চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ মোহামেডানের
এক সময় বলা হতো দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ম্যাচ। ঐতিহ্যর লড়াই। এখন সব অতীত। নামেই মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথ। উত্তেজনা, আকর্ষণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুই নেই। দর্শক, সমর্থক ও ভক্তদের মাঝেও নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্য। উৎসাহ-উদ্দীপনা। আগের মত মাঠ দর্শকে ঠাসা বহুদূরে, গ্যালারি ফাঁকা। দর্শকই নেই। মাঠও নিরুত্তাপ। লড়াই হলো একপেশে।
আবাহনীর দোর্দন্ড দাপটের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারল না মোহামেডান। একপেশে লড়াইয়ে ৬ উইকেটে জিতে আবার লিগ টেবিলে অবস্থার উন্নতি ঘটালো আকাশি-হলুদ জার্সিধারীরা। বর্তমান ও সাবেক মিলে জাতীয় ক্রিকেটারের ছড়াছড়ি। মাশরাফি, সাব্বির, সৌম্য, মিঠুন (এ ম্যাচে ছিলেন না), জহুরুল, শান্ত, সাইফউদ্দীন, রুবেল, সানজামুল আর নাজমুল অপু- তারকায় ঠাসা আবাহনী। সাথে যোগ হয়েছেন ভারতের ওয়াসিম জাফর। সব মিলে কাগজে কলমে এক নম্বর দল এবার আবাহনী।
আগের ম্যাচে প্রাইম ব্যাংকের সাথে না পারলেও ব্যাটিং ও বোলিংয়ে সবচেয়ে ব্যালেন্সড দল। টপ ও মিডল অর্ডারে অনেক অভিজ্ঞ, পরিণত ম্যাচ জেতানো পারফরমার। পেস ও স্পিন বোলিংটাও সাজানো গোছানো। ধারালো। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ মোহামেডান কাগজে কলমে গত দুই তিন বছরের মধ্যে তুলনামূলক ভালো দল।
তারওপর এ ম্যাচে যোগ হয়েছেন লিটন দাস। গত তিন বছরে আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে যার আছে দু দুটি সেঞ্চুরি। সঙ্গে আব্দুল মজিদ, ইরফান শুকুর, রকিবুল, নাদিফ, আশরাফুল, সোহাগ গাজী, শ্রীলঙ্কার চতুরাঙ্গা সিলভা, শফিউল, শাহাদাত রাজিব আর আলাউদ্দীন বাবুর মত পরিণত ও প্রতিষ্ঠিত পারফরমার। তাতে কি? আবাহনীর সাথে কুলিয়ে ওঠার মত দল নয়।
তাই খেলার আগে অতিবড় মোহামেডান সমর্থকও আশাবাদী ছিলেন না। বরং মনে ভর করেছিল রাজ্যের সংশয়। প্রশ্ন উঠেছিল, চির প্রতিদ্বন্দ্বি আবাহনীর সাথে শক্তিতে কুলিয়ে উঠবে মোহামেডান? সেটাই হয়েছে।
সে অর্থে কোনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এর মধ্যে সকালে আবাহনী অধিনায়ক মোসাদ্দেক টস জিতে যাওয়ায় ম্যাচ আবাহনীর দিকে ম্যাচ হেলে পড়ে। কারণ এবারের লিগে শেরে বাংলায় আগে ব্যাট করা মানেই ৩০-৪০ ভাগ ম্যাচ হেরে যাওয়া। সকালের দিকে অন্তত দুই ঘন্টা উইকেটে ময়েশ্চার থাকে। এবং বেশির ভাগ ম্যাচেই আগে ব্যাট করা দল হেরেছে।
প্রথম ব্যাট করার অর্থ বড় সড় স্কোর গড়া কঠিন। তাই আর অযাচিত ঝুঁকি না নিয়ে টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নিলেন আবাহনী অধিনায়ক। সকালের সেশনে কখনো একটু বাড়তি গতি ও উচ্চতায় লাফিয়ে উঠল কিছু কিছু ডেলিভারি।
আর সামগ্রিকভাবে প্রথম সেশনে বল একটু থেমে আসছিল। যে কারণে তেড়েফুড়ে শটস খেলাও সহজ ছিল না। এমন উইকেটে খাটো লেন্থে বল না করে যতটা সম্ভব উইকেট সোজা এবং গুডলেন্থে পিচ ফেলে সর্বোচ্চ সমীহ আদায় করে নেন আবাহনীর সাইফউদ্দীন আর নাজমুল ইসলাম অপু।
মাশরাফির সাথে বোলিং শুরু করা সাইফউদ্দীন সকালে প্রথম স্পেলে পর পর দুই মেডেন সহ ৩১ রানে পতন ঘটান তিন উইকেটের। মোহামেডানের যে তিনজন স্বচ্ছন্দে খেলে দলকে লড়িয়ে পুুঁজি গড়ার চেষ্টায় মনোযোগী ছিলেন, সেই বাঁহাতি ইরফান শুকুরকে দ্বিতীয় স্পেলে আর শেষ দিকে চাতুরাঙ্গা সিলভা ও সোহাগ গাজীর উইকেট নেন সাইফউদ্দীন। আর মাশরাফি ও সাইফউদ্দীনকে দেখে খেলে ফেলা লিটন দাসকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে ব্রেক থ্রু আনা বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপু আউট করেন মোহামেডান অধিনায়ক রকিবুল আর নাদিফ চৌদুরীকেও।
মূলতঃ সাইফউদ্দীন আর নাজমুল অপুর মাপা ও নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিপক্ষে একটু বেশি সতর্ক হয়ে খেলতে গিয়ে বিপত্তি ডেকে আনলেন মোহামেডানের ফ্রন্টলাইনাররা। যিনি পারতেন রান চাকা সতেজ রাখতে, সেই লিটন দাস সকালে সাইফউদ্দীন আর মাশরাফির প্রথম স্পেলটা দেখে সবে ভালো খেলতে শুরু করে বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপুর প্রথম ওভারে ফ্লিক করতে গিয়ে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ফেরায় ওপরের দিকে রান গতি যায় কমে।
লিটন দাসের ৩৮ বলে ২৭ রানের ইনিংসটি শেষ হবার পর অপর ওপেনার আব্দুল মজিদ আর ইরফান শুকুর একটু বেশি বল খেলে ফেলায় রান গতি বেশ স্লথ হয়ে যায়। এই জুটির মধ্যে মজিদ অনেক বেশি বল খেলে ফেলেন। ৩৮.৮০ স্ট্রাইকরেটে ৬৭ বলে ২৬ রান করায় মোহামেডানের রান গতি ক্রমেই স্লথ থেকে স্লথতর হয়ে যায়। ওয়ান ডাউনে নামা ইরফান শুকুরও (৭৮ বলে ৫১) রান গতি বাড়াতে পারেননি।
এরপর অধিনায়ক রকিবুল (৫৪ বলে ৫১) মাঝামাঝি রান গতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও পঞ্চাশে পৌঁছানোর পর পরই অতি উৎসাহী হয়ে বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপুর বলে স্কুপ করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হলে বড় ধাক্কা খায় মোহামেডান। অপর প্রান্তে নাদিফ (১১ বলে ৭) আর আট নম্বরে নামা আশরাফুল (৭ বলে ৪) কিছু করতে পারেননি।
শেষ দিকে শ্রীলঙ্কার চতুরাঙ্গা ডি সিলভা (২৪ বলে ৩২) আর সোহাগ গাজী (মাশরাফির শেষ স্পেলে লং অনের ওপর দিয়ে দুই ছক্কা সহ ২০ বলে ২৭) বলের চেয়ে বেশি রান তুললে মোহামেডানের স্কোর আড়াইশোর কাছাকাছি (২৪৮/৭) চলে যায়।
কিন্তু সকালের তুলনায় সহজ হয়ে যাওয়া উইকেটে মোহামেডানের দূর্বল ও কমজোরি বোলিংয়ে সেটা অপ্রতুল প্রমাণ হয়। আবাহনী ৬ উইকেট অক্ষত রেখে ১৫ বল আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
লাঞ্চের পরও হঠাৎ কিছু বল আচমকা লাফিয়ে উঠলেও উইকেট সহজ হয়ে গেল। বল ব্যাটে আসলো প্রথম সেশনের চেয়ে ভালো গতিতে। যে কারণে দেখে খেলে রান করাও সহজ হলো।
আবাহনীর তিন টপ অর্ডার অভিজ্ঞ জহুরুল (১৩১ বলে ৯৬), সৌম্য সরকার (৫৪ বলে ৪৩), ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফর (৪২ বলে ৩৮) স্বচ্ছন্দে ও দায়িত্ব নিয়ে খেলে জয়ের মজবুত গড়ে দেন। তারা উইকেটের চরিত্র বুঝে আর মোহামেডানের বোলারদের ধারহীন বোলিংয়ের বিপক্ষে যতটা সম্ভব সোজা ব্যাটে ব্যাকরণ মেনে প্রথাগত ব্যাটিং করেন। তাতেই মোহামেডানের সম্ভাবনা যায় নিঃশেষ হয়ে।
এরপর তিন তুর্কী তরুণ মোসাদ্দেক (১৬ বলে ১৬) , নাজমুল হোসেন শান্ত (২৩ বলে ১৮) আর সাব্বির (১৯ বলে ২১) জহুরুল, সৌম্য আর ওয়াসিম জাফরের সেই সাজানো পথে হেঁটে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের বন্দরে। এর মধ্যে বাঁহাতি নাজমুল শান্ত আউট হলেও অধিনায়ক মোসাদ্দেক আর অনিয়মিত অফস্পিনার মজিদের বলে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা হাকিয়ে আবাহনীকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেয়া সাব্বির বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরেন।
মোহামেডানের পেসার শফিউল মাঝে মধ্যে কিছু ভালো ডেলিভারি ছুড়েছেন। তার একটিতে আউট হয়েছেন ওয়াসিম জাফর। প্রথম ম্যাচে ৮ রানে ফিরলেও পরের দুই খেলায় ৭৬ আর ৯৪ রানের দু দুটি বড় ইনিংস খেলা ৪১ বছরের অভিজ্ঞ উইলোবাজ ওয়াসিম জাফর দেখে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিলো আবাহনীকে জিতিয়ে বিজয়ীর বেশেই সাজঘরে ফিরবেন এ ভারতীয় । কিন্তু শফিউলের দুর্দান্ত আউট সুইংয়ে তার ইনিংসটি শেষ হয়। ঠিক লেগস্টাম্পের বাইরে গুডলেন্থে পিচ পড়া ডেলিভারি সুইং করে বেরিয়ে যাবে তা ভাবেননি ওয়াসিম জাফর। ব্যাট পেতে দিয়েছিলেন। বল ঠিক ব্যাটের বাইরের কোনা চুমে চলে যায় কিপার ইরফান শুকুরের গ্লাভসে।
এছাড়া শাহাদাত হোসেন রাজিব একদম শেষ দিকে (আবাহনী তখন জয় থেকে ৩৫ রান দূরে) দুর্দান্ত ইয়র্কারে জহুরুলের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেন। সৌম্য সরকারকেও বোল্ড করেন রাজিব। আর মোহামেডানের বাকি সব বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে সমীহ জাগানো ও নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছেন চাতুরাঙ্গা ডি সিলভা। তার ১০ ওভারে রান ওঠে মাত্র ২৭। নাজমুল হোসেন শান্তর উইকেটটি জমা পড়ে এ লঙ্কান বাঁহাতি স্পিনারের ঝুলিতে।
কিন্তু আবাহনীর বাকি ব্যাটসম্যানরা তার বিপক্ষে সতর্ক ও সাবধানে খেলায় আর সাফল্যর দেখা পাননি এ লঙ্কান। সমান ছয় ম্যাচে মোহামেডানের টানা তিন পরাজয়ের বিপরীতে আগের ম্যাচে প্রাইম ব্যাংকের কাছে হেরে জয়ের পথ হারানো আবাহনীর জয়রথ সচল হলো আবারো।
এআরবি/এমএমআর/এমএস