পতাকা আঁকা অন্তরে ক্রিকেটের আবাহন
ঢাকার যে রাস্তা দিয়েই হাঁটুন, সবখানেই রিকশার জঙ্গল আর থমকে থাকা গাড়ির সারি। সঙ্গে পথ চলতি মানুষের স্রোত। রিকশার টুংটাং, নানারকম গাড়ির বিচিত্র হর্নের শব্দ মিলিয়ে অদ্ভুত ক্যাকোফোনি। কোনো বিপণিবিতানের সামনে গেলে তো কথাই নেই। যানজট আর মনুষ্যজটে বিরক্তির এক শেষ। ঈদ এসে গেছে। কেনাকাটার ধুম লেগেছে। এর মধ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উত্তেজনা খুঁজতে যাবেন না। এর মধ্যে ক্রিকেট নেই। আছে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতি। এ দেশের মানুষের চিরকালীন ঘরমুখো ছোটাছুটির ছবি।
কোথাও কি উড়তে দেখেছেন প্রিয় লাল-সবুজ পতাকা? আমি অন্তত ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ দিয়ে আজ শুরু বিশ্বকাপের আগে কোনো বাড়ি বা ভবনের সামনে কিংবা ছাদে জাতীয় পতাকার উত্তোলন দেখিনি। অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের দেশজ আবেগের নদীতে কীভাবে যে ঢেউ তোলে, বর্ণনাতীত। এক মাস আগে থেকেই বাড়ির ছাদে কিংবা আঙিনায় আর্জেন্টিনা–ব্রাজিলের পতাকা তোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের দেশ কিন্তু খেলে না, কোন অনাগত কালে, অন্যভাবে বলা যায়, কোন আলোকবর্ষ দূরে খেলবে জানি না। সত্যি সেলুকাস বড় বিচিত্র এই দেশ!
তবে কি বিশ্বকাপ ক্রিকেট, যেখানে আমাদের ১৬ কোাটি মানুষের আবেগ মেখে খেলতে গেছে বাংলাদেশ দল, মাশরাফি বিন মর্তুজা বাহিনী, একেবারেই টানছে না! টানছে, টানছে। ওপরে দেখনদারি নেই, ভেতরে বয়ে চলেছে আবেগের স্রোত। পতাকার ওড়াউড়ি আর কী বলবে যখন শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বেজে চলে বিশ্বকাপের সংগীত। চায়ের কাপে ঝড় কিন্তু উঠছে, টিভি সেট সামনে নিয়ে ড্রয়িংরুমের আড্ডায় ক্রিকেট রং ছড়াচ্ছে।
স্বপ্ন আঁকছে মানুষের মন। কেউ অবশ্য মাশরাফি, সাকিব, তামিম, সাকিবদের দিব্যি দিয়ে বলেনি বিশ্বকাপের ষষ্ঠ যাত্রায় কাপটা তোমাদের আনতে হবে। শুধু মনের মধ্যে আবেগের রঙয়ে আঁকা স্বপ্নটা বর্ণিল হয়ে পৌঁছে গেছে একটি প্রত্যাশার চৌহদ্দিতে। সেটি কম করে হলেও শেষ চার অর্থাৎ সেমিফাইনাল।
চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে থাকা মাশরাফিরা যদি প্রবল পরাক্রমে কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারেন, এবার আরেকটি সিঁড়ি ভাঙা কেন নয়? বিশেষ করে বাংলাদেশ দল যখন ওই বিশ্বকাপের পরের এই চার বছরে নিজেদের ক্রিকেটের সংজ্ঞাটাই যখন বদলে দিয়েছে, বড় বড় দলকে নিজেদের ডেরায় হোক বা নিরপেক্ষ মাঠে, হারিয়েছে পরিণত ক্রিকেটে খেলে। সুতরাং অঙ্ক বলুন, সাধারণ বোধ বলুন, সেমিফাইনালের প্রত্যাশাটা অমূলক নয়।
সেদিন এক সেলুনে গিয়ে টের পেলাম ক্রিকেটটা কেমন অন্তঃসলিলা এখন আমজনতার মনে। তরুণ ক্ষৌরকর্মীটি যুক্তি–বুদ্ধির শানিত তরবারি দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিপক্ষকে এফোঁড়–ওফোঁড় করে ফেললেন। সেই তরবারির নিচে প্রথম সারিতে বাংলাদেশের নিচের র্যাঙ্কিংয়ের তিন দল- আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কা।
দ্বিতীয় সারিতে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। নিউজিল্যান্ড নিজের মাটিতে যতই অন্য গ্রহের দল হয়ে থাকুক না কেন, তারাও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে অবধ্য নয়। আফগানিস্তান কেন বাংলাদেশের সঙ্গে পারবে না? সহজ হিসেব, তারা ‘ছোট ভাই’।
শ্রীলঙ্কা পারবে না, কারণ দলটি শ্রীলঙ্কান ইতিহাসের নিকৃষ্টতম। কদিন আগেই আয়ারল্যান্ডে তিন তিনবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথম কোনো তিন দলীয় টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে বাংলাদেশ দেখিয়েছে, ক্রিকেট বোদ্ধারা যতই ক্যারিবীয়দের ‘কালো ঘোড়া’ বলুক, ওরা পারবে না। পাকিস্তানের সঙ্গেও জয়টা বাঁধা, কারণ সর্বশেষ দুই ম্যাচে তাদের পরিষ্কার ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাদেশ নিজেদের ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে।
বাকি থাকল দক্ষিণ আফ্রিকা। ওরা তো ‘চোকার’, চেপে ধরলে পালিয়ে যায়। ২০০৭ বিশ্বকাপে যেভাবে প্রোটিয়াদের হারিয়েছিল বাংলাদেশ, এবারো তাদের সেই পরিণতি হবে। নয়টি ম্যাচের পাঁচটি জিতলে নিশ্চিত, বৃষ্টির অনিশ্চয়তায় চার জয়েও হাতে এসে যেতে পারে সেমিফাইনালের প্রবেশাধিকার। আলোচ্য ক্ষৌরকর্মী বাংলাদেশের জয় দেখছেন ছয় ম্যাচে। সুতরাং শেষ চার আটকায় কে?
তেল, ডাল ও মশলা কিনতে কারওয়ানবাজারের যে মুদি দোকানে যেতে হয় প্রায়ই, সেই দোকানদারও লিগ পর্বে পাঁচটি জয় দেখছেন এবং বাংলাদেশকে দেখছেন ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে। মোট কথা, ক্রিকেটের আবেগটা আর বাইরে দেখানোর বিষয় হয়ে নেই, ওটা এখন যুক্তি–বুদ্ধিতে অন্তরের উপলব্ধি। সে জন্যই পতাকা উড়ছে না। হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার নেই। কেমন যেন নীরবতার মধ্যে ফুটে আছে আকাঙ্ক্ষার বর্ণময়তা।
আরেকটি জিনিসও খুব ভালো লাগছে, সেমিফাইনালে যেতে না পারলে তোমাদের মুণ্ডুপাত হবে, মাশরাফিদের নিয়ে এমন উন্মত্ত প্রত্যাশার চাপ দেখছি না জনতার মধ্যে। সেমিফাইনালে যেতে পারলে ভালো লাগবে, না যেতে পারলেও পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে না— আপাতত এমনই একটি আবহ দেখছি মানুষের মনোজগতে। এটাই আসলে ক্রিকেটারদের সেরাটা খেলতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, লাল–সবুজ গায়ে মেখে বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এতটুকু লড়াই ছাড়ে না। প্রত্যেকেই চায় নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দিতে।
যে দলটি এবার ইংল্যান্ডে খেলতে গেছে, তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা। সোনা পুড়ে পুড়ে যেমন খাঁটি হয়, এই দলটির পাঁচজন খেলোয়াড়ও সেভাবে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন। মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম ও মাহমুদউল্লাহ মিলিতভাবে খেলেছেন ৯৮০টি ওয়ানডে ম্যাচ।
তবে গড় বয়সে মাশরাফির দলটি আবার তৃতীয় তরুণতম দল। এই তরুণ দলটিই কিন্তু এই বিশ্বকাপে দ্বিতীয় অভিজ্ঞতম দল, গড়ে ৯০টি করে ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের নিয়ে অবস্থান ভারতের পরেই। সঙ্গে আছে তারুণ্যের স্পর্ধিত অহঙ্কার।
সম্প্রতি যা সামর্থ্যের সীমাকে অস্বীকার করেনি। সব মিলিয়েই তাই দেশের ক্রিকেট রোমান্টিকেরা স্বপ্ন আঁকছে। ভরসা তাদের মাশরাফির অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বে, ভরসা পঞ্চপাণ্ডবে। ভরসা আছে সৌম্য–মোস্তাফিজ–লিটন–মোসাদ্দেকের তারুণ্যদীপ্ত লড়াইয়ে।
বাইরে লাল–সবুজ পতাকা ওড়ার দরকার নেই। ওটা তো উড়ছে অন্তরে। লাল–সবুজের উদ্দীপনাতেই আর দুদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মাশরাফিদের ২০১৯ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে চোখ রাখবে ক্রিকেট জনতা।
বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক
আইএইচএস/পিআর