ফাইনালে আমরা আন্ডারডগ, কুমিল্লা ফেবারিট : সুজন
ক্রিকেটার থাকা অবস্থাতেই তার নাম ‘চাচা’। একটা অভিভাবকসুলভ এবং পরোপকারী মানসিকতা খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই তার মধ্যে। ব্রাদার্স ইউনিয়নের অধিনায়ক থাকা অবস্থায় সতীর্থ খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের অগ্রিম অংশটা নিজের পারিশ্রমিক থেকেই দেয়ার একাধিক নজির রয়েছে তার। ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার বন্ধুসুলভ এবং সবাইকে সাহায্য ও গাইড করার যে একটা সত্ত্বা, সে কারণেই তাকে তার সতীর্থ কিংবা জুনিয়র ক্রিকেটাররা ‘চাচা’ হিসেবেই সম্বোধন করে থাকেন।
খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি খুব যে আহামরি মানের ক্রিকেটার ছিলেন তা নয়। তবে সামর্থ্যের সবটুকু মাঠে ঢেলে দেয়ায় শুরুটা সেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। সামর্থ্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার প্রতি পূর্ণ ধারণা নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য অর্জন করা যায় তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ খালেদ মাহমুদ সুজন।
তিনি এর প্রমাণ দিয়েছেন ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বাজে পারফরম্যান্সের পর দেশের ক্রিকেটের ক্রান্তিকালে শুরু তার অধিনায়কত্ব পর্ব। সেখানে দুই বছরের মতো সামলেছেন অধিনায়কের গুরু দায়িত্ব।
পরে খেলা ছেড়েই হয়ে যান জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনো ম্যানেজার আবার কখনো অঘোষিত কোচ হিসেবে কাজ করেছেন জাতীয় দলের সঙ্গে। ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচিং করাচ্ছেন এক দশকের বেশি সময় ধরে। এমনকি বিপিএলেও ঢাকা ডায়নামাইটসকে একবার চ্যাম্পিয়ন করেছেন কোচ সুজন।
বিপিএলের এবারের আসরে আবারো শিরোপার সামনে দাঁড়িয়ে সুজন। তবে একটা অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েচে এবার। ধরা হয় দেশের ক্রিকেটের সেরা দুই কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এবং খালেদ মাহমুদ সুজন। এবারের ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হবেন এ দুইজন কোচ।
ফাইনালের আগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস কোচ সালাউদ্দিন মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগোনিউজের। কথা বলেছেন বিপিএল ফাইনাল, দেশের ক্রিকেট ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। জাগোনিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে ঢাকা কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গেও। চলুক দেখে নেয়া যাক খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে জাগোনিউজের কথোপকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ:
জাগো নিউজ: ফাইনালে আপনি কাকে এগিয়ে রাখছেন? আপনার চোখে ফেবারিট কে?
খালেদ মাহমুদ সুজন: আমি কুমিল্লাকেই এগিয়ে রাখতে চাই। নিজেদেরকে আন্ডারডগ ভাবছি। আমার চোখে ফাইনালের ফেবারিট কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
জাগো নিউজ: ফাইনালে নিজ দলকে আন্ডারডগ ভাবছেন কেন? একটু ভেঙে বলবেন?
খালেদ মাহমুদ সুজন: রাউন্ড রবিন লিগের দুই পর্বের একবারও আমরা কুমিল্লার সাথে পারিনি। দুইবারই হেরেছিলাম। যেহেতু এই আসরে আগের দু’বারের মোকাবিলায় আমরা জিততে পারিনি একবারও, তাই আমরার মনে হয় ফাইনালে কুমিল্লা ফেবারিট আর আমরা আন্ডারডগ। এর বাইরেও হিসেব আছে। যদি লাইন আপের তুলনা করেন, তাহলে বলবো দুই দলই ব্যালেন্সড। টি-টোয়েন্টিতে যা যা দরকার, দু’দলেই তা আছে। বিশেষ করে দুইপক্ষেই বেশ কজন বিগ হিটার আছেন। যারা পাওয়ার হিটিং করতে পারেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে যা সবচেয়ে বেশী দরকার তা আছে দু’দলেরই।
জাগো নিউজ: বলা হচ্ছে ফাইনাল হবে অলরাউন্ডারদের লড়াই। আপনিও কি তাই মনে করেন?
খালেদ মাহমুদ সুজন: হ্যাঁ! দু দলেই অলরাউন্ডারদের আধিক্য। দু’দলের ২২ জনের মধ্যে ৬/৭ জন অলরাউন্ডার আছে। তাই ফাইনালে অলরাউন্ডারদের একটা বড় ভূমিকা থাকতে পারে। আমাদের যেমন সাকিব, আন্দ্রে রাসেল আর সুনিল নারিন আছে; কুমিল্লায়ও আফ্রিদী, থিসারা পেরেরা আর সাইফউদ্দীনরা খেলছে। কাজেই অলরাউন্ডারদের লড়াই হবে। তবে আমি মনে করি না যে ফাইনাল শুধু হবে অলরাউন্ডারময়। শুধু অলরাউন্ডাররাই ম্যাচে নিয়ামক হবে।
জাগো নিউজ: তাহলে আপনার কী মনে হয়? কারা ম্যাচ ভাগ্য নির্ধারণ করবেন?
খালেদ মাহমুদ সুজন: আমার মনে হয় অলরাউন্ডারদের চেয়েও বেশী ভূমিকা থাকতে পারে দু’দলের ওপেনারদের। কারণ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দৈর্ঘ্য খুব কম। মাত্র ২০ ওভারের; ১২০ বলের খেলায় যে দলের ওপেনার বা টপ অর্ডাররা শুরুতে পাওয়ার প্লে’কাজে লাগিয়ে প্রথম দিকে বড় পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে পারেন, সেই দলের অবস্থা তত মজবুত হয়। শুরুতে মজবুত ভীত পেয়ে যাওয়া দল তত বেশী উপকৃত হয়। টপঅর্ডাররা পার্টনারশিপ গড়ে তুললে একটা ভাল প্লাটফর্ম তৈরী হয়। আর প্লাটফর্ম পেয়ে গেলে পরের দিকের ব্যাটসম্যানদের হাত খুলে খেলাটা সহজ হয়ে যায়। তারা স্বচ্ছন্দে অবলীলায় স্বাভাবিকভাবে ব্যাট চালাতে পারেন। তাতে রানের গতি স্বাভাবিক থাকে। স্কোরলাইনও বড় হয়। কাজেই আমার মনে হয় যে দলের টপ অর্ডাররা বড় জুটি গড়তে পারবে, তাদের সম্ভাবনাই বেশী থাকবে।
জাগো নিউজ:আপনার কি মনে হয় দুটি সেরা দলই ফাইনালে উঠে এসেছে ?
খালেদ মাহমুদ সুজন: এই প্রশ্নটির উত্তর আমাকে একটু অন্যভাবে দিতে হচ্ছে। অ্যালেক্স হেলস আর এবি ডি ভিলিয়ার্স চলে না গেলে বলে দিতাম রংপুর রাইডার্স ছিল এক নম্বর দল। ফাইনালেরও অন্যতম দাবিদার ছিল রংপুর। কিন্তু ঐ দুজন চলে যাবার পর আর তা বলা যাচ্ছে না। সে অর্থে বলতে পারেন, সম্ভাব্য সেরা দুই দলই ফাইনালে উঠে এসেছে।
জাগো নিউজ: আপনার দল ঢাকা ডায়নামাইটসের পথ চলা কেমন ছিল? ঢাকাকে কোথায় রাখতে চান?
খালেদ মাহমুদ সুজন: শুরুটা দারুণ ছিল। আমরা প্রথম দিকে মানে প্রথম লেগে দারুণ খেলেছি। শুরু থেকেই দল ছিল চমৎকার ছন্দে। টপঅর্ডার রান পাচ্ছিল। বোলাররা উইকেট পাচ্ছিলেন প্রায় নিয়মিত নীচের দিকে ব্যাটসম্যানরাও হাত খুলে পারফরম করতে পেরেছে। কিন্তু প্রথম পর্বের শেষদিকে এসে ছন্দপতন। প্রথম দিকে ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে জেতার পর আমরা বেশ ক’টি ম্যাচ খারাপ খেলতে শুরু করি। হারতেও থাকি। তবে আমার মনে হয় না সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল। আসলে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটাই এমন। এ ফরম্যাটে এক টানা বেশী সময় ও অনেকগুলো ম্যাচ টানা ভাল খেলা এবং জয়ের ধারা অব্যাহত রাখা কঠিন।
আমি তাই মনে করি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খুব ভালোর পরে ছন্দপতন অস্বাভাবিক নয়। এটা হতেই পারে। আমাদেরও হয়েছিল। আমরা ভালো খেলতে খেলতে মাঝে খারাপ খেলে রীতিমত অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলাম। সেটা যে কেন হয়েছিল, তা বলা কঠিন। এমন নয় আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। আমরা খুব ভালই জানতাম টি-টোয়েন্টিতে ছন্দ হারাতে সময় লাগে না। এক থেকে দুই ম্যাচ খারাপ গেলেই ছন্দপতন ঘটে। কিন্তু হয়ত শুরুতে অনেক বেশী ম্যাচ জেতায় কোথাও কোন শৈথিল্য এসে পড়েছিল। তারপর অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছিল।
এমন দাঁড়িয়েছিল যে, শেষ চারে থাকতে আমাদের রবিন লিগের শেষ ম্যাচে জয় অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। বলতে পারেন খুলনার সাথে রবিন লিগের ফিরতি পর্বের শেষ ম্যাচটিও রীতিমত নকআউট ম্যাচ হয়ে যায়। সেখান থেকে এলিমিনেটর আর কোয়ালিফায়ার-২ পার হয়ে ফাইনাল খেলা সহজ ছিল না। রীতিমত লড়াই-সংগ্রাম করেই আগাতে হয়েছে।
আমি খুব গর্বিত যে আমার দল আবার সময়মত নিজেদের খুঁজে পেয়েছে। নকআউট পর্বের আগের ম্যাচ থেকে এসে আমাদের দল অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে। মাঠে করণীয় কাজগুলো ঠিক মত করতে শুরু করেছে। আর সে কারণেই শেষ চারে পৌঁছানোর জন্য খুলনার ম্যাচটি আকার নেয় অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনালে। সেই ম্যাচ থেকেই আবার ঘুরে দাঁড়ানো। এরপর এলিমিনেটর পর্বে চিটাগং ভাইকিংস এবং কোয়ালিফায়ার-২’এ রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ‘সাডেন ডেথে’ আমাদের ক্রিকেটাররা ঠিক মতই জ্বলে উঠে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে। সবাই সামর্থ্যের সবটুকু উজার করে খেলেছে। আমি তাদের পারফর্ম্যান্সে খুবই সন্তুষ্ট।
প্রতিটি সদস্য দুর্দান্ত খেলেছে। বলা যায় ১০০ ভাগের বেশী ঢেলে দিয়েছে। ক্রিকেটারদের আন্তরিক চেষ্টা এবং সময়মত সব ডিপার্টমেন্ট ক্লিক করায় শেষ পর্যন্ত আমরা ফাইনালে। এত দূর আসার পিছনে ক্রিকেটারদের প্রাণপন প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতাই মূল।
জাগো নিউজ: কোচ হিসেবে আপনার ভূমিকা কী ছিল? আপনাকেও তো ‘ফাইটার’ বলা হয়। সেই খেলোয়াড়ী জীবন থেকে আপনি লড়তে পছন্দ করেন। এবারের বিপিএলে ওঠা নামার পালায় ঢাকা ডায়নামাইটস যে সংগ্রাম করলো, তাতে কোচ হিসেবে আপনারও নিশ্চয়ই একটা বড় ভূমিকা ছিল। সেটা কী?
খালেদ মাহমুদ সুজন: আসলে ক্রিকেটে কোচের কি খুব বেশি ভূমিকা থাকে, বলুন? আমার তো মনে হয় না কোচের তেমন কিছু করার থাকে। মাঠে, গেম প্ল্যান, কৌশল নির্ধারণ আর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা- সবই তো ক্যাপ্টেন করেন। সেখানে কোচের বাইরে থেকে কিই-বা করার থাকে? আমিও তেমন কিছু করিনি। আমি মেন্টরের ভূমিকায় ছিলাম। আমার মনে হয় টপ লেভেলে কোচের তেমন কিছু করার থাকে না। কোচরা আসলে মেন্টরের ভূমিকা নেন। আমিও সেটাই করার চেষ্টা করেছি। ক্রিকেটারদের চাঙ্গা রাখা, সাহস সঞ্চার, ভাল খেলায় অনুপ্রেরণা দেয়া এবং সেরাটা বের করে আনতে চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো গেম প্ল্যানেও থেকেছি।
আমার মনে হয় মাঠে আমাদের গেম প্ল্যান ও তার যথাযথ বাস্তব রূপটা খুব ভাল হয়েছে। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই। রংপুর রাইডার্সের রিলে রুশো পুরো টুর্নামন্টে খুব ভাল খেলেছেন। প্রায় ম্যাচে রান করেছেন। কিন্তু আমাদের সাথে রাউন্ড রবিন লিগের দুই পর্বেই ০ রানে এবং প্রথম বলেই আউট হয়ে গেছেন। আমাদের একটা প্ল্যান ছিল। বোলাররা তার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। একবার রুবেল আরেকবার আন্দ্রে রাসেল রুশোকে প্রথম বলেই সাজঘরে ফেরত পাঠিয়েছেন।
জাগো নিউজ: এই প্রথম বিপিএলে দু’জন দেশী কোচ ফাইনালে। আপনি ঢাকার আর সালাউদ্দীন কুমিল্লার কোচ। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
খালেদ মাহমুদ সুজন: আমার অনুভূতিটা দারুণ। বলে বোঝাতে পারবো না কতটা ভাল লাগছে। টম মুডি, মাহেলা জয়বর্ধনে, ওয়াকার ইউনুস আর ল্যান্স ক্লুজনার চারজনই নামী ক্রিকেটার। বিশ্ব ক্রিকেটে যাদের সবাই এক নামে চেনে। তারা কোচ হিসেবেও সমাদৃত, নামী, হাই প্রোফাইল। তাদের সাথে আরেকজন সায়মন হেলমটও ছিলেন। এই পাঁচজন বিদেশী হাই প্রোফাইল কোচকে টপকে ও পেছনে ফেলে সালাউদ্দীন আর আমি মানে আমাদের দল ফাইনালে- ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছে।
সত্যিই এক অন্যরকম ভাল লাগায় আচ্ছন্ন মন। শুধু ভাল লাগাই নয়, আমার মনে হয় এটা আমাদের একটা অন্যরকম জয়। বলতে পারেন নৈতিক জয় । আমার মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট যে দিনকে দিন সামনে এগুচ্ছে আমাদের দুই দেশী কোচের দলের ফাইনাল পর্যন্ত উঠে আসা তার একটা প্রামাণ্য দলিল। আমি বিশ্বাস করি শুধু জাতীয় দল মাঠে ভাল খেলে যাকে তাকে হারালেই চলবে না। ক্রিকেটে উন্নতি করতে হলে ক্রিকেটারদের পাশাপাশি কোচিং, আম্পায়ারিং এবং ভাল উইকেট নির্মাণ- এসব জায়গায় উন্নতি একান্তই জরুরী। আমাদের দুই কোচের বিপিএল ফাইনাল খেলাটা সেই অগ্রযাত্রারই অংশ বলে আমি মনে করি।
এআরবি/এসএএস/এমএস