কিউইদের বিপক্ষে শুরু ‘অগোছালো’ টাইগারদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি
কথায় বলে ‘পূর্ব লক্ষণ’, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবার সেরা আটে জায়গা করে নেয়া বাংলাদেশ যে কিছু একটা করবে- বিশ্বকাপের বল পিচে গড়ানোর আগেই মিলেছিল তার আভাস। বলা যায় বিশ্বকাপে ঝড় তোলার পূর্ব সংকেত দিয়েছিল হাবিবুল বাশারের দল।
সেবার বিশ্বকাপ যাত্রা শুরুর আগে গা গরমের খেলায় নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সারা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল টাইগাররা। সে রেশ ধরেই প্রথম ম্যাচে শচিন, সেবাগ, দ্রাবিড়, সৌরভ, যুবরাজ, ধোনি, জহির খান ও হরভজন সিংদের শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে রীতিমত বিশ্বে তোলপাড় করে টাইগাররা।
এবার বিশ্বকাপের আগে অফিসিয়াল প্র্যাকটিস ম্যাচ নেই নিউজিল্যান্ডের সাথে। তবে কেইন উইলিয়ামসনের ব্ল্যাকক্যাপসদের সাথে সিরিজ দিয়েই আসলে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু করতে যাচ্ছে মাশরাফি বাহিনী।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজ শুরুর আগে আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্সে টাইগার ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজা নিজ মুখে বলেছেন, 'নিউজিল্যান্ডের সাথে সিরিজ দিয়েই সত্যিকার বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু হবে আমাদের।’ কারণ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন ‘উইন্ডি’ ওয়েদার (ঠান্ডার সাথে বেশ প্রবল বেগে বাতাস বয়ে যাওয়া আবহাওয়া) আর উইকেটের কথাও উল্লেখ করেছিলেন টাইগার অধিনায়ক।
দিনক্ষণের হিসেব কষলে বিশ্বকাপের বাকি আছে আর সাড়ে তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে অবশ্য মে মাসে আয়ারল্যান্ড সফরও আছে। সেখানে মে'র প্রথম সপ্তাহে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর স্বাগতিক আইরিশদের বিপক্ষে তিন জাতি টুর্নামেন্টে অংশ নেবে বাংলাদেশ। ৭ মে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ঐ টুর্নামেন্টে যাত্রা শুরু করবে মাশরাফির দল।
নিউজিল্যান্ড সফর আর আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি আসরের মাঝে যেহেতু আর কিছু নেই তাই কিউইদের বিপক্ষে সিরিজটিই টাইগারদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির প্রথম ধাপ। কিন্তু সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপে প্রস্তুতি পর্ব শুরু নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন, জেগেছে সংশয়।
বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, কোচ স্টিভ রোডস, প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুসহ জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা সবার আশা ছিল বিশ্বকাপ প্রস্তুতির শুরুটা হবে ছিমছাম, সাজানো গোছানো সুন্দর বাগানের মত।
কিন্তু তা আর হলো কই? রীতিমত অপ্রস্তুত, অগোছালো বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু করতে যাচ্ছে টাইগাররা। যে সফর ও যে ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে শুরু হবে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি মিশন, সেই ওয়ানডে সিরিজের আগে দেশের মাটিতে পুরো দলের একদিনের অনুশীলন ক্যাম্পও হয়নি।
তা সম্ভবও ছিল না। কারণ নিউজিল্যান্ড সফর বিশেষ করে ওয়ানডে সিরিজ আর বিপিএল পড়ে গেছে একদম গা ঘেঁষে। ৮ ফেব্রুয়ারি বিপিএল ফাইনাল ছিল আর কাল ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম ওয়ানডে। মানে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ বিপিএলে ব্যস্ত থাকার ঠিক ৯৬ ঘন্টা পর নিউজিল্যান্ডের অনভ্যস্ত ও প্রতিকূল কন্ডিশনে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নামা। শারীরিক, টেকনিক, স্কিল তথা ক্রিকেটীয় প্রস্তুতির তাই বলে কমতি নেই।
কারণ সবাই খেলার মধ্যে ছিলেন। বিপিএলে সব নামী ও হাই প্রোফাইল কোচদের অধীনে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ নিয়মিত অনুশীলন হয়েছে। ৫০ ওভারের না হলেও গড়পড়তা সব দল ১২ থেকে ১৫ টি ম্যাচও খেলেছে। তাতে আন্তর্জাতিক বাতাবরণ ছিল পুরোপুরি। গেইল, এবি ডি ভিলিয়ার্স, সুনিল নারিন, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড, অ্যালেক্স হেলস, রিলে রুশোর মত ব্যাটসম্যান, ওয়াহাব রিয়াজ ও জুনায়েদ খানের মত বোলারদের খেলার সুযোগ হয়েছে। কাজেই ক্রিকেটীয় প্রস্তুতিতে এতটুকু ঘাটতি নেই।
সমস্যা অন্য জায়গায়। পুরো দল দেশ ছাড়ার আগে এক বেলা একত্রে বসে এক পেয়ালা চা'ও খেতে পারেনি। তার চেয়ে বড় কথা যেতে হয়েছে তড়িঘড়ি করে ‘পরি কি মরি’ অবস্থায়। একসঙ্গে যেতেও পারিনি।
জাতীয় দলের বহর নিউজিল্যান্ডে গেছে তিন ভাগে। আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছিল যেসব ক্রিকেটারের দল কোয়ালিফায়ার ও এলিমিনেটর পর্বে বিদায় নেবে, তারা চলে যাবে ৭ ফেব্রুয়ারি। আর যারা ফাইনালে উঠবে তারা যাবে ৯ ফেব্রুয়ারি। এর মাঝখানে ৮ ফেব্রুয়ারি আরও একটি ছোট্ট দলও ঢাকা ছেড়েছে নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। সবমিলিয়ে তিন ভাগে দল গেছে নিউজিল্যান্ড।
শেষ অংশে যাওয়া অধিনায়ক মাশরাফি, তামিম, রুবেল আর সাইফউদ্দীন দেরিতে পৌঁছানোর কারণে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রস্তুতি ম্যাচই খেলতে পারেননি। তারা নেপিয়ারে পৌঁছেছেন মাত্র গতকাল।
আগামীকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার নেপিয়ারে কিউইদের সাথে প্রথম ম্যাচের আগে আজই প্রথম পুরো দল একসাথে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়েছে। মোট কথা একটা ছন্নছাড়া অবস্থায় নিউজিল্যান্ড যাওয়া এবং কঠিন, অনভ্যস্ত পরিবেশে গিয়ে নামমাত্র প্রস্তুতিতে প্রথম ম্যাচে মাঠে নামা- সব মিলে অগোছালো ও হ-য-ব-র-ল একটা অবস্থা।
একে তো এমন অগোছালো অবস্থা, তার ওপর ইনজুুরির ভয়াল থাবা। বিপিএল ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের লঙ্কান পেসার থিসারা পেরেরার বলে বাঁ হাতের অনামিকায় ব্যথা পেয়ে শেষ মুহুর্তে সিরিজ থেকে ছিটকে পড়েছেন দলের প্রধান চালিকাশক্তি, ব্যাটিং ও বোলিং ট্রাম্পকার্ড সাকিব আল হাসান। আর কোয়ালিফায়ারের ঠিক একদিন আগে ফিল্ডিং করতে গিয়ে সীমানার ধারে পা পিছলে পড়ে গোড়ালির লিগামেন্ট ছিড়ে মাঠের বাইরে ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ।
সাকিব ছাড়া বাংলাদেশ দল যেন তবলা ছাড়া গান। তাকে ছাড়া বিশ্বকাপ প্রস্তুতি মিশন শুরু মানে ভাঙাচোরা দল নিয়ে প্রস্তুতি শুরু। তার চেয়ে বড় কথা, বিপিএলে ২০ ওভারের ফরম্যাট হলেও ওপেনার লিটন দাস আর সৌম্য সরকার রানে নেই একদমই। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচেও রান পাননি লিটন আর সৌম্য। লিটন ৩ আর সৌম্য ১ রানে আউট হয়ে গেছেন।
এরকম অবিন্যস্ত-অগোছালো দল কেইন উইলিয়ামস বাহিনীর সাথে কী করবে? তা নিয়ে সংশয় জাগাই যে স্বাভাবিক। সাকিব নেই। তার অভাববোধ হবে। তাসকিনও নেই। তাকেও মিস করবে দল। তবে যারা নেই, তাদের কথা ভেবে আসলে লাভও নেই। বিশ্বকাপের আগে এখন প্রতিটি ওয়ানডে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। যারা আছেন, তারা নিজেদের ঠিক মত তৈরী করতে পারলে সেটাই হবে প্রাপ্তি।
তামিম বিপিএল ফাইনালে ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় ব্যাটিং করে আত্মবিশ্বাসী। মুশফিকুর রহিমের ব্যাটেও বইছে রানের নহর। অধিনায়ক মাশরাফিও ছন্দে আছেন। দুই পেসার রুবেল আর মোস্তাফিজ আছেন ফর্মে। মিরাজ অফস্পিনারের ভুমিকায় খুব উজ্জ্বল না থাকলেও বিপিএলে অধিনায়ক পরিচয়ে রেখেছেন প্রতিশ্রুতির ছাপ।
নিউজিল্যান্ডে প্র্যাকটিস ম্যাচে টপ স্কোরার হয়ে ভাল খেলার ইঙ্গিত দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে যার নিষেধাজ্ঞা আগেভাগে প্রত্যাহার করা হয়েছে, গা গরমের ম্যাচে সেই সাব্বিরও রান করেছেন। একটা অগোছালো অবস্থায় যে কোন জায়গায় ভাল করা কঠিন। তারপরও বলা, বিশ্বকাপের মহামঞ্চে উঠতে এর মধ্যেই নিজেদের তৈরী করতে হবে। যাদের কথা বলা হলো তারা ভাল খেললেই সত্যিকার প্রস্তুতি হয়ে যাবে।
এআরবি/এসএএস/এমএস