অনেক ঘটনার সাক্ষী এজবাস্টন ঘুরে এসে...
মাত্র ৪৮ ঘন্টারও কম সময় আগে (২৬ জুন) এই স্টেডিয়ামে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ড ম্যাচ হয়ে গেছে। আর ৩০ জুন স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ভারতের ম্যাচও হবে বার্মিংহামের এজবাস্টনেই। তার ঠিক দুু’দিন পর একই মাঠে ভারতের বিপক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাঠে নামবে বাংলাদেশ।
পুরো বাংলাদেশ তাই তাকিয়ে বার্মিংহাম শহরের এজবাস্টন স্টেডিয়ামের দিকে। বৃহস্পতিবার সকালে বাংলদেশের টিম হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে টাইগার ওপেনার সৌম্য সরকারের কথোপকথন পর্ব শেষ করে ট্যাক্সিতে সোজা চলে গেলাম এজবাস্টনে। দুরত্ব খুব বেশি নয়, মাইল তিনেক সর্বোচ্চ। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামের মত ট্রাফিক নেই। যে কারণে ট্যাক্সিতে ছয়-সাত মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
ট্যাক্সি গিয়ে থামলো মূল গেটে। কিন্তু ভেতরে যেতে গিয়েই বিপত্তি। নিরাপত্তাকর্মীরা সাফ জানিয়ে দিলেন, ভেতরে যাওয়া যাবে না, অনুমতি নেই। আমরা ‘নাছোরবান্দা’ কিছুতেই নড়ছি না দেখে, তার মনে হলো নাহ, এদের অন্তত রিসিপশন পর্যন্ত যেতে দেয়া যায়। ভেতরে ঢুকতেই এক ইংলিশ নারী হাসি মুখে বললেন, ‘হ্যালো! জেন্টল ম্যান, হাউ ক্যান আই হেল্প উই?’
বলা হলো, ভেতরে যেতে চাই। মাঠটা দেখবো, কিছু ছবি তুলবো। আর বিভিন্ন স্ট্যান্ড ঘুরে দেখবো। পাল্টা প্রশ্ন এলো, তোমরা কি জার্নালিস্ট? আইসিসি বিশ্বকাপের এক্রিডিটেশন কার্ড দেখানো হলো, ভাবলাম ওটাই বুঝি রক্ষকবচ হবে।
কিন্তু বাস্তবে কিছুই হলো না। বললেন, ঐ সোফায় বসে অপেক্ষা করো। আমি ভেতরে আইসিসি মিডিয়া অপারেশন্সে কথা বলে দেখি। মিনিট পাঁচেক না যেতেই বললেন, সরি জেন্টলম্যান আমি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নিতে পারিনি। আজ তোমাদের ভিতরে যাওয়া হবে না।
আইসিসির এক্রিডিটেশন কার্ড গলায়, সব মাঠে যাবার অনুমতি আছে। কিন্তু আজ এজবাস্টন স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড বা ভিভিআইপি দিয়ে মাঠের ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিললো না।
আমরা যে মহিলাকে রিসিপশনিস্ট ভেবেছিলাম , তিনি আসলে ভেন্যু ম্যানেজার। সব সময় ঐখানেই অবস্থান করেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, তোমাদের আইসিসির এক্রিডিটেশন আছে ভাল, তবে এই মাঠ ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ক্লাবের। এই স্টেডিয়ামের ভিতরে ঢুকতে গেলে ঐ কার্ডই শেষ কথা নয়। সময় আছে, বিশ্বকাপ ম্যাচের আগে তোমাদের দল যখন প্র্যাকটিসে আসবে সেইদিন তোমরা মাঠের ভেতর যেতে পারবে, অন্য দিন বা তার আগে নয়।
তার মানে ১ জুলাইয়ের আগে নয়। ৩০ জুন এই মাঠে স্বাগতিক ইংলিশরা খেলবে বিরাট কোহলির ভারতের বিপক্ষে সেই দিন টাইগাররা কেন, কোন দলের প্র্যাকটিস করতে মূল মাঠ ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না। ঠিক নটিংহ্যামের হ্যাম্পশায়ার বোলের মত। আগের দিন ভারত-আফগানিস্তান ম্যাচ ছিল, তাই মাশরাফি বাহিনীকে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে পাশে ‘ইয়া বড়’ খোলা মাঠে।
বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না বার্মিংহামেও তাই হবে। অর্থাৎ মাঠের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ১ জুলাই। কী আর করা? কিছু সেলফি, টেলফি তুলে বিফল মনোরথ হয়ে হোটেলে ফেরা। তাহলে লেখার খোরাক কি? ভাবছেন এমনি এমনি বুলি আওরে যাচ্ছি বুঝি।
নাহ, কিছু একটা খোরাক ঠিকই আছে। অবশ্য সেটা পেতে ছলচাতুরির আশ্রয় না নিলেও একটু চোখ-কান খোলা রাখতে হয়েছে। ওয়ারউইকশায়ার ক্লাবের মাঠ এজবাস্টনের ভেন্যু ম্যানেজার যখন দূরে সোফা দেখিয়ে বসতে বলছিলেন, ঠিক তখনই চোখ গেল একটু দূরে কিছু ছবির ওপরে। এক জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেল, ব্রায়ান লারার ছবি।
শব্দ করে নয়, মনে মনে বললাম, ‘ইউরেকা’, আরেহ! এটাই তো খুঁজছিলাম। এই ভেন্যুর গল্প-কাহিনী তো আর ব্রায়ান লারার কীর্তি ছাড়া হবে না। অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ভাবছেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের রাজপুত্র রেকর্ডের বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারার ছবি এখানে কেন? আরে এখানেই তো থাকবে। এই এজবাস্টন আর ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ওয়ারউইকশায়ারের সঙ্গেই যে ব্রায়ান লারার জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা জড়িয়ে আছে।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৪ সালের ৬ জুন এই মাঠেই ব্রায়ান লারা এমন এক কীর্তি গড়েছেন, তা কে কবে ভাঙবে কিংবা আদৌ ভাঙতে পারবে কি-না? সেটাই দেখার।
বলার অপেক্ষা রাখে না, টেস্টে ৪০০* রানের সর্বোচ্চ ইনিংসের পাশাপাশি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৫০১ রানের দূর্লভ ইনিংসটি ক্যারিবীয় ক্রিকেটের যুবরাজের এবং সেই অবিস্মরণীয়, ঐতিহাসিক ইনিংসটি ছিলো এই এজবাস্টনেই।
মাঠটি যে কাউন্টি ক্লাবের, সেই ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ডারহামের বিপক্ষে ৫০১ রানের ঐ অসামান্য ইনিংসটি খেলেছিলেন লারা। সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডের ভিতরে কায়দা করে লারার ছবি সাজানো। সেই ছবি চোখে পড়তেই মোবাইলের ক্যামেরা অপশনে অলক্ষে আঙুল চলে গেল।
মুহূর্তকালের জন্য ভুলে গেলাম, কি যেনো, এখানে ছবি তোলার অনুমতি আছে তো? যা হোক বেশ কয়েকটি ছবি পাশাপাশি সযত্নে টানানো। ১৯৫০ দশকের কিছু ছবি আছে, সাদা কালো। একটি ছবিও অস্পষ্ট হয়নি। মনে হচ্ছে যেন মাত্র ৩/৪ বছর আগের ছবি।
ব্রায়ান লারার ছবি পেলাম, পাশাপাশি দুটি ছবি। একটিতে সেই ৫০১ রানের ইনিংসে ওয়ারউইকশায়ারের অফিসিয়াল স্কোরবোর্ডের ছবি আর তার নিচে দাঁড়ানো লারা। ডারহামের ৮ উইকেটে তোলা ৫৫৬ রানের জবাবে ওয়ারউইকশায়ারের ৪ উইকেটে তোলা ৮১০!
ঘড়ির কাটাকে পেছনে ফেলে ৪৭৪ মিনিটে ৪২৭ বলে ১১৭.৩৩ স্ট্রাইকরেটে ৬২ বাউন্ডারি আর ১০ ছক্কায় সাজানো লারার ৫০১ রানের ইনিংসটির স্মৃতি বিজরিত এজবাস্টনে পা রাখতে পারা আর লারার ছবি তোলার অনুভূতি যে কতটা পুলক জাগানো- তা বলে বোঝানো কঠিন।
ব্রায়ান লারা নিজেও নিশ্চয়ই মাঝে মধ্যে হয়ত সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণ করেন। আর ভাবেন, কীভাবে ঐ অতিমানবীয় ইনিংসটি খেলেছিলাম। সত্যিই তো, চার দিনের ম্যাচে যেখানে একদলের পাঁচশ রান করতেই নাভিশ্বাষ উঠে যায়, সেখানে একা লারার ব্যাট থেকেই এসেছিল ৫০১!
সেই ইনিংসটি শুধু এক স্বপ্নীল ইনিংসই নয়। একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করা ইনিংসও। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন এই এজবাস্টনে ডারহামের বিপক্ষে ইংলিশ কাউন্টিতে লারা ভেঙেছিলেন লিটল মাস্টার হানিফ মোহাম্মদের ৪৯৯ রানের রেকর্ড।
তাও এক দুই বছর নয় ৩৫ বছর পর। ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারী করাচির পার্সি ইনস্টিটিউটর মাঠে পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর কায়েদ ই আজম ট্রফিতে বাওয়ালপুরের বিপক্ষে ৪৯৯ রানের ইনিংস খেলে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বাধিক ব্যক্তিগত স্কোরটি গড়েছিলেন পাকিস্তানের এই সাবেক ওপেনার। তখন বেশিরভাগ ম্যাচই হতো ম্যাটিং উইকেটে। হানিফ মোহাম্মদের রেকর্ড ৪৯৯ রানের ইনিংসটিও ম্যাটিং উইকেটে।
৫০ দশকের শেষভাগে করাচিতে ম্যাচ আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধা ছিল সামান্যই। ভাগ্য সহায় থাকলে আর স্কোরারদের দক্ষতা ও আনুসঙ্গিক সুবিধা থাকলে হয়ত হানিফ মোহাম্মদও ৫০০ রান করে ফেলতে পারতেন। তিনি তার নিজের জবানিতে বহুবার আক্ষেপ করে বলেছেন, স্কোরাররা স্কোরবোর্ড আপডেট করতে দেরি করেছিল। আমার ধারণা ছিল আমার স্কোর ৪৯৬ কিংবা ৪৯৭। তখন তৃতীয় দিনের খেলা প্রায় শেষের দিকে। আমি চাইছিলাম ঐ দুই বলের মধ্যে ৫০০ করে ফেলতে । তাই পয়েন্টে ঠেলে ডাবলস নিতে গিয়ে আর জায়গামত ফিরতে পারিনি। এক থেকে দেড় গজ দূরে থাকতেই কিপার পয়েন্ট ফিল্ডারের থ্রো গ্লাভসে নিয়ে বেলস তুলে আমার ইনিংসটির ইতি ঘটান।
মাত্র ১ রানের আক্ষেপ নিয়ে রানআউট হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় হানিফ মোহাম্মদকে। তার সেই ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভাঙতে সময় লেগেছিল ৩৫ বছর। আর ব্রায়ান লারার ৫০১ এখনও ২৫ বছর ধরে বহাল।
এতক্ষণ লারার সাফল্যে মোড়ানো এজবাস্টনের কথা বলা হলো। এই মাঠের আরও স্মরণীয় ঘটনা আছে। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার ঘটনাবহুল বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হয়েছিল এই মাঠে। যেখানে শেষ বলে রানআউট হয়েছিলেন অ্যালান ডোনাল্ড, ল্যান্স ক্লুজনার ছিলেন তার সাথী। জিততে মাত্র ১টি রান দরকার ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড আর ক্লুজনার প্রান্ত বদল করতে পারেননি। ম্যাচ টাই হয়ে যায়, অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ফাইনালে।
এছাড়া ২০১৩ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল হয়েছে এই এজবাস্টনে। পরে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার প্রথম দিবারাত্রির টেষ্ট ম্যাচটিরও ভেন্যু এই এজবাস্টন। সেই মাঠে টিম বাংলাদেশের প্র্যাকটিস ছাড়া এক ঘন্টা সময় কাটানোর স্মৃতি মনে থাকবে বহুদিন।
আর একটি কথা কানে কানে বলি, দুই নামী ও দেশবরেণ্য সাংবাদিক উৎপল শুভ্র আর শহিদুল আজম এবং বন্ধু প্রতিম অঘোর মন্ডলের সঙ্গে সেই ৯৯’র ঘটনাবহুল টাই সেমিফাইনাল ম্যচটি মাঠে বসেই দেখেছিলাম।
এআরবি/এসএএস/এমএস