বিশ্বকাপের ফাইনালের নায়ক যারা
দরজায় কড়া নাড়ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে দ্বাদশ বিশ্বকাপের পর্দা উঠতে বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। এদিকে বিশ্বকাপের এই ডামাডোলের মধ্যে ক্রিকেট পাগল মানুষও উদগ্রিব হয়ে আছে আরও একটি মহাযজ্ঞের অংশীদার হওয়ার। সে সঙ্গে তাদের মনে কৌতূহলেরও শেষ নেই বিশ্বকাপের আগের আসরগুলোর বিভিন্ন রেকর্ড আর ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো জানবার।
জাগো নিউজের অসংখ্য বিশ্বকাপ স্পেশালের মতো এবারে পাঠকদের জন্য থাকছে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পাওয়া ক্রিকেটারদের নাম ও সে সকল পারফরম্যান্সের কথা...।
ক্লাইভ লয়েড, ১৯৭৫ বিশ্বকাপ
ইংল্যান্ডে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। প্রুডেন্সিয়াল প্রাইভেট লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় টুর্নামেন্টটি আয়োজিত হওয়ার কারণে এর নাম দেয়া হয়- প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপ। প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ক্লাইভ লয়েডের তৎকালীন অপ্রতিরোধ্য দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর প্রথম বিশ্বকাপ জিততে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন ক্লাইভ।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ব্যাট হাতে মাত্র ৮৫ বলে ১০২ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলেন ক্লাইভ লয়েড। এরপর বল হাতে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান ডগ ওয়াল্টারস ও দলীয় অধিনায়ক ভয়ঙ্কর হতে থাকা ইয়ান চ্যাপেলকে ব্যক্তিগত ৬২ রানে রানআউট করে ম্যাচের মোড়ই ঘুরিয়ে দেন ক্যারিবীয় কিং। ফলে ফাইনাল জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে তোলেন ক্লাইভ লয়েড।
ভিভ রিচার্ডস, ১৯৭৯ বিশ্বকাপ
১৯৭৫ এরপর ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপও জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে বিশ্বসেরার শিরোপা হাতে তোলে ক্যারিবীয়রা। ফাইনালে ইংলিশদের বিপক্ষে টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ওভার (৬০) শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৮৬ রান।
থ্রি-লায়ন্সদের বিপক্ষে একাই ১৩৮ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। এরপর জোয়েল গারনার, কলিন ক্রফটদের বোলিং তোপে মাত্র ১৯৪ রানেই গুটিয়ে যায় মার্ক ব্রেয়ারলির দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তি গারনার ম্যাচে ৫ উইকেট পেলেও, রিচার্ডস ১৩৮ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলার কারণে তার হাতেই তুলে দেয়া হয় ফাইনাল সেরার অ্যাওয়ার্ড।
মহিন্দর অমরনাথ, ১৯৮৩ বিশ্বকাপ
তৃতীয় প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপও অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে। বরাবরের মতো সবাইকে পেছনে ফেলে ৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠে যায় ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে উঠে বিশ্বকে চমকে দেয়া ভারত।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেয় তারা আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৮৩ রানে গুটিয়ে যায় ভারত। জবাব দিতে নেমে ক্যারিবীয়রা সেদিন দাঁড়াতেই পারেনি ভারতের বোলারদের সামনে।
প্রথমে মদন লাল ও পরে মহিন্দর অমরনাথের বোলিং তোপে দিশেহারা হয়ে মাত্র ১৪০ রানের মধ্যে অলআউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মদন লাল নেন ৩ উইকেট আর ৭ ওভারে মাত্র ১২ রান খরচায় ৩ উইকেট শিকার করেন অমরনাথ। এর আগে, ব্যাট হাতে দলের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৬ রান করায় ম্যাচ সেরার পুরস্কার ওঠে অমরনাথের হাতে।
ডেভিড বুন, ১৯৮৭ বিশ্বকাপ
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া তাদের ইতিহাসে প্রথম ফাইনাল খেলে ১৯৮৭ ভারত বিশ্বকাপে। দ্বিতীয়বারেরমত ফাইনাল খেলতে নেমে বাজিমাত করে ক্যাঙ্গারুরা।
কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টসে জিতে আগে ব্যাট করে অসিরা। ডেভিড বুনের ইনিংস সেরা ৭৫ রানের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৫৩ রান।
জবাব দিতে নেমে জয়ের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায় ইংলিশরা। তবে শেষতক ৭ রানের আক্ষেপে পুড়তে হয় তাদের। বলা হয়, বুনের ওই ইনিংসটি গ্লুর মতো অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসটিকে বেঁধে রেখেছিল বিদায় সেদিন আড়াই’শ পেরোতে পেরেছিল অসিরা। তাই ম্যাচ সেরার পুরস্কারও তুলে দেয়া হয় ওপেনার বুনের হাতে।
ওয়াসিম আকরাম, ১৯৯২ বিশ্বকাপ
১৯৯২ বিশ্বকাপে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। তবে আগের আসরগুলোর মতো এবারও বিশ্বকাপ জয়ের আশাভঙ্গ হয় তাদের। এবার তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে পাকিস্তান।
অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইমরান খানের নেতৃত্বে আন্ডারডগ হয়ে বিশ্বকাপে খেলতে আসলেও ফাইনালে উঠে যায় পাকিস্তান। ফাইনালে নিজেদেরকে আনপ্রেডিক্টেবল প্রমাণ করে পাকিস্তান।
টস জিতে আগে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ২৪৯ রান তোলার পর থ্রি লায়ন্সদের ২২৭ রানের মধ্যে আটকে দিয়ে বাজিমাত করে ইমরান খানের দল।
এদিকে পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট হাতে মাত্র ১৮ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ক্যামিও খেলার পর বল হাতেও ফাইনালে নিজেকে বেশ সফল প্রমাণ করেন ওয়াসিম আকরাম। ৪৯ রান খরচায় ৩ উইকেট তুলে নিয়ে ব্যাটে-বলে দারুণ পাররম্যান্সের সুবাদে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও তাই হাতে তোলেন ওয়াসিম।
অরভিন্দ ডি সিলভা, ১৯৯৬ বিশ্বকাপ
১৯৮৭ বিশ্বকাপের পর দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে ভারত-পাকিস্তানের পর এশিয়ার তৃতীয় দল হিসেবে ৯৬ ফাইনাল খেলে শ্রীলঙ্কা। আগের আসরগুলোর মতো এশিয়ান দল হিসেবে ফাইনালে না হারার রেকর্ড ধরে রাখে লঙ্কানরা।
টসে জেতার পর তৎকালীন লঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়াকে। আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ওভার শেষে ২৪১ রানে থামে অসিদের ইনিংস। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় শ্রীলঙ্কা।
টুর্নামেন্ট সেরা সনাৎ জয়সুরিয়া সেদিন মাত্র ৯ রানে রানআউটের ফাঁদে পা দিলেও, অরভিন্দা ডি সিল্ভার অপরাজিত ১০৭ রানের সুবাদে ম্যাচ জিতে নেয় লঙ্কানরা। ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলার জন্য ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান ডি সিল্ভা।
শেন ওয়ার্ন, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ
এশিয়ার প্রথম দল হিসেবে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠে পাকিস্তান। তবে স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেদিন পাত্তাই পায়নি ওয়াসিম আকরামের দল। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৩২ রানে গুটিয়ে যায় তারা। জবাব দিতে নেমে মাত্র ২০ ওভারেই ফাইনাল জিতে নেয় অসিরা। ৩৩ রানে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে পাকিস্তানকে ধসিয়ে দেয়ায় ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান লেগ স্পিন কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন।
রিকি পন্টিং, ২০০৩ বিশ্বকাপ
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর প্রথম দল হিসেবে ২০০৩ সালে টানা দুটি বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড গড়ে অস্ট্রেলিয়া। রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন দল ফাইনালে ভারতকে একপ্রকারে উড়িয়ে দিয়ে জিতে নেয় বিশ্বকাপ। ম্যাচ সেরা হন দলীয় অধিনায়ক পন্টিংই।
জোহানেসবার্গে আগে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় বোলারদের তুলোধোনা করে স্কোরবোর্ডে ৩৫৯ রানের বিশাল লক্ষ্য দাঁড় করায় অসিরা। পন্টিংয়ের ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ১৪০ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। জবাব দিতে নেমে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত মাত্র ২৩৪ রানেই অলআউট হয়ে যায়।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ২০০৭ বিশ্বকাপ
ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ২০০৭ সালে হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জেতে অস্ট্রেলিয়া। এবারও রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে শিরোপা উল্লাসে মাতে তারা। ৯৬ বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেবারের শিরোপা হাতে তোলে অসিরা। ফাইনালে লঙ্কানদের বিপক্ষে একাই সব হিসেব ওলটপালট করে দেন ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।
ম্যাচে একবার জীবন পেয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফাইনাল ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৪৯ রানের ইনিংসটি খেলেন গিলক্রিস্ট। বৃষ্টি বিঘ্নিত সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া জেতে ৫৩ রানে। আর গিলক্রিস্টের হাতে তুলে দেয়া হয় ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
মহেন্দ্র সিং ধোনি, ২০১১ বিশ্বকাপ
১৯৮৩ বিশ্বকাপের পর আর কখনো শিরোপা জিততে না পারা ভারত দীর্ঘ ২৮ বছর পর ফাইনালে ওঠে ২০১১ বিশ্বকাপে। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ সহযোগী আয়োজক শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ট্রফি জিতেও নেয় তারা।
ফাইনালের নায়ক হন কাপ্তান ধোনিই। শ্রীলঙ্কার দেয়া ২৭৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতেই বীরেন্দর শেবাগ ও শচিন টেন্ডুলকারের উইকেট হারালেও গৌতম গম্ভীরের ৯৭ ও ধোনির ৯১ রানের উপর ভর করে ৬ উইকেট হাতে রেখেই পার করে ফেলে ভারত। গম্ভীর ইনিংস সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেললেও ধোনি ঝড়ো ৯১ রান করায় পান ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
জেমস ফকনার, ২০১৫ বিশ্বকাপ
হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় অস্ট্রেলিয়া। তবে হতাশাকে পাশ কাটিয়ে উঠে ঘরের মাঠে আয়োজিত ২০১৫ বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে ফের বিশ্বমঞ্চের সেরাদের মুকুট মাথায় তোলে অসিরা।
মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে সহযোগী আয়োজক দেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপ জেতে তারা। মেলবোর্নে ফাইনাল ম্যাচে টসে জিতে আগের ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় নিউজিল্যান্ড। তবে মিচেল স্টার্ক, মিচেল জনসন ও জেমস ফকনার এই তিন বাঁহাতির বোলিং তোপে মাত্র ১৮৩ রানের মধ্যেই গুটিয়ে যায় ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল।
জবাব দিতে নেমে অধিনায়ক ক্লার্কের সর্বোচ্চ ৭৪ ও স্টিভ স্মিথের ৫৬ রানের সুবাদে ৭ উইকেট হাতে রেখেই জিতে নেয় স্বাগতিকরা। এদিকে ৩৬ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অলরাউন্ডার ফকনার পান ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
এসএস/আইএইচএস/জেআইএম