ক্রিকেটার কিনতে ২ কোটিরও বেশি করে খরচ চার ক্লাবের
ফুটবলের মত কোটি কোটি টাকার মহোৎসব না হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ক্রিকেটের দল বদলেও টাকা উড়েছে দেদার।
৯০ দশকের শুরুর দিকে দুই ইংলিশ নেইল ফেয়ার ব্রাদার, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ আর পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরামের মত বিশ্বমানের ক্রিকেটার মোটা অংকের পারিশ্রমিকে ঢাকা আবাহনীর হয়ে খেলেছেন। তারপর যে কত বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেটার আর নামী-দামি তারকা ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না।
প্রতি বছর দলবদলে বড় দলগুলো (আবাহনী, মোহামেডান, বাংলাদেশ বিমান, সূর্যতরুণ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, কলাবাগান, রুপালী ব্যাংক, জিএমসিসি, ভিক্টোরিয়া, সোনারগাঁ ক্রিকেটার্স ও ওল্ডডিওএইচএসসহ আরও কিছু দল সমৃদ্ধ ও ভাল দল গড়তে বিরাট অংকের অর্থ লগ্নি করতো।
৯০ দশকের পুরো সময় এবং চলতি শতকের প্রথম ৫-৬ বছর ফুটবলের মত ঢাকাই ক্রিকেটেরও বেশ জৌলুস ছিল। আকর্ষণ, উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাও ছিল প্রচুর।
দেশের ক্রিকেট এগিয়েছে অনেক। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি বিজয়ের আগ পর্যন্ত যে ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ ছিল আইসিসির সহযোগি সদস্য (যদিও ওয়ানডে খেলতো সেই ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে) দেশ- সেই বাংলাদেশ এখন প্রায় ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত দল।
এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলছে তিন তিনবার। বিশ্বকাপের মত মহা আসরেও সেরা আটে নাম লিখিয়েছে দুইবার। আর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সর্বশেষ আসরেরও সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলেছে।
৮-৯ বছর ধরে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমা গায়ে বাংলাদেশেরই সাকিব আল হাসান। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম প্রায় বিশ্ব মানের পারফরমার হিসেবে সমাদৃত। সাত-আটটি বড় অপারেশনের ধকল কাটিয়ে মধ্য তিরিশে দাঁড়িয়েও ‘অধিনায়ক’ আর পেসার মাশরাফির দুনিয়া জোড়া সুখ্যাতি।
আইসিসি বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মত দু’দুটি বিশ্ব আসরে তিনখানা সেঞ্চুরি করে ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এর বাইরে কাটার মাস্টার মোস্তাফিজকেও ক্রিকেট বিশ্ব এক নামে চেনে। মোটকথা, অন্তত পাঁচ থেকে সাত জন ক্রিকেটার আছে বাংলাদেশের, যাদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে বেশ।
এমন একঝাঁক প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার ও ভাল পারফরমারের দেশ বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা তাই বলে একেবারেই ভালো নয়। বরং দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। যে ঢাকা লিগ খেলতে পাকিস্তান তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম আর বিশ্বকাপ বিজয়ী দলের অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা পর্যন্ত ছুটে এসেছেন দু’বার- সেই লিগ তার আকর্ষণ আর ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে অনেক।
এক সময় ঢাকার ক্রিকেটের দল বদল যতটা ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে সাড়া ফেলতো, দর্শক অনুরাগী আর ভক্ত-সমর্থকদের সম্পৃক্ততা থাকতো- এখন তার কিছুই নেই।
তারওপর খোলামেলা দলবদল মানে ক্রিকেটারদের ইচ্ছেমত দল বেছে নেয়া বন্ধ করে প্লেয়ার্স বাই চয়েজে ক্রিকেটার দলে ভেড়ানোয় ভক্ত ও সমর্থকদের উৎসাহ-আগ্রহে ভাটা চলে এসেছে। দল বদল তার সত্যিকার সৌন্দর্য্য, আকর্ষণ ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছে।
পাশাপাশি ক্রিকেটারদের আয়ও গেছে কমে। খোলা দলবদল হলে আগেরবার ভাল খেলা, সু-প্রতিষ্ঠিত পারফরমার ও প্রতিশ্রুতিশীলদের সবার চাহিদা থাকতো আকাশচুম্বি। তারা আগেরবারের চেয়ে বেশি মূল্য দাবি করার সুযোগ পেতেন। বেশি অর্থও মিলতো; কিন্তু প্লেয়ার্স বাই চয়েজ যেন তাদের হাত পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে।
এখন বিসিবি তথা সিসিডিএম ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কে কোন ক্যাটাগরিতে থাকবেন? তাদের কার পারিশ্রমিক কত হবে- এর পুরোটাই বোর্ড নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এতে করে যেমন ক্রিকেটারদের আয় গেছে কমে, ক্লাবগুলোর খরচের পরিমাণও আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে।
তামিম, মুশফিক আর সাকিব খেলছেন না। তাই প্লেয়ার্স ড্রাফটে তাদের থাকার প্রশ্নই আসে না। ওই তিন শীর্ষ তারকা লিগ খেললে তাদের পেতে দলগুলোকে আরও বেশি টাকা গুণতে হতো। খোলামেলা দলবদল হলে, মাশরাফি আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মানের পারফরমারকে পেতে নিশ্চিতভাবেই গুণতে হতো ৬০ লাখ টাকা। বাকি যারা ২০-২৫ লাখ টাকা করে পাচ্ছেন, তাদের পারিশ্রমিকও ৩০ থেকে ৪০ লাখের ঘরে গিয়ে ঠেকতো।
এবার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকধারী ক্রিকেটার মাত্র দুজন; মাশরাফি বিন মর্তুজা আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তাদের দু’জনার পারিশ্রমিক ৩৫ লাখ টাকা করে। পঞ্চ পান্ডবের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ছাড়া সাত ক্যাটাগরিতে সাড়ে তিন থেকে ২৫ লাখ টাকা মূল্যে খেলোয়াড় বেচাকেনা হয়েছে এবার।
এরমধ্যে আবার প্রতি দল আগেরবার খেলা তিনজনকে দলে রেখেও দিয়েছে। সব মিলে এবারের দলবদলে দলগুলোকে মোটা টাকাই গুণতে হয়েছে। কাগজে কলমে যারা সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও ভাল দল সাজিয়েছে, তাদেরকে গড় প্রতি ২ কোটি টাকার মত গুণতে হয়েছে।
শেখ জামালের প্লেয়ার্স পেমেন্ট ২ কোটি ২১ লাখ, প্রাইম ব্যাংকের ২ কোটি ১৮ লাখ, মোহামেডান ২ কোটি ১২ লাখ আর আবাহনীর ২ কোটি। সবচেয়ে বেশী অর্থ ব্যয়ে দল গড়েছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। এ ক্লাব দল সাজাতে খরচ করেছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় সর্বাধিক খরুচে ক্লাব হলো প্রাইম ব্যাংক। এ ব্যাংক দল গোছাতে সব মিলে ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা খরচ করেছে। বেশ কয়েক বছর পর এবার বিগ বাজেটে দল গড়েছে মোহামেডানও। সাদা কালোদের মোট ২ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।
এছাড়া চ্যাম্পিয়ন আবাহনীতে জাতীয় দল ও সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার মিলে সর্বাধিক তারকার সমন্বয় ঘটলেও আকাশী হলুদ শিবির ২ কোটি টাকায় দল বদল কার্যক্রম শেষ করেছে।
টাকার অংক হিসেব কষলে ওপরের চার দলের খুব কাছেই আছে লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জ। তাদের ব্যায় ১ কোটি ৮৭ লাখ, গাজী গ্রুপ ১ কোটি ৮৬ লাখ ও প্রাইম দোলেশ্বর ১ কোটি ৭৯ লাখ। এর বাইরে শাইন পুকুর ১ কোটি ৪১ লাখ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ১ কোটি ১১ লাখ এবং উত্তরা স্পোর্টিং ৮৭ লাখ ও খেলাঘরকে প্লেয়ার্স পেমেন্টের জন্য গুণতে হবে ৭০ লাখ টাকা। সবচেয়ে কম ৩৮ লাখ টাকায় দল সাজিয়েছে বিকেএসপি।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম