বাভাবিকভাবে রানের গতি যেত কমে। পাশাপাশি রোহিত শর্মা শুরুতে আউট হয়ে গেলে, তার উইকেট নিয়ে নিশ্চয়ই টাইগাররা আরও উজ্জীবিত হতেন। বোলিং আর ফিল্ডিং ব্যাকআপটাও হয়ত ভাল হতো। ৫০ ওভার শেষে বিরাট কোহলির দল যেখানে ৩১৪ রানে থামলো, রোহিত শর্মার ক্যাচ নিতে পারলে হয়ত ভারতকে ২৮০ থেকে ৩০০‘র নিচে আটকে রাখা যেত।
কিন্তু তামিম ইকবালের এক ক্যাচ ড্রপে তা আর হয়নি। তবুও বোলিংয়ের প্রশংসা না করে পারা যায় না। ৫০ ওভারের ম্যাচে প্রতিপক্ষ ভারত বল পিছু রান তুলে প্রথম উইকেটে ১৮০ রান (২৯.২ ওভারে) তুলে নিয়েছিল। সেখান থেকে ৯ উইকেট হাতে থাকা অবস্থায় কোহলি, রিসাভ পান্ত, হার্দিক পান্ডিয়া আর মহেন্দ্র সিং ধোনিদের পরের ২০ ওভারে হাত খুলে খেলা থেকে যথাসম্ভব দুরে রাখাটা রীতিমত কৃতিত্ব বৈকি!
শেষ ২০ ওভারে ভারতীয়রা তুলেছে ১৩৪ রান। ২৫১/৪ থেকে ৩১৪/৯। তার মানে শেষ ১০ ওভারে ভারতীয়রা যোগ করতে পেরেছে ৬৩ রান। আর টাইগাররা তখন উইকেটের পতন ঘটিয়েছেন ৫টি। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের।
এবারের বিশ্বকাপে আজই সেরা বোলিং করেছেন কাটার মাস্টার। সাথে এ ম্যাচে আবার দলে ফেরা দ্রুত গতির বোলার রুবেল, বাঁ-হাতি সাকিব, স্লো মিডিয়াম সৌম্য আর অনিয়মিত অফস্পিনার মোসাদ্দেক মিলে সেই কঠিন কাজটিই বেশ আন্তরিকতার সাথে বাস্তবে পরিণত করেছেন।
মোস্তাফিজ অবশেষে ঠিক বড় ম্যাচে নিজেকে মেলে ধরেছেন। ১০ ওভারে ৫৯ রানে ৫ উইকেট দখল করেছেন এই বাঁ-হাতি পেসার। ম্যাচে তার উইকেট সবার চেয়ে বেশি বলেই নয়, মোস্তাফিজই যা সমীহ আদায় করেছেন। অযথা বাড়তি কিছু করতে না চেয়ে বল করেছেন মাথা ও বুদ্ধি খাটিয়ে। কখনো স্লোয়ার, কখনো অফ স্ট্যাস্পের বাইরে কৌণিক ডেলিভারি ছুঁড়ে আবার কোন সময় স্লোয়ার, বাউন্সারে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করেছেন মোস্তাফিজ।
আর সে কারণেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের বড় স্তম্ভ অধিনায়ক কোহলি আর মিডল ও লেট অর্ডারের সবচেয়ে মারকুটে তিন উইলোবাজ হার্দিক পান্ডিয়া, দিনেশ কার্তিক এবং ধোনির উইকেট জমা পড়েছে মোস্তাফিজের ঝুলিতে। ইনিংসের শেষ বলে ভারতীয় পেসার শামির উইকেট উপড়ে ফেলে মোস্তাফিজ তৃতীয়বারের মত ভারতের বিপক্ষে ৫ বা তার বেশি উইকেট পেলেন।
ইতিহাস জানাচ্ছে, পরিসংখ্যানও আশার বাণী শোনাচ্ছে, এর আগে মোস্তাফিজ যে দুইবার ভারতের বিপক্ষে ৫ বা তার বেশি উইকেট পেয়েছেন, প্রতিবার বাংলদেশ জিতেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না দুটি জয়ই ২০১৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের মাটিতে।
২০১৫ সালের ১৮ জুন নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৯.২ ওভারে ৫ উইকেটের পতন ঘটিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। ওই বিধ্বংসী বোলিংয়ে বাংলাদেশের করা ৩০২ রানের জবাবে ভারত অলআউট হয়ে গিয়েছিল ২২৮ রানে। ৭২ ঘন্টা পর ২১ জুন আবার মোস্তাফিজ ম্যাজিক। এবার ৪৩ রানে ৬ উইকেট শিকার করে আবারো ভারত বধের নায়ক কাটার মাস্টার।
তার আগুন ঝরানো বোলিংয়ে ভারত অলআউট হয়ে যায় মাত্র ২০০ রানে। টাইগাররা ৬ উইকেট হাতে রেখে ওই ছোট্ট টার্গেট ছুঁয়ে ফেলে ৭২ বল আগেই। আজ রোহিত শর্মার ক্যাচটি তামিম ধরে রাখতে পারলে আবারো ৬ উইকেট হতো মোস্তাফিজের। ভারতও কম রানে থামতো।
সাকিব যথারীতি নিজের অভিজ্ঞতা ও মেধা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ভারতীয়দের হাত খুলে খেলা থেকে বিরত রেখেছেন। তরুণ রিশাভ পান্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই তাকে ফিরিয়ে ভারতের রানের গতি কমানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে যান সাকিব।
প্রথম কয়েকটি ম্যাচ বাইরে থাকার পর অস্ট্রেলিয়ার সাথে হঠাৎ সুযোগ পেয়ে কিছু করতে না পারলেও আজ বেশ ভাল বল করেছেন রুবেল। অফ স্ট্যাম্প ও তার আশপাশে ভাল জায়গায় বল ফেলার চেষ্টা ছিল রুবেলের। তবে হতাশ করেছেন সাইফউদ্দীন। এক কথায় কিছুই করতে পারেননি এ পেসার।
সাইফউদ্দীনের ৭ ওভারে রান উঠেছে ৫৯। আর দুই অকেশনাল বোলার সৌম্য (৬ ওভারে ১/৩৩) আর মোসাদ্দেক ( ৪-০-৩-০) মিলে ১০ ওভারে দিয়েছেন ৬৫।
তারপরও ৩১৪ রান খুব বেশি নয়। ব্যবহার হওয়া পিচ। পরের সেশনে না আবার স্লথ হয়ে যায়। একটু ভাঙ্গতেও পারে। যদি তা না হয়, উইকেট বেঁকে না বসে- তাহলে ৩১৫ কিন্তু খুব বড় আর কঠিন টার্গেট নয়। যে দল এবার আগে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৩৩০ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৩২১ রান তাড়া করে জিতেছে, যারা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮১ রানের হিমালয় সমান লক্ষ্যের পিছু ধেয়েও ৩৩৩ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, সেই বাংলাদেশের সামনে আজ ৩১৫ রানের টার্গেট। এটা কি খুব কঠিন?
শুরুটা ভাল হলে আর সাকিব-লিটন ও মুশফিকের যে কোন দুজন দুটি বড় ইনিংস খেলে ফেললেই হয়ত হয়ে যাবে।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর