বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সাহসী বাংলাদেশ
দুই যুগ আগেও কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলবে? ভাবলেও তা ছিল স্রেফে কল্পনায়, কাব্যে বা চিত্রকলায়। আইসিসি ট্রফি নামক হাড়িকাঠে বার বার বলি হতে হতে হতোদ্যম হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। এক ধরনের হতাশায়ও পেয়ে বসে ক্রিকেটানুরাগীদের। মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ক্রিকেটের আকাশ।
১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মেঘ কেটে বৃষ্টি নামলেও এক পর্যায়ে তা হয়ে ওঠে কুজ্ঝটিকা। সেই কুহেলিকায় সেবারও কূলে গিয়ে তরী ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচটি বৃষ্টির জলে আর চোখের জলে হাতছাড়া হয়ে যায়।
যে কারণে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে পরের ম্যাচটি হয়ে উঠে বাঁচা-মরার তীব্র এক লড়াই। সেদিন এক পর্যায়ে প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, আবারও কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে নেদারল্যান্ডস? ক্রিকেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নয় ফুটবলের দেশটি।
বরং ১৯৯৪ সালে নাইরোবিতে আইসিসি ট্রফির মুখোমুখিতেও তাদের কাছে হারতে হয়। বাংলাদেশের আগেই বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলেছে ইউরোপীয় দেশটি। এমন একটি ক্রিকেট শক্তিকে হালকাচালে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার পথে ওলন্দাজ দেশটি বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এটাও সহ্য করা যাচ্ছিল না। ক্রিকেটীয় আবেগের দিক দিয়ে তো তাদের চেয়ে ঢের ঢের এগিয়ে এ দেশটি।
১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল কুয়ালালামপুরের রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে টস জিতে নেদারল্যান্ডসকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। দুরন্ত ফিল্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ১৭১ রানে গুটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের হৃদয়ে কী অনুভূতি হয়েছিল, বলতে পারবো না; কিন্তু ব্যাট করতে নেমে আতাহার আলী খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, সানোয়ার হোসেন ও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের হারাকিরিতে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৫ রানে ৪ উইকেট।
অধিনায়ক আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ক্রিজে থাকার সময় নানান রকম সমীকরণের দোলায় দুলতে থাকে বাংলাদেশ। প্রকৃত অর্থেই কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি। সে সময় একবার মন চেয়েছে মেঘলা আকাশ তুমুল বৃষ্টি হয়ে ঝরুক। বুকের মধ্যে বাজতে থাকুক লতা মঙ্গেশকার, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি/ বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি কেন এত তুমি মিষ্টি।’
আবার কখনও মান্না দে’র মতো কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে।’ এমন দ্বিধা-দ্বন্ধের কারণ, সেমিফাইনালে উঠার হিসেবের অঙ্ক মেলানো যাচ্ছিল না। যথারীতি এর প্রভাব পড়ছিল খেলায়। যখন জানা যায়, জয় ছাড়া গত্যন্তর নেই, তখন সত্যিই আতান্তরে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
ডাকওয়ার্থ-লুইস নামক কিম্ভূত বৃষ্টি আইনের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশের সামনে টার্গেট ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। এ স্কোরকে মনে হতে থাকে পাহাড়সম। আকরাম খান ছাড়া প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানরা তখন অস্তাচলে। নান্নু অবশ্য অনেকটা সময় সঙ্গ দিলেও শেষ অব্দি থাকতে পারেননি। অন্তরঙ্গ বন্ধু নান্নু চলে যাওয়ার পর তার বুকের মধ্যে বোধকরি গুঞ্জরিত হচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।’
এছাড়া তো তখন আর কিছু করার ছিল না। তবে তার সামনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে একে একে ১৭ রানের মধ্যে ফিরে যান সুনিল গাভাস্কার, কৃষ্ণামাচারি শ্রীকান্ত, মহিন্দর অমরনাথ, সন্দীপ পাতিল, যশপাল শর্মা। সেদিন কপিল দেব ১৭৫ রানের ইতিহাসখ্যাত অপরাজেয় যে ইনিংসটি খেলেন, তার উপর ভর করে প্রথমবার বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে ভারত।
অবশ্য কপিল দেবের চেয়ে আকরাম খানের চ্যালেঞ্জটা ছিল আরো বেশি। কপিল তো প্রথম ইনিংসে ব্যাট করেন। আর আকরাম তো বেঁধে দেওয়া টার্গেটের সামনে এক ধরনের মৃত্যুকূপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয় এসপার নয় ওসপার। এমন অবস্থায় একটি জাতির স্বপ্ন-কল্পনার পরিপূরণে আকরাম হয়ে ওঠেন এক মহামানব।
তার অপরাজেয় ৬৮ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন পথ দেখায়। এরপর তো সেমিফাইনালে সহজেই স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে স্বপ্নের বিশ্বকাপে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। আর বৃষ্টিবিঘ্নিত ঘটনাবহুল ও রোমাঞ্চকর ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে শিরোপা জয় করে পুরো জাতিকে বাংলা নববর্ষের রঙে রাঙিয়ে দেয় অপরাজেয় বাংলাদেশ; কিন্তু আকরাম খান বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বুকে আত্মবিশ্বাস আর সাহসের যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, সেই ধারায় এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
এরই ধারাবাহিকতায় ওয়ানডে এবং টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের সামনে উম্মুক্ত হয়ে যায় ক্রিকেটের মহাপৃথিবী। বিগত দুই দশকের সবটাই তো আনন্দের স্মৃতি নয়। তাতে অনেক অবজ্ঞা আছে। অসম্মান আছে। আছে অপমানও। তারপরেও ক্রিকেটাররা অন্তরের মধ্যে একটা মন্ত্র লালন করে এসেছেন, ‘পরাজয়ে ডরে না বীর’।
ধাক্কা খেতে খেতে এখন অনেকটাই সাবালক হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কষ্ট, গ্লানি, যন্ত্রণা থাকলেও আছে গৌরব, মহিমা ও মর্যাদা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরেও বাংলাদেশের অনেক অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছে।
১৯৯৯ সাল থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলে আসছে বাংলাদেশ। এরইমধ্যে পাড়ি দিয়ে এসেছে পাঁচটি বিশ্বকাপ। তাতে অগৌরব থাকলেও আছে অনেক বেশি অহংকার। প্রতিটি বিশ্বকাপেই চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডে প্রথমবার স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়ে ঝলকানি দেখালেও ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় পুরোপুরি অনুজ্জ্বল হয়ে থাকে।
২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারত, বারমুডা ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে কাঁপিয়ে দেয়। ২০১১ সালে নিজের মাঠে আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসকে হারালেও রান রেটের কারণে কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলতে পারেনি। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলার গৌরব অর্জন করে। দীর্ঘদিন পর ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ খেলবে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের পরের ধাপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাটা নিশ্চয় অমূলক নয়।
আইসিসি ট্রফিতে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে সাহসী হয়ে উঠে বাংলাদেশ। একদিন ঠিকই বীরের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ঠোকর খেতে খেতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। সাহসও বেড়েছে। কোনো প্রতিপক্ষই আর অভেদ্য নয়। যে কারণে এখন আর বাংলাদেশকে কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সাহস পায় না।
আর বিশ্বকাপে তো বাংলাদেশ কখনই হেলাফেলার দল নয়। একটি ছাড়া প্রতিটি বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ তার শৌর্য্য-বীর্যের প্রকাশ দেখিয়েছে। আর এবারের বিশ্বকাপ অনেক বেশি সাহসী এক বাংলাদেশকে দেখার অপেক্ষায় আছে।
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সুখকর তো বটেই, কিন্তু প্রতিটি ম্যাচে ক্রিকেটাররা যেভাবে খেলেছেন, তাতে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী এক বাংলাদেশকে দেখতে পেয়েছে ক্রিকেটবিশ্ব। আশা করা যায়, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সেই ধারাটাই অব্যাহত থাকবে।
লেখক : সম্পাদক, ক্রীড়া জগত
আইএইচএস/পিআর