সেদিনের বিকেএসপির তরুণ আজ বিশ্ব ক্রিকেটের বড় তারা
আজ তিনি ক্রিকেটের মহাতারকা। তাকে নিয়ে অনেক কথা, আলোচনা, পর্যালোচনা, প্রশংসা, বন্দনা। আজকের সাকিব আল হাসান ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নাম, দেশের ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
নামের পাশে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমা লেগে আছে ৮-১০ বছর ধরেই। এর বাইরে তার কত নাম, ‘টু ইন ওয়ান’, সব্যসাচী ক্রিকেটার।’ আজ সেই সাকিবের ৩২তম জন্মদিনে সকাল থেকেই মনে পড়ছে আমার প্রথম দেখা সাকিবের দিনটির কথা।
খুব সম্ভবত ২০০৩ সালের একদম শেষ কিংবা ২০০৪ সালের শুরুর দিকের কোনো এক বিকেল। ক্রিকেট তখনো মিরপুরে আসেনি। হোম অফ ক্রিকেট বা শেরে বাংলা স্টেডিয়াম হয়নি। ঢাকা তথা দেশের ক্রিকেটের কেন্দ্র বিন্দু তখনো বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট মানে প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় লিগ আর জাতীয় দলের কোনো খেলা থাকুক বা নাই থাকুক, এখন যেমন সংবাদ আহরণের জন্য সংবাদকর্মীরা প্রতিদিনই শেরে বাংলায় যান, তখন আমরাও প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যেতাম। ক্রিকেটার, কোচ, ক্লাব ও বোর্ড সংগঠকদের এক অন্যরকম আড্ডা হতো। আমরা বোর্ডে বসে জটলা বেঁধে নির্মল আড্ডায় মত্ত থাকতাম।
তেমনি কোন এক আড্ডায় হঠাৎ প্রশ্ন উঠলো-আচ্ছা, আমাদের কি আর কোন আশরাফুল আছে, যে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঝড় তুলতে পারে? সাড়া জাগাতে পারে?
বলার অপেক্ষা রাখে না মোহাম্মদ আশরাফুল তারও আগেই নিজের মেধা ও সামর্থ্যর জানান দিয়ে ফেলেছিলেন। কাজেই প্রশ্নটা উঠলো আশরাফুলের মতো ব্যাট হাতে মাঠ মাতানোর কি কেউ আছে?
কে একজন বলে উঠলেন, আছে। একজন আছে। নাম সাকিব। বিকেএসপির ছেলে। বল ও ব্যাট হাতে সমান পারদর্শী। যেমন আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে ঠিক তেমনি বলও ঘোরাতে পারে। তার মাঝেও আছে বিশ্ব মানের ক্রিকেটার হবার অমিত সম্ভাবনা!
যতদূর মনে পড়ে, ওই আড্ডায় তখন বিসিবির কোন নির্বাহী পরিষদের সদস্য তথা বোর্ড মেম্বার ছিলেন না। আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম প্রায় সমবয়সী ও কাছাকাছি বিভিন্ন ক্লাব প্রতিনিধিদের সাথে। কেউ ঢাকার কোনো ক্রিকেট ক্লাবের ক্রিকেট সেক্রেটারি, কেউবা ক্রিকেট ম্যানেজার। ঠিক কারা কারা ছিলেন, একদম নির্ভুল নাম মনে করতে পরছি না।
তবে যতদূর মনে পড়ে আমার বন্ধুবর তারিকুল ইসলাম টিটো (তখন মোহামেডানের ক্রিকেট কর্তা), আদনান রহমান দিপন (লালমাটিয়া অফিসিয়ালস), গোলাম ফারুক ফটিক (সূর্যতরুণ ম্যানেজার), পাভেল (আজাদ স্পোর্টিং), বাবলা (কাঁঠাল বাগান অফিসিয়াল), আরিফ (নবীন সংঘ) ভাই হয়তো ছিলেন। আরও কেউ হয়তো ছিলেন। কিন্তু তাদের নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে সম্ভবত বাবলা ভাই বেশ জোরের সাথেই বললেন, ‘বাংলাদেশের নেক্সট স্টার হবে সাকিব এবং দেখবেন বিশ্বে নামও করবে।’
কিন্তু কে এই সাকিব? প্রশ্ন করলাম। তখন বেশ কজন একসঙ্গে জানাল ছেলেটা বিকেএসপির। ব্যাট ও বলে সমান পারদর্শী। সাকিব তখন অনূর্ধ্ব ১৭ দলের সদস্য। কাজেই আমরা মানে সাংবাদিকরা সেভাবে চিনতাম না।
ওইদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিসিবি তথা সিসিডিএম অফিসে ঢাকার কজন ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ মানুষের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম সাকিবের নাম। সেই থেকে সবে কৈশোর পার করা ওই তরুণের নামটা মনের গহীন গেঁথে থাকল। বলে রাখি সাকিব তখন বিকেএসপির ছাত্র।
এরপর অনূর্ধ্ব-১৭ হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ‘এর হয়ে জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করে ফেলা। তারপর ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের মূল ও এক নম্বর আসর প্রিমিয়ার লিগে নাম লিখানো। ২০০৫-২০০৬ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে ভিক্টোরিয়ার হয়ে প্রথম প্রিমিয়ার লিগ খেলেন সাকিব আল হাসান।
এখন যিনি দেশের অন্যতম কুশলী ও দক্ষ প্রশিক্ষক, সেই মোহাম্মদ সালাউদ্দীন তখন বিকেএসপির কোচিংয়ের পাশাপাশি ভিক্টোরিয়ারও প্রশিক্ষক। তার হাত ধরেই আসলে ভিক্টোরিয়ায় নাম লিখালেন সাকিব। ১৮-১৯ বছরে এক নবীণ। ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং ঠিক শ্যামলা আর কালোর মাঝামাঝি। শরীরের তুলনায় কাঁধ বা সোল্ডার একটু চওড়া। কিন্তু প্রথম বছর সেভাবে চোখে পড়েনি তার পারফরমেন্স। মানে আবির্ভাবে মনে হয়নি সাকিব খুব বড় কিছু।
তবে ২০০৬-২০০৭ প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডানে যোগ দেবার বছরই সাকিব যেন জানান দিলেন-আমি এসেছি, খেলতে। মাঠ মাতাতে। প্রতিপক্ষর ওপর বল ও ব্যাট হাতে ছড়ি ঘোরাতে। সবার মন জয় করতে।
জাতীয় দলের এখন যেমন খুব বেশি এ্যাসাইনমেন্ট, তখন অত ব্যস্ততা ছিল না। সবেধন নীল মনি এক জাতীয় লীগ আর প্রিমিয়ার লিগ। তাই আমরা তখন খুব সিরিয়াসলি ঢাকা লিগ কভার করতাম। আজ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, কাল ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়াম আর পরশু বিকেএসপি মাঠে ছুটোছুটি করে কাটতো সময়।
যতদূর মনে পড়ে, ওই বছর প্রিমিয়ার লিগ শুরুর আগে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি লিগ হয়েছিল। তাতে নজর কেড়ে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন জুনায়েদ সিদ্দিকী ইমরোজ। মোহামেডান তখন তারকায় ঠাসা। ব্যাটিংয়ে ওপরের দিকে জায়গা পাওয়া কঠিন। ব্যাটসম্যান সাকিবের জায়গা হতো সাত নম্বরে।
তাই সেভাবে সাকিবকে আবিষ্কারের সুযোগ পাইনি। তবে হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টি লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল না হয় সেমিফাইনাল ম্যাচে প্রথম নজর কাড়লেন বোলার মানে স্পিনার সাকিব। এখনও মনের আয়নায় সাকিবের এক দুর্দান্ত ডেলিভারি উঁকি দেয়।
বিকেএসপির দুই নম্বর মাঠে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে সাকিবের এক ডেলিভারি এখনও চোখে লেগে আছে। ইনফ্যাক্ট ওই এক ডেলিভারিতেই আমি মুগ্ধ হই। বনে যাই সাকিবের ভক্ত। সাকিব বল করছিলেন বিকেএসপি অডিটোরিয়াম প্রান্ত থেকে।
আমি আর সাইদ (কালের কণ্ঠের ক্রীড়া সম্পাদক সাইদউজ্জামান) সহ আর হাতে গোনা তিন চার জন সাংবাদিক খেলা দেখছিলাম বিপরীত দিক মানে পুকুর পাড়ের সাইট স্কিনের একটু দূরে গাছের নিচে বসে।
ব্যাটসম্যান ছিলেন তুষার ইমরান। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বাধিক সেঞ্চুরি ও হাফসেঞ্চুরি হাঁকানোর পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অনন্য সাধারণ রেকর্ডের অধিকারী তুষার ইমরান তখন ক্লাব ক্রিকেটে ড্যাশিং উইলোবাজ। বেশ পরিপাটি ব্যাটিং শৈলি। স্কোয়ার কাট, কভার ড্রাইভ, অন ড্রাইভ আর ফ্লিক খেলায় পারদর্শিতা ছিল খুব। লেগ মিডল কিংবা মিডল স্টাম্পের আশপাশে বল পেলে কব্জির মোচরে স্কোয়ার লেগ, ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগ কিংবা লং লেগে ঘোরাতে ছিলেন খুব দক্ষ।
তুষারকে তাই লেগ ও মিডল স্ট্যাম্পের আশপাশে বল করতে কয়েকবার ভাবতেন বোলাররা। সেদিনের ১৮-১৯ বছরের তরুণ সাকিবের তা কতটা জানা ছিল বলতে পারবো না, তবে সেই অনসাইডে খুব দক্ষ তুষার ইমরানকে কিন্তু লেগ মিডল স্ট্যাম্পের আশপাশে বল ফেলেই আউট করেছিলেন সাকিব।
বলটি ঠিক লেগস্ট্যাম্পের ইঞ্চি খানেক বাইরে পিচ করেছিল, তবে ঠিক ফুল লেন্থ না। একটু টেনে দেয়া। তুষার ফ্লিক আর হাফ ককের মাঝামাঝি কিছু একটা করতে গেলেন, কিন্তু টার্নে পরাস্ত হলেন। বল অফস্টাম্পের বেলস চুমু খেয়ে চলে গেল। একদম বোকার মত বোল্ড হলেন তুষার।
লেগস্টাম্পের একটু বাইরে পড়ে অফস্টাম্প ভেঙ্গে দেয়া মানে যে হিউজ টার্ন! হ্যাঁ, তাই। তখন অমন টার্ন করানো বোলার ছিলেন একদম হাতে গোণা- মোহাম্মদ রফিক, এনামুল হক মনি আর এনামুল জুনিয়র। কিন্তু তাদের কাউকে আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে লেগস্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে ফেলে অফস্ট্যাম্প ভেঙে দেয়া বিশাল টার্নে কাউকে বোল্ড করতে দেখিনি। সাকিবই আমার দেখা অত লম্বা চওড়া টার্নে কাউকে বোকা বানানো স্পিনার। সেই সাপের মতো বেঁকে যাওয়া ডেলিভারি এখনো মনে গেঁথে আছে আমার। সাথে সাকিব নামটাও গাঁথা হয়ে আছে।
এরপর ২০০৭ সালের ১৮ মে চট্টগ্রামের বন্দর নগরীর জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে সাকিবের টেস্ট ডেব্যু নিজ চোখেই দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সাকিব আজ ১১ বছরের মাথায় এসে টেস্টে ২০০ উইকেট শিকারি। প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে এ বিরল কৃতিত্বর অধিকারী মাগুরার সাকিব, বিকেএসপির সাকিব।
স্পিনার সাকিবের সাফল্যের পাশে অলরাউন্ডার সাকিব উঠে গেলেন আরও এক সিঁড়ি উপরে। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের অন্যতম ইংলিশ ক্রিকেটার ইয়ান বোথামের চেয়ে কম টেস্ট খেলে তিন হাজার টেস্ট রান ও দুইশ উইকেটশিকারি সাকিব এখন শুধু সময়ের সেরা অলরাউন্ডারই নন, সর্বকালের সেরাদেরও একজন।
অসাধারণ। অনন্য। অবিস্মরণীয়, দুর্দান্ত, দারুণ- যাই বলিনা কেন সব উপমা ও বিশেষণই কম হবে। ক্রিকেট যে শুধু মেধা, প্রজ্ঞা আর পরিশ্রমের খেলা নয়; অনুভব, উপলব্ধি আর বুদ্ধিরও খেলা, সাকিব তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশের জাতীয় দলের বা সমসাময়িক ক্রিকেটারদের খুব কাছ থেকে যারা দেখেন, তাদের জানা সাকিব অনেকের চেয়ে কম পরিশ্রমী। কম পরিশ্রমী মানে যে সাকিব নিয়মিত অনুশীলন, জিম করেন না; তা নয়। সেখানেও সাকিব বুদ্ধিমান। যতটুকু দরকার ততটুকুই করেন। অপ্রয়োজনে ঘাম ঝড়ানো ও শক্তি ক্ষয় তার স্বভাববিরোধী।
নিজের শরীর, মেধা ও সামর্থ্য সম্পর্কে তার ধারণা খুব পরিষ্কার। আর তার চেয়ে বড় হলো, মাঠে এবং বাইরে কখন কি করতে হবে, সেটাও খুব ভালো জানা। তাই বিভিন্ন সময় ইনজুরি থেকে অল্প কদিনের প্রস্তুতিতে মাঠে ফিরেই দেখা গেছে চার-পাঁচ উইকেট দখল করে কিংবা ব্যাট হাতে ফিফটি হাঁকিয়ে নিজের সামর্থ্য জানান দিয়েছেন।
এখনো পর্যন্ত ১৯৫ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সাকিব রান করেছেন ৫৫৭৭, ৫৫ টেস্টে রান করেছেন ৩৮০৭ এবং ৭২টি আন্তর্জাতিক টি২০ তে রান ১৪৭১। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০৮৫৫ রানের মালিক সাকিব; বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
টেস্টে উইকেট সংখ্যা ২০৫; বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। ওয়ানডে ক্রিকেটে উইকেট সংখ্যা ২৪৭; ১২ উইকেট কম নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে তিনি। টি২০ ক্রিকেটে উইকেট সংখ্যা ৮৫; বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এবং বিশ্ব ক্রিকেটে তৃতীয়।
টেস্টে সাকিবের অর্ধশতক ২৪, শতক ৫ ও ক্যারিয়ার সেরা ২১৭ রানের ইনিংস। ওয়ানডে ক্রিকেটে অর্ধশতক ৪০ টি আর শতশ ৭ টি। টি২০ ক্রিকেটে অর্ধশতক ৮ টি, ক্যারিয়ার সেরা রান ৮৪।
সাকিবসহ মাত্র তিনজন ক্রিকেটারের একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে। সাকিবের এক ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি ও চার উইকেটও রয়েছে। একই টি২০ ম্যাচে রয়েছে পাঁচ উইকেট ও ৪০ এর অধিক রান। ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০০০০ রান ও ৪৫০ উইকেটের বেশি নেওয়ার কৃতিত্ব মাত্র তিনজনের। এরমধ্যে সাকিব একজন।
শুভ জন্মদিন সাকিব আল হাসান। শুভ হোক তোমার আগামীর পথচলা। তোমার হাত ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাক আরও অনেকদূর এই শুভকামনায়।
এআরবি/এসএএস/এমএস