এখনো জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন দেখেন ‘বিগ হিটার’ জিয়া
ফুটবলের মত ঢাকার ক্রিকেটও দর্শক হারিয়েছে। এক সময় আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ভরে যেত। কিন্তু সময়ের প্রবাহতায় তা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যতে নেমে এসেছে। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর বিপিএলে শেরে বাংলায় দর্শকের ঢল নামলেও ঢাকাই ক্লাব ক্রিকেটে গ্যালারি প্রায় ফাঁকাই থাকে।
এবারের প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টিতেও প্রায় দর্শকশূন্য ছিল হোম অফ ক্রিকেট। তবে আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শেরে বাংলায় সেমিফাইনাল দেখতে হঠাৎ হাজার দুয়েক দর্শক।
শীর্ষ তারকাদের বড় অংশ নিউজিল্যান্ডে জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট সিরিজে ব্যস্ত। দুই জনপ্রিয় ক্রীড়া শক্তি আবাহনী-মোহামেডান বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্বেই।
টিভিতেও খেলা দেখাচ্ছে। তারপরও শেখ জামাল-শাইন পুকুর আর প্রাইম ব্যাংক-প্রাইম দোলেশ্বর সেমিফাইনাল দেখতে হাজার দুয়েক উৎসাহী ক্রিকেট অনুরাগীর সমাগম!
একটু অবাক হবার মতই। তবে ঘরে বসে টিভিতে না দেখে যেসব উৎসাহী ক্রিকেট অনুরাগী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাঠে ডিপিএল দেখতে এসেছিলেন, তাদের গাঁটের পয়সা খরচ করে মাঠে আসা বিফলে যায়নি।
পড়ন্ত বিকেলে শেরে বাংলায় শেখ জামালের দুই মিডল অর্ডার জিয়াউর রহমান জিয়া আর নুরুল হাসান সোহানের ঝড়ো উইলোবাজি দেখে দর্শকরা মুগ্ধ।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এই তো কয়েক বছর আগেও ঘরোয়া ক্রিকেটে হার্ড হিটারের তালিকায় সবার আগে উচ্চারিত হতো জিয়াউর রহমান জিয়ার নাম।
ঠিক প্রথাগত আর গাণিতিক ব্যাটিং শৈলির বাইরে গিয়ে ভাল বলকে ‘দুম’ করে ছক্কা হাঁকানোর সামর্থটা বেশ ভালই ছিল খুলনার ছয় ফুট উচ্চতার দীর্ঘদেহী এ মিডল অর্ডারের।
বলের পিছনে শরীর ও পা না নিয়েও বুক ভরা সাহস ও শরীরের শক্তি দিয়েও বিগ হিট নেয়ার ক্ষমতা ছিল জিয়ার। সে সামর্থ্য ও ক্ষমতার কথা প্রথম জানাজানি হয় আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার আয়োজন পিসিএলে (পোর্ট সিটি ক্রিকেট লিগ)। সে আসরে জিয়ার দল ছিল চিটাগাং ব্রাদার্স ইউনিয়ন।
সেমিফাইনালে চট্টগ্রাম আবাহনীর বিপক্ষে শেষ দিকে ওভার পিছু ১২ রানের দরকার থাকা অবস্থায় শেষ ৫-৬ ওভারে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে জিয়ার ব্যাট জ্বলে ওঠে। চার আর ছক্কার ফুলঝুরিতে মাঠ মাতে।
সেই থেকে উত্থান জিয়ার। এরপর প্রিমিয়ার লিগ ও জাতীয় লিগে ভাল খেলে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়া। শুরুতে হাত খুলে খেলে নজর কাড়লেও সে অর্থে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
এক টেস্ট, ১৩ ওয়ানডে ও ১৪ টি টোয়েন্টি ম্যাচে একবারের জন্য পঞ্চাশে পা রাখতে পারেননি। সেই বড় ইনিংস খেলতে না পারাই কাল হয়।
২০১৩ সালের ২৩ মার্চ হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকের ১৫ মাসের মধ্যে শেষ ক্যারিয়ার। ২০১৪ সালের ১৭ জুন ভারতের বিপক্ষে শেরে বাংলায় শেষ ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেন। তারপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। জিয়ার আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি। কে জানে, আবার তার ভাগ্য খুলতেও পারে!
এমন ইনিংস বিপিএলে খেললে হয়ত হিরো বনে যেতেন। সবাই দেখতো, জানতো জিয়ার বিরাট বিরাট ছক্কা হাঁকানোর সামর্থ্য আছে। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে দল জেতানোর সাহস ও সামর্থ্যও আছে।
সেটা হয়নি। তবে বিপিএলে সেই সুযোগ না পেলেও ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগে ঠিকই জিয়া দেখিয়ে দিলেন, এখনও ফুরিয়ে যাননি।
বুঝিয়ে দিলেন, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়েও দল জেতানোর পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে আমার। আর তাই তো শেরে বাংলায় খাদের কিনারায় পড়ে যাওয়া অবস্থায় ২৯ বলে ৭২ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে শেখ জামালকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে নায়ক বনে যাওয়া।
অথচ কাজটি সহজ ছিল না। লক্ষ্য ছিল ১৮২। তা করতে গিয়ে ৬৫ রানে শেষ ইনিংসের প্রথম অর্ধেক। অমন অবস্থায় জয়ের আশা যে রীতিমত দুরাশা। আকাশ কুসুম কল্পনার মতই। কিন্তু আজ পড়ন্ত বিকেলে শেরে বাংলায় ঐ অবস্থা থেকেও শেষ পর্যন্ত ১৮২ রানের লক্ষ্যে পৌঁছে গেল শেখ জামাল ধানমন্ডি।
শুনে অবাক হবেন, এমন সংকট ও বিপর্যয়ে পড়েও দল জেতানোর সাহস ছিল জিয়ার। ৫ উইকেট হারানোর পর কি ভাবছিলেন তিনি? খেলা শেষে মিডিয়ার সাথে আলাপে অমন প্রশ্ন মুখোমুখি হয়ে জিয়ার জবাব, ‘১৮০ প্লাস রান চেজ করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটা বিশ্বাস ছিল যে, উইকেট ভালো আছে। তো আমরা যদি শেষ পর্যন্ত খেলতে পারি তাহলে ম্যাচটা আমাদের হাতে থাকবে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছিল, যেই ধরনের উইকেট ছিল, আমি যদি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারি তাহলে অবশ্যই জিতব।’
২৯ বলে ৭ বিশাল ছক্কা আর ৪ বাউন্ডারিতে মাঠ গরম, পাশাপাশি দল জেতানো। এটা কি আবার মারকুটে জিয়ার পুনরুত্থান? জিয়ার অন্যরকম জবাব। তার কথার সারমর্ম হলো, সাধারণত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বেশিক্ষন ব্যাটিংয়ের সুযোগ মেলে না। যেটা আজ মিলেছে। শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলে তিনি যখন উইকেটে যান, তখনো খেলার ৬৬ বল বাকি ছিল।
জিয়ার উপলব্ধি, সেটা তার ভাল খেলার পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই তো মুখে এমন কথা, ‘আমি আসলে তেমন সুযোগ পাই না। আজ যেমন ১০ ওভার পেয়েছি, অন্য সময় পাই না। দুই ওভার তিন ওভার, এভাবে পেয়ে থাকি। এটা আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। সিচুয়েশন আমার বিপক্ষে থাকে। এ ম্যাচে বেশি সময় ব্যাট করা সুযোগ পেয়েছি। সব কিছু মিলিয়ে আমার অনুকূলে ছিল। আমার লাকও ফেভার করেছে।’
গত চার-পাঁচ বছর ধরে জাতীয় দলের বাইরে। তাই বলে জাতীয় দলে ফেরার আশা ছাড়েননি। এখনো স্বপ্ন দেখেন লাল সবুজ জার্সি গায়ে মাঠে নামার। তবে টার্গেট সেট করে নয়, জিয়া চান ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে।
এ নিয়ে জিয়া বলেন, ‘প্রত্যেক ক্রিকেটারের জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন থাকে। আমারও আছে। তো আমি আসলে ওইদিকে ফোকাস করছি না। আমি আমার পারফর্মেন্সে ফোকাস রাখছি। এই ম্যাচে ভালো করেছি, পরের ম্যাচ আমাদের ফাইনাল ম্যাচ। সেখানে যদি ভালো খেলার সুযোগ পাই তাহলে আমি চেষ্টা করব ভালো খেলার জন্য। আমি যদি পারফর্ম করি, তাহলে সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। আমার কথা হচ্ছে পারফর্ম করা, সেটাই করছি।’
এআরবি/এমএমআর/পিআর