সব লক্ষ্য-পরিকল্পনা সফল না হলেও ২৬২ কিন্তু খুব কম নয়!
সব লক্ষ্য পূরণ হয় না, সব পরিকল্পনায় সফলতাও আসে না। তবে আসল কাজ হলো পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণ এবং সেটা করতে হয় পরিবেশ-প্রেক্ষাপট এবং প্রতিপক্ষ দলের শক্তি-সামর্থ্য বুঝে। সাউদাম্পটনের রোজ বোলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশও অনেক ভেবে-চিন্তে ‘গেম প্ল্যান’ সাজিয়েছিল। সেই পরিকল্পনা যে খুব বেশি সফল হয়েছে, তা বলার উপায় নেই।
আফগান বোলিংকে খানিক এলোমেলো করতে যে সব পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই সফল হয়নি। তারপরও আবহাওয়া, মাঠ আর উইকেট-সব কিছুকে বিচার -বিবেচনায় আনলে টস হারা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে ইনিংস শেষ করলো- তা মোটেই খারাপ বা কম নয়।
মেঘে ঢাকা আকাশ, স্লথ গতি ও দ্বৈত গতি এবং বাউন্সি পিচে ২৬২ রান কম নয় মোটেই। বরং যথেষ্ট লড়াকু পুঁজি বলেই ভাবা হচ্ছে। নামী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত টিম বাংলাদেশ যেখানে গিয়ে থামলো, দলকে ততদূর নিয়ে আসার মূল কাজটি করেছেন মুশফিকুর রহীম। তিন নম্বরে সাকিব আবারো পঞ্চাশের ঘরে পা রেখে প্রাথমিক কাজ করে দিলেও চার নম্বরে নামা মুশফিক একদিক আগলে রাখার পাশাপাশি প্রানপণ চেষ্টা করেছেন দলকে আড়াই'শ পার করে দিতে। শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে থাকতে না পারলেও টাইগার দলের উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান ৮৭ বলে ৮৩ রানের এক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন।
যদিও বাংলাদেশ আড়াই'শ পার করে ইনিংসের শেষ দিকে এসে মোসাদ্দেকের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে। ১৪৫.৫৩ স্ট্রাইকরেটে তার ২৪ বলে ৩৫ রানের ঝড়ো ইনিংসটিই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ২৬০‘র ঘরে নিয়ে যায়।
এর আগে, অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা আর কোচ স্টিভ রোডস অনেক ভেবে চিন্তেই উদ্বোধনী জুটিতে পরিবর্তন আনলেন। দুই বাঁহাতি তামিম-সৌম্যর উদ্বোধনী জুটি ভেঙে, তামিমের সঙ্গী বানানো হলো লিটন দাসকে। বোঝাই গেল, দুই বাঁহাতির বদলে ডান-বাম কম্বিনেশন আনতে দলের এই সিদ্ধান্ত। দুই বাঁহাতি থাকলে হয়ত দুই অফস্পিনার মুজিব উর রহমান আর মোহাম্মদ নবী দু দিক থেকে চেপে ধরতে পারেন শুরু থেকে। আর একজন ডান হাতি হওয়ায় হয়ত তা হবেনা। হয়নিও। আর বাঁহাতি সৌম্যকে ওপেনিং বাদ দিয়ে নিচে পাঠানোর আরও একটা কারণও নিশ্চয়ই ছিল। তা হলো লেগ স্পিনার রশিদ খানকে ঠেকানো। ওপরে তামিম তারপর বাঁহাতি সাকিব আর মাঝখানে সৌম্য তিন বাঁহাতির যেকোনো একজন উইকেটে থাকা মানেই রশিদ খানের জেঁকে বসায় বাধা।
পরিকল্পনা মন্দ ছিলনা। কিন্তু সে পরিকল্পনার বাস্তব রুপটা হয়নি তেমন। ডান হাতি লিটন উইকেটের পেস ও ম্যুভমেন্ট ঠিক মত না বুঝে অফস্পিনার মুজিব উর রহমানের বলে একটু দূর থেকে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। শুরু থেকেই বল একটু থেমে এসেছে। সেখানে ইচ্ছেমত শটস খেলা খুব কঠিন। ড্রাইভ খেলায় বাড়তি ঝুঁকি। সেখানে লিটন স্পিনের বিরুদ্ধে কভার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে ডেকে আনলেন বিপত্তি।
তবে তার ক্যাচ নিয়ে আছে সংশয়। টিভি রিপ্লে দেখেও ঠিক বোঝা যায়নি , ক্যাচটি সঠিক ছিলন কিনা ? একবার মনে হয়েছে বল মাটি স্পর্শ করেছে। আরেকবার মনে হচ্ছে ফিল্ডারের আঙ্গুল মাটিতে লাগলেও বল মাটি স্পর্শ করেনি।
এরপরও হয়ত বাংলাদেশ ৩০০‘র ঘরে যেতে পারতো। পারেনি মুলতঃ দুই আফগান অফস্পিনার মুজিব আর নবীর মাপা আর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের কারণে। বিশেষ করে বাঁহাতিদের বিপক্ষে দুজনই নিখুঁত লাইন ও লেন্থে বল করে হয়েছেন সফল। বাংলাদেশ ব্যাটিং লাইনআপের তিন প্রতিষ্ঠিত বাঁহাতি তামিম, সাকিব আর সৌম্য আউট হয়েছেন দুই অফস্পিনার নবী আর মুজিবের বোলিংয়ে।
তামিম আশা জাগাচ্ছিলেন বড় ইনিংসের। কিন্তু নবীর বল তাকে বোকা বানিয়ে উইকেট ভেঙ্গে দিল। রাউন্ড দ্য উইকেটে যাওয়া নবীর অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে পিচ পড়া ডেলিভারি তামিমকে খানিক বিভ্রান্ত করে বাইরে বেড়িয়ে যাবার বদলে ভিতরে এসে উইকেটে গিয়ে আঘাত হানলে তামিম বোল্ড হয়ে যান।
যেহেতু ৪৮ ঘন্টা আগে এই মাঠে আর এই উইকেটে ভারতের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা আছে, তাই আফগানিস্তানও উইকেটের চরিত্র বুঝে চার স্পেশালিষ্ট ( মুজিব, নবী, রশিদ ও রহমত) স্পিনার নিয়ে মাঠে নেমে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্বচ্ছন্দে-সাবলীল ব্যাট চালনার পথে বাধা হলেন।
শুরুতে বাঁহাতিদের থামাতে বল হাতে শুরু করা আফগান অফস্পিনার মুজিব দুই বাঁহাতি সাকিব আর সৌম্যসহ তিনজনকে ঠিক সাজঘরে ফেরত পাঠিয়েছেন। আফগান বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম (৩৯) রানও উঠেছে তার বলে। তারপরও কোচ স্টিভ রোডস ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উইকেটের আচরণ ও চরিত্র ঠিক মতো বুঝতে না পারলেও সাউদাম্পটনের হ্যাম্পশায়ার বোল (রোজ বললে স্থানীয় লোকজন চেনেন কম, ডাকেনও না তেমন) উইকেট ঠিকই চিনেছিলেন স্টিভ রোডস। গতকাল রোববার খেলার আগে বাংলাদেশ কোচ বলেছিলেন। উইকেট স্লো, বল আসবে দেরিতে। ইচ্ছেমত শটস খেলা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ কোচের এই একটি ধারনা শতভাগ সঠিক। তিনি আগেই বলেছেন, রোজ বোল স্টেডিয়ামের আউটফিল্ড সম্পর্কে আমার খুব পরিষ্কার ধারনা আছে। এই মাঠের আউটফিল্ড অনেক বড়। বড় মানে বিশাল। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বড়। এখানে হাওয়ায় ভাসিয়ে ছক্কা হাকানো হবে খুব কঠিন। আর বাউন্ডারিও হবে কম।
এ মাঠে তার দলের ব্যাটসম্যানদের সম্ভাব্য করণীয় কি হবে, তাও ঠাউরে দিয়েছিলেন রোডস। ব্যাটসম্যানদের প্রতি তার পরামর্শ ছিল, সিঙ্গেলস-ডবলস বেশি নিতে হবে। এবং সীমানার কাছাকাছি গেলেও বল বাউন্ডারি হবে তুলনামুলক কম। এখানে দৌড়ে রান নিতে হবে বেশি করে এবং দেখবেন প্রচুর তিন রানও হবে। তাই হলো। আগের পাঁচ খেলার তুলনায় অনেক কম (১৭ চার ও ১ ছক্কা) বাউন্ডারি হাঁকালেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
অথচ এই দল নটিংহ্যামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঠিক আগের ম্যাচে ৩০ চার ও চার ছক্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩২ চার আর ৪ ছক্কা, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে ২৪৪ রানের মধ্যে ২১ চার আর ১ ছক্কা, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ চার ও ২ ছক্কা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৭ চার ও ৩ ছক্কা হাঁকিয়েছিল।
সেখানে আজ টাইগাররা হাঁকিয়েছেন ১৭ বাউন্ডারি। ব্যাটিং এ্যাপ্রোচ দেখেই বোঝা গেছে ব্যাটসম্যানরা ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করেছেন কম। আর একদম আলগা বা বাজে ডেলিভারি না পেলে বাউন্ডারি হাঁকানোর তাগিদও ছিল কম।
তবে সমস্যা হয়েছে একটাই- বাঁহাতিরা দুই অফস্পিনার নবী আর মুজিব উর রহমানকে স্বচ্ছন্দে খেলে যেতে পারেননি টাইগার ব্যাটসম্যান রা। আর তাদের বিপক্ষে আফগান অধিনায়ক গুলবাদান দুই অফস্পিনারকে খুব ভাল ব্যবহারও করেছেন। তাই বাংলাদেশের রানের চাকা তেমন সচল হয়নি।
জমে যাওয়া তামিম (৫৩ বলে ৩৬) আর আবার এক ম্যাচ পর ফিফটি হাঁকানো সাকিব (৫৯ বলে ৫১) একজন লম্বা ইনিংস খেলতে পারলেই হয়ত এই রানটাই ৩০০‘র আশপাশে কিংবা ৩০০ এর অধিক হতো।
তা না হলেও যা হয়েছে, সেটাও কম না। ভুলে গেলে চলবে না ঠিক ৪৮ ঘন্টা আগের ম্যাচে এই মাঠে একই উইকেটে ২২৪ রানের পুঁজি নিয়েও জিতেছে ভারত। সেখানে ৩৮ রান বেশি পুঁজি বাংলাদেশের। বোলাররা বাড়তি কিছু করার চেষ্টায় না গিয়ে উইকেট সোজা বল করতে পারলে হয়ত এ স্কোরও যথেষ্ট বলে প্রমাণ হতে পারে।
এমন উইকেটে অধিনায়ক মাশরাফি-মোস্তাফিজের দারুণ একটি স্পেল আর সাকিব-মিরাজের মাপা স্পিনই বাংলাদেশকে জয় এনে দিতে পারে।
এআরবি/এমএমআর/এসএস/জেআইএম