ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

‘ফর্মুলা’ ঠিকই জানা ছিল মাশরাফির; কিন্তু বোলিংয়ে প্রয়োগটা হলো না

আরিফুর রহমান বাবু | ট্রেন্টব্রিজ, নটিংহ্যাম থেকে | প্রকাশিত: ০৮:১৫ পিএম, ২০ জুন ২০১৯

‘অস্ট্রেলিয়া কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়। অসিরা ক্যারিবীয়দের মত নন। ভিন্ন আদলে গড়া। মানসিকতা, শারীরিক সক্ষমতা, পেশাদারিত্ব, ব্যাটিং টেকনিক, কৌশল, অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন- সবই ভিন্ন। পেশাদারিত্বে ভরা।

ওয়ার্নার, ফিঞ্চ, উসমান খাজা আর স্টিভেন স্মিথ আর ম্যাক্সওয়েলরা এভিন লুইস, সাই হোপ, হেটমেয়ার নন। তাদের চেয়ে অনেক বেশি পেশাদার। একবার উইকেটে সেট হয়ে গেলে আর সহসা আউট হন না। হতে চান খুব কম। এবং আমাদের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা যে অবস্থায় থেকে ৩২০’র ঘরে আটকে গেছে- অস্ট্রেলিয়ানরা যদি এমন ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে, তাহলে কিন্তু রান সাড়ে তিনশোর ওপরে চলে যাবে।’

ওপরের কথাগুলো মাশরাফি বিন মর্তুজার। গতকাল ১৯ জুন ট্রেন্টব্রিজের কনফারেন্স হলে বসে হল ভর্তি সাংবাদিকদের সামনেই এমন মূল্যায়ন করেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা কেমন? তাদের মেধা-সামর্থ্য, ক্ষমতা, ব্যাটিংয়ের ধরণ এবং অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে তার ধারনা ছিল খুবই পরিষ্কার।

ম্যাচের আগের দিন অসি ব্যাটিং নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মাশরাফি সংবাদ সম্মেলনে বলেই ফেলেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং স্টাইল আর মানসিকতার সাথে অসি উইলোবাজদের ফারাক বিস্তর। টনটনে আমাদের বিপক্ষে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যারা বড় স্কোর গড়েছেন তারা কেউই ইনিংসটাকে টেনে ৫০ ওভার পর্যন্ত নিতে পারেননি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যখন হাত খুলে খেলতে শুরু করেছেন, ঠিক তারপররপরই আউট হয়ে গেছেন; কিন্তু অস্ট্রেলিয়া দলের ওয়ার্নার, স্মিথ এবং ফিঞ্চরা ব্যতিক্রম। তারা কেউ সেট হয়ে গেলে সহজে উইকেট দেন না। চেষ্টা করেন ইনিংসটাকে শেষ বল পর্যন্ত নিয়ে যেতে।’

অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার সেই কথাই সত্য হলো। টনটনে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে তিনজন ব্যাটসম্যান হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তার একজনও সেঞ্চুরি করতে পারেননি। বাঁ-হাতি ওপেনার এভিন লুইস ৬৭ বলে ৭০ করে আউট হয়েছিলেন ঠিক ইনিংসের মাঝামাঝি (২৪.৩ ওভার)। ওয়ান ডাউন সাই হোপ খেলেছেন ৯৬ রানের (১২১ বলে) আরও একটি বড় ইনিংস; কিন্তু তিনিও শেষ করে যেতে পারেননি। আউট হয়েছেন ৪৭ নম্বর ওভারে।

এছাড়া হেটমেয়ারও পঞ্চাশের ঘরে পা রেখে হাফ সেঞ্চুরি পুরণের পরপরই ফিরে গেছেন ২৬ বলে ৫০ রানে। তখনো ইনিংসের বাকি ছিল ৬৩ বল। একইভাবে অধিনায়ক জেসন হোল্ডারও ২২০.০০ স্ট্রাইকরেটে ১৫ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ফিরে যান ইনিংসের ৪৪ নম্বর ওভারে (৪৩.৪ ওভার)। সেটাই পার্থক্য।

অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে বড় ইনিংস খেললেন ডেভিড ওয়ার্নার। আর আসলেন ইনিংস প্রায় শেষ করে। অথচ এই ওয়ার্নার শুরুতে জীবন দিয়েছিলেন। অধিনায়ক মাশরাফির বলে এ ইনফর্ম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারের ক্যাচ ফেলে সাব্বির রহমান। অস্ট্রেলিয়ান ইনিংসের বয়স তখন ৫ ওভার। বোর্ডে রান ২৫। অধিনায়ক মাশরাফির বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলে দিলেন সাব্বির রহমান।

শর্ট অফ স্টাম্পের বাইরে। ওয়ার্নার কাট করেছিলেন, বল চলে গিয়েছিল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে; কিন্তু সাব্বির ডান দিকে ঝাঁপিয়ে দু’হাত লাগিয়েও বল তালুবন্দী করতে পারেননি। ওয়ার্নারের রান তখন ছিল ১০।

সেই জীবন পেয়ে আর থামেননি এ অস্ট্রেলিয়ান। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যান শেষ পর্যন্ত উইকেটে কাটালেন ৪৫ ওভার পর্যন্ত । তারও অনেক আগে শতরান করা ওয়ার্নার যখন সৌম্য সরকারের বলে রুবেলে হাতে শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরের পথে পা বাড়ালেন, ততক্ষণে তার নামের পাশে জমা পড়েছে ১৬৭ রানের ‘বিগ ইনিংস’ (১১২.৯২ স্ট্রাইকরেটে ১৪৭ বলে)।

তার ওপেনিং পার্টনার ফিঞ্চ অবশ্য পঞ্চাশ পূরণের পর (৫১ বলে ৫৩ করে ২০.৫ ওভারে সৌম্যর বলে) আউট হয়ে গেলেও ওয়ান ডাউন উসমান খাজা ঠিক ওয়ার্নারের পথেই হাটলেন। শুরুতে ধরে খেলে ধীরে ধীরে গতি বাড়ালেন এ বাঁ-হাতি। তারপর উইকেটে কাটিয়ে গেলেন ৪৭ ওভার পর্যন্ত। খেললেন ৮৯ রানের আরও এক বড়-সড় ইনিংস (৭২ বলে)।

আর শেষে ম্যাক্সওয়েলের ব্যাট থেকে আসলো ১০ বলে ৩২ রানের হ্যারিক্যান ইনিংস। আগের ম্যাচে লুইস, সাই হোপ আর হেটমেয়ার তিনজনের ফিফটির পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আটকে রাখা গেছে ৩২১ রানে। আজও অজিদের তিন ব্যাটসম্যান ফিঞ্চ (৫৩), ওয়ার্নার (১৬৭) আর ওসমান খাজা (৮৯) পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছেন।

পার্থক্য একটাই- ওয়ার্নার একাই দেড়শো পার করে গেছেন। আর খাজাও অনেক বড় ইনিংস খেলেছেন। আর তাইতো বৃষ্টির কারণে এক ওভার আগেই অস্ট্রেলিয়ার রান ৩৬৮/৫।

এই যে সুযোগ পেলে এবং উইকেটে সেট হয়ে গেলে আর বাজে শট না খেলে এবং অতি মাত্রায় উচ্চাভিলাসি শট না খেলে শতভাগ পেশাদার মানসিকতায় ইনিংস সাজানো এবং সামনে আগানোর মানসিকতা, ক্লিনিক্যাল অ্যাপ্রোচ- তার সামনেই অকেজো হয়েছে বাংলাদেশের বোলিং।

BD-Team-1

অজিদের ব্যাটিং ক্যারিশমা ঠিকই জানা ছিল টাইগার অধিনায়কের; কিন্তু বোলিংয়ে তার বাস্তব প্রয়োগটা হলো না। এ যেন ‘ফর্মুলা জেনেও যোগ- বিয়োগে ভুল করা।’

স্পেশালিস্ট বোলারের একজনও অজি উইলোবাজদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারলেন না। পিঠের ব্যাথায় খেলতে না পারা সাইফউদ্দীনের জায়গায় সুযোগ পাওয়া রুবেল সবচেয়ে মার খেলেন। লাইন-লেন্থের বালাই ছিল না। কখনো অফ স্ট্যাম্পের আবার কোন সময় লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে বল ফেলেছেন রুবেল। তিনটি ওয়াইড ডেলিভারিও হয়েছে। তার ৯ ওভারে রান উঠলো ৮৩।

মাশরাফি আর মোস্তাফিজের শুরুটা ভাল ছিল। দু’জনই কোনোরকম পরীক্ষা না চালিয়ে যতটা সম্ভব উইকেট সোজা এবং ভাল লাইন ও লেন্থে বল করেছেন। আর যাই হোক তাদের বোলিংয়ে ঝড়ো সূচনা করতে পারেনি অজিরা। অজি ইনিংসের প্রথম দিকে মনে হচ্ছিলো হয়ত রান পাহাড় গড়া হবে না ফিঞ্চ বাহিনীর।

কিন্তু ১০ রানে জীবন পাওয়া ওয়ার্নার আর ফিঞ্চ মাশরাফি আর মোস্তাফিজের মাপা ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রথম স্পেলটা সতর্ক- সাবধানে বলের মেধা ও গুনাগুণ বিচার করে আলগা ডেলিভারিগুলোকে স্কোরিং শটে রুপান্তরিত করে অবস্থা বদলে দেন।

অধিনায়ক মাশরাফি প্রথম স্পেলে ৬ ওভারে ৩১ রান দিলেও অন্তত বার দুয়েক উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছেন। তার বলে ওয়ার্নার শুরুর দিকে প্লেইড হতে যাচ্ছিলেন প্রায়। কিন্তু পরের দিকে খেই হারিয়ে ফেলেন। পরের দুই ওভারে দিয়ে ফেলেন ২৫ রান।

মোস্তাফিজও প্রায় তাই। প্রথম স্পেলে ৪ ওভারে ২১ রান দেয়া এ বাঁ-হাতি পরের ৪ ওভারে দিয়ে বসেন ৩৫ রান। সুবিধা করতে পারেননি দুই স্পিনার সাকিব (৬ ওভারে ০/৫০) আর মিরাজ (১০ ওভারে ০/৫৯)।

যা করার করেছেন কেবলমাত্র সৌম্য সরকার। স্পেশালিস্ট বোলারদের অনুজ্জ্বলতায় নিজে বল হাতে জ্বলে উঠেছেন এ অকেশনাল জেন্টল মিডিয়াম পেসার। উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গা ছাড়াও ৮ ওভারে ৫৬ রানে ৩ উইকেটের পতনও ঘটিয়েছেন সৌম্য।

জেন্টল মিডিয়াম পেসার সৌম্যর কার্যকরিতায় এক কঠিন সত্য ফুটে উঠলো। আয়ারল্যান্ডে নিয়ে গিয়েও মিডিয়াম পেসার ফরহাদ রেজাকে ব্যবহার না করে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। এই সব ব্যাটিং স্বর্গে একটু কম পেসার বোলাররা গতি ও লাইন-লেন্থে বৈচিত্র্য আনতে পারলে সফল হন- সৌম্যর তিন উইকেট তারই দলিল।

আসলে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের স্বচ্ছন্দ ব্যাট চালনায় বাধা না হলেও কম গতিতে ভাল জায়গায় বল করতে পারা পেসারদের কার্যকরিতার সম্ভাবনা বেশি। সেটা কার্ডিফে ইংল্যান্ডের সাথেও বোঝা গেছে। আজও তাই দেখা গেল।

আরও একবার প্রমাণ হলো, দলে একজন রিস্ট স্পিনারের বিশেষ প্রয়োজন। পেসাররা ভাল না করলে ব্রেক থ্রু দিতে সাকিব-মিরাজই ভরসা; কিন্তু অষ্ট্রেলিয়ার মত দল যে তাদের জেনে, বুঝে ও বল মেপে খেলে কাটিয়ে দিবেন- তা ভাবাও যে জরুরি।

এআরবি/আইএইচএস/এমকেএইচ

আরও পড়ুন