ছোট মাঠে সৌম্যর ১৬ ছক্কা নিয়ে বিতর্ক এবং এর সমুচিত জবাব
খুবই দুঃখজনক! আমরা বোধকরি বড্ড বেশি নেতিবাচক আর পরশ্রীকাতর হয়ে গেছি! তাই তো সৌম্য সরকারের রেকর্ড ১৬ ছক্কা হাঁকানো নিয়েও শুরু হয়ে গেছে কটূক্তি! বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান লিস্ট ‘এ’ কেন, আমার জানা মতে কোনো ফরম্যাটের এক ম্যাচে চার হালি ছক্কা হাঁকাননি কখনো। কেউ কোনোদিন এমন অসামান্য কৃতিত্ব দেখাতে পারেন, সে চিন্তাও ছিল না আমাদের।
পুরো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে রান খরায় ভোগা সৌম্য সরকার এ কৃতিত্ব দেখালেন- কোথায় আমরা সে কৃতিত্বের অকুণ্ঠ প্রশংসা করবো, তা না, উল্টো শুরু হয়ে গেছে বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখা। শুরু হয়ে গেছে কটূক্তি। বলা হচ্ছে, বিকেএসপির মাঠ আয়তনে ছোট, বড় মাঠে যেটা সীমানার ধারে ক্যাচ, সেটা এখানে ছক্কা- তাই গণ্ডায় গণ্ডায় ছক্কার রেকর্ড সৌম্যর ব্যাটে। মাঠ বড় থাকলে হয়ত এতগুলো ছক্কা হতো না।
আমি নিশ্চিত, এগুলো যারা বলছেন, তারা না দেখে, না জেনে লিখছেন বা বলছেন। হ্যাঁ, এটা নিশ্চিত বিকেএসপির মাঠ একটু ছোট। কিন্তু কত ছোট? তা কি জানা আছে কারও? তা না জেনে মন্তব্য করা কি ঠিক হবে?
আসুন জেনে নেয়া যাক, আজকের ম্যাচ যে বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে খেলা হয়েছে, তা মোটেই আয়তনে ছোট নয়। বিকেএসপির কিওরেটর নুরুজ্জামান নয়ন জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, আজকের ম্যাচে মাঠের আয়তন মোটেই ছোট ছিল না। আইসিসির নিয়ম-নীতি মেনেই আমরা সীমানা নির্ধারণ করেছি। আজকে উইকেটের সামনে একদিকে ছিল ৭২ গজ। অন্যদিকে ৭৫ গজ। একইভাবে স্কোয়ারে (পাশে) পশ্চিমে ৭২ গজ, পূর্ব দিকে ৭৫ গজ ছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কিওরেটর নুরুজ্জামান নয়ন যে আয়তনের কথা বলেছেন, তা সত্যিই হলে আজকের মাঠ মোটেই শেরে বাংলার চেয়ে ছোট ছিল না। আর তার চেয়ে বড় কথা, নিজ চোখে দেখেছি সৌম্যর ১৬ ছক্কা। হলপ করে বলতে পারি, আজ সৌম্য সরকার যে চার হালি ছক্কা হাঁকিয়েছেন তার অর্ধেকের বেশি (আট থেকে ১০টি) সীমানার অন্তত ১০-১৫ গজ দূরে ছিটকে পড়েছে।
অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি ছক্কা ৯০ গজের বেশি দূরে গিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড প্রান্ত থেকে সৌম্যর হাঁকানো অন্তত চার থেকে পাঁচটি ছক্কা পাশের মাঠে গিয়ে আছড়ে পড়েছে। যে ছক্কার মারগুলো গড়পড়তা ৯৫ গজ দূরে গিয়ে পড়েছে। আর সবচেয়ে ছোট ছক্কাগুলোও গড়ে সীমানার তিন থেকে ৫ গজ দূরে পড়েছে। একটি ছক্কাও একদম সীমানার এক-দুই গজ দূরে গিয়ে পড়েনি। তাই সৌম্যর ১৬ ছক্কার রেকর্ড মাঠ ছোট হবার কারণে হয়েছে এটা মানতে পারছি না।
আরেকটি কথা, ধারণা করা হয়- বিকেএসপির মাঠগুলো পাশে (স্কোয়ারে) ছোট। কিওরেটর নয়ন, ৭২ গজ বললেও কারও কারও মত, সেটা ৬৫ থেকে ৭০ গজের ভেতরে। আর সামনেও ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ গজ। সৌম্য ওই স্কোয়ারে ছক্কা বেশি হাঁকালে কথা ছিল; কিন্তু তাতো নয়।
অনেকেরই জানা, সৌম্যর সবচেয়ে ফেবারিট জোন হলো লং অন, ওয়াইড লং অন আর ডিপ মিড উইকেট থেকে স্কোয়ার লেগ; কিন্তু আজকের ম্যাচে তার ১৬ ছক্কার ১০টিরও বেশি হাঁকিয়েছেন লং অন আর ওয়াইড লং অনের ওপর দিয়ে। তার হাঁকানো ছক্কাগুলোর একটি বা দুটি হয়ত সোজা ব্যাটে, মানে স্ট্রেইট। উইনিং ও ডাবল সেঞ্চুরি পূরণের ছক্কাটিও একদম এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে। আর বাকি ছক্কাগুলো আট থেকে দশটি অবশ্যই লংঅন আর তার ১০/১২ গজ বাঁ-দিকের ওপর দিয়ে চালানো।
একটি মাত্র ছক্কা ছিল ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। স্কোয়ার লেগের আশপাশে একটি ছক্কাও ছিল না। কী করে থাকবে? আজ সৌম্য বেশিরভাগ ছক্কা হাঁকিয়েছেন এক থেকে দুই পা সামনে বেরিয়ে, হাফভলি করে নিয়ে। আর কখনো থ্রি কোয়ার্টার ও ফুললেন্থ ডেলিভারিকে লংঅনের আশ-পাশ দিয়ে বাতসে ভাসিয়ে।
পুল-হুক কিংবা স্লগ সুইপে কোনো ছক্কাই ছিল না। মানে বল অনসাইডে গেছে বেশি। তবে সেটা লং অন আর ওয়াইড লং অনের ১০ থেকে ১৫ গজের ভিতরে ছিল। যতটা সম্ভব সোজা ব্যাটে খেলার চেষ্টা ছিল। পরিভাষায় যাকে ‘ক্রস’ খেলা বলে, তা ছিল না। মিড উইকেট আর স্কোয়ার লেগের মাঝখান দিয়ে স্লগ সুইপ হাঁকানোর চেষ্টাই করেননি।
আড়াআড়ি ব্যাটে তুলে মারার চেষ্টাই করেননি। আর তুলে মারতে গিয়ে কব্জিও ঘোরানোর প্রবণতা ছিল না। খাট লেন্থের বলগুলোকে স্কোয়ার লেগ ও মিড উইকেটে পুল আর হুকও করেছেন সতর্ক, সাবধানে। একদম হাওয়ায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখে। সেগুলো ৪০ থেকে ৫০ গজ দূরে গিয়েই ছিটকে পড়েছে। কাজেই সৌম্য, ছোট মাঠে স্কোয়ার লেগ, মিড উইকেটের আশপাশ দিয়ে ক্রস ব্যাটে, স্লগ সুইপ হাঁকিয়ে ১৬ ছক্কার রেকর্ড গড়েছেন- মার্কা চিন্তাটাই ভুল।
পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদি ১৯৯৬ সালের ৪ অক্টোবর নাইরোবিতে ৩৭ বলে সেঞ্চুরি, এরপর একই বছর সিঙ্গাপুরের যে মাঠে জয়সুরিয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন, সেগুলোও ছিল আকারে ছোট মাঠে। কই তখন তো তা নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি?
নিউজিল্যান্ডের সব মাঠইতো ওভাল শেপের। স্কোয়ারে কম। ৬৫ থেকে ৬৮ গজের ভেতরে। সেখানে অনেক রেকর্ড হয়, তা নিয়েও কিন্তু কেউ বলেন না যে মাঠ ছোট, তাই চার ও ছক্কা হয়েছে বেশি। শুধু নিজ দেশের একজন কৃতিত্ব গড়লো, আর সেটাকে কীভাবে খাটো করা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত সমালোচকরা।
লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের সঙ্গে সেঞ্চুরি করার পর সৌম্য বলেছিলেন, ‘আসলে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি সোজা খেলার চেষ্টা করেছি। আজও সেই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ক্রস ব্যাটে স্লগ করা কিংবা উইকেট সোজা বলকে অন্ধের মতো আড়াআড়ি ব্যাটে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে সাপটে সীমানা ছাড়া করার চেষ্টাই যে ছিল না।’
কিন্তু তারপরও তীর্যক কথাবার্তায় তার এ কৃতিত্বকে খাটো করা দেখে একটি প্রচলিত গল্প মনে পড়ে গেল। ‘অমুকের ছেলে কি বিএ পাস করেছে? আরে না পাস করেনি। পরে জানা গেল পাস করেছে। তখন বলা হলো, যদিও পাস করেছে; কিন্তু চাকরি পাবে না। তারপর এক সময় সে চাকরিও পেয়ে গেল। তখন সমালোচকরা বলতে থাকলেন, চাকরি পেয়েছে ঠিকই; কিন্তু বেতন পাবে না।’
এমন নেতিবাচক মানসিকতার পরিবর্তন যে খুব জরুরি।
এআরবি/আইএইচএস/বিএ