ঢাকার বিপক্ষে ‘সেমিফাইনালে’ যেসব চ্যালেঞ্জ মাশরাফিদের সামনে
‘রংপুর রাইডার্সের হয়ে কথা বলতে মিডিয়ার সামনে আসবেন কে? দল হেরে গেছে। মাশরাফি কি আসবেন?’- খুব বড় গলায় কেউ এমন প্রশ্ন না করলেও কারো কারো মনে চাপা সংশয় ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সোমবার রাতে প্রেস মিটে ঠিক এসে হাজির রংপুর রাইডার্স অধিনায়ক।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে কেয়ালিফায়ার-১’এ ৮ উইকেটের হেরে যাবার পর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শামিম আশরাফ চৌধুরীর সাথে কথোপকথন শেষে মিডিয়া ম্যানেজার আহসানুর রহমান মল্লিকের সঙ্গে মিডিয়া কনফারেন্স হলের দিকে হাটা দিলেন মাশরাফি।
জিতলেই ফাইনাল, এমন এক হিসেব সামনে রাখা ম্যাচে হেরে যাওয়া। এরকম অবস্থায় তো আর কেউ প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। খানিক হতাশা অতৃপ্তিতো থাকবেই। মাশরাফিরও ছিল। চোখ মুখে সব সময়ের সে সজীবতা অনুপস্থিত। ঠোটের কোনের সেই স্মিত হাসিটাও ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে আসতেই কেটে গেল সব হতাশার অন্ধকার। দেশের এক ঐতিহ্যবাহী পত্রিকায় কর্তব্যরত কুমিল্লার এক সাংবাদিককে জড়িয়ে ধরে শুরু হয়ে গেল খুঁনসুঁটি।
শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের উত্তর দিক মানে মিডিয়া ভবনের সামনের সাইট স্ক্রিনের অন্তত ২০ গজ দুর থেকে কনফারেন্স হলে ঢোকার আগে মিনিট তিনেক ঐ সাংবাদিকের সাথেই রসিকতা চললো। দেখা মিললো সেই চিরচেনা প্রাণখোলা ও উচ্ছল মাশরাফির।
তারপর সংবাদ সম্মেলনেও সে অর্থে হতাশার ছাপ ছিল কম। মোটামুটি স্বাভাবিক আর মনের দিক থেকে স্থিরই মনে হলো রংপুর ক্যাপ্টেনকে। কথা শুনে ও শরীরী অভিব্যক্তি দেখে পরিষ্কার মনে হলো বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ৬ ফেব্রুয়ারির জন্য নিজেকে ও দলকে তৈরীর কথা ভাবছেন তিনি।
কুমিল্লার সাথে ম্যাচ হারে হয়ত ফাইনালের টিকিট হাতে আসেনি। তাই বলে আর আসবে না ভেবে অস্থির হবারও কিছু নেই। মাশরাফি খুব ভালই জানেন যা হয়নি তা নিয়ে হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়লে আর লাভ নেই। এখন সামনের কথা ভেবে নিজেকে এবং দলকে তৈরী করতে হবে। তার ভালই জানা, ৬ ফেব্রুয়ারি শেরে বাংলায় ঢাকা ডায়নামাইটসকে কোয়ালিফায়ার-২ তথা অঘোষিত সেমিফাইনাল ম্যাচে হারাতে পারলেই ফাইনালের টিকিট।
তাই গলার সর যতটা সম্ভব ঠিক রেখেই বলে উঠলেন, ‘আমাদের তো সব শেষ হয়ে যায়নি। আরও একটি ম্যাচ আছে। সেটা যেন আবারও এক সেমিফাইনাল।’
রংপুর অধিনায়ক অমন কথা বলতেই পারেন। কাগজে কলম আর গাণিতিক সমীকরণ যাই বলা হোক না কেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে বড় হারের পরও ফাইনাল খেলার যথেষ্ঠ সুযোগ এবং সম্ভাবনা আছে মাশরাফির দলের।
কোয়ালিফায়ার-১’এ হেরে যাওয়ার কারণে নিয়ম ও রীতি মেনে এখন তাদের কোয়ালিফায়ার-২ খেলতে হবে। আগামীকাল (বুধবার) সন্ধ্যায় সেই ম্যাচ ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে।
গত কাল রাতে খেলা শেষ হবার মুহূর্ত থেকে মাশরাফির চিন্তায় ঢুকে গেছে কীভাবে অ্যালেক্স হেলস আর এবি ডি ভিলিয়ার্স ছাড়াও ঢাকার বিপক্ষে অঘোষিত সেমির যুদ্ধে জেতা যায়। ঐ জয়ের চিন্তা আসার আগে ভাবতে হচ্ছে সোমবার কুমিল্লার বিপক্ষে ভুল ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা এবং তা কাটিয়ে ওঠার কার্যকর উদ্যোগ- কৌশল নেয়ার ব্যাপারে।
অঘোষিত সেমির লড়াইয়ের আগে নিজ দলের একটি জায়গা মেরামত করার কথা একটু বেশী করে ভাবতে হচ্ছে মাশরাফিকে। পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে হাত খুলে খেলা নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন জোর দিয়ে। মাশরাফির অনুভব ও উপলব্ধি, পাওয়ার প্লে’তে তার দলের রান অনেক কম হয়েছে। সেখানে অন্তত ১৫ থেকে ২০ রান বেশী হলে ভাল হতো।
সোমবার রাতে খেলা শেষে কুমিল্লার বিপক্ষে পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাশরাফি সবার আগেই বলে ওঠেন, ‘আসলে সন্ধ্যার পর উইকেটের চেহারা ও আচরণ পাল্টে যায়। তখন রান ওঠে বেশি। এ উইকেটে আমাদের যা করা উচিৎ ছিল, তার চেয়ে অন্তত ১৫-২০/২৫ রান কম করেছি।’
কিন্তু শেষদিকে বিশেষ করে ১৬-২০ শেষ ৫ ওভারে বেনি হাওয়েল আর রিলে রুশো ঝড়ের বেগে ওভার পিছু প্রায় ১৫ রান করে ৭৪ রান তুলে দিয়েছেন।
তারপরও রান কম হয়েছে, ঠিক কোথায় ঘাটতি? জানতে চাওয়া হলে রংপুর ক্যাপ্টেন সরাসরি জানিয়ে দেন, ‘আসলে পাওয়ার প্লে’র ছয় ওভারে আমরা রান কম করে ফেলেছি। সেটাই শেষ পর্যন্ত কম হয়ে গেছে।’
পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে তার দলের টপ অর্ডারদের হাত খুলে খেলার তাগিদ কম ছিল- এমনটা জানিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আমাদের ঢাকার বিপক্ষে ম্যাচে পাওয়ার প্লে’তে হাত খুলে খেলার তাগিদটা বাড়াতে হবে।’
এ কথার পিছনে মাশরাফি একটি জোরালো যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। তার ভাবটা এমন- যদি পাওয়ার প্লে’র শুরুতে উইকেট পড়ে কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী উইকেটের পতন ঘটে- তাহলে রান কম উঠতেই পারে। তখন ব্যাটসম্যানরা রানের পেছনে ছোটার চেয়ে উইকেট অক্ষত রাখার চেষ্টাই করবেন বেশী। কিন্তু কুমিল্লার বিপক্ষে তার দলের সে অবস্থা ছিল না। ওপেনার অ্যালেক্স হেলস আর চার নম্বর এবি ডি ভিলিয়ার্স চলে যাওয়ায় বড় শুন্যতা দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে একজন ওপেনার আর একজন মিডল অর্ডার সংকট।
অ্যালেক্স হেলসের বদলে মেহেদি মারুফ ক্রিস গেইলের ওপেনিং পার্টনার হিসেবে খেলেছেন। কিন্তু হেলসের ধার কাছ দিয়েও যেতে পারেননি। হেলস আর এবি ডি ভিলিয়ার্স না থাকায় রুশোকে খেলানো হয়েছে এবি ডি ভিলিয়ার্সের জায়গায় চার নম্বরে। তিন নম্বরে খেলেছেন মিঠুন।
একদিকে কুমিল্লার দুই অফস্পিনার মেহেদি হাসান আর সঞ্জিত সাহা মিলে বাঁহাতি গেইলকে হাত খুলে খেলা থেকে অনেকটাই বিরত রেখেছিলেন। কিন্তু দুই ডান হাতি মেহেদি মারুফ আর মিঠুনও কুমিল্লার ঐ দুই অফস্পিনারের বিপক্ষে ছয় ওভারের পাওয়ার প্লে’তে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে পারেননি। তাই পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে রান উঠেছে মাত্র ৩৪।
তাই মাশরাফি বলেন, ‘ঐ জায়গায় আরও রান তোলার তাগিদ বাড়াতে হবে। সেখানে কার্যকর কিছু করার চিন্তাও করতে হবে।’
অধিনায়কের কথায় একটা অস্ফুট ইঙ্গিতও আছে। হয়ত ক্রিস গেইলের সঙ্গে রংপুরের ওপেনিং জুটিতে পরিবর্তন আসতে পারে। তিন বলে ১ করা মেহেদি মাহরুফের বদলে অন্য কাউকে ওপেনারের ভুমিকায় দেখা যেতে পারে। একই ভাবে মোহাম্মদ মিঠুনের অবস্থাও খারাপ। যদিও রান আউট হয়েছেন, তারপরও স্ট্রাইকরেটের (তিন বলে ৩) অবস্থা ভাল ছিল না।
এদিকে রংপুর অধিনায়ক পড়েছেন আরেক সমস্যায়। দলে সে মানের স্পিনার নেই। এক কথায় কার্যকর স্পিনার সংকট। সেখানে ঢাকায় সাকিব ও সুনিল নারিনের মত বিশ্ব মানের দু’দুজন অফস্পিনার। তাদের সামলানো কঠিন।
সেখানে রংপুরে সে অর্থে সাকুল্যে স্পিনারই মোটে দুজন; সোহাগ গাজী আর নাজমুল অপু। এ দুইয়ের সঙ্গে আছেন খণ্ডকালীন স্পিনার নাহিদুল ইসলাম। আবার গাজী-অপুকে একসঙ্গে খেলানো কঠিন। তাহলে একজন পেসার কমে যায়। কিন্তু তার সাথে শফিউল আর ফরহাদ রেজা বেশ ভাল বল করছেন। নিয়মিত ব্রেক থ্রু উপহার দিচ্ছেন।
উপুল থারাঙ্গা আর সুনিল নারিন দুই বাঁহাতি টপ অর্ডারের বিপক্ষে শুরুতেই যে এক অফস্পিনার দরকার পড়বে। সে কারণে অফস্পিনার সোহাগ গাজীকে বসিয়ে বাঁহাতি নাজমুল অপুকে খেলানোও যে সমস্যা। ফলে তাদের বাইরে রাখার প্রশ্নই আসে না। কাজেই মাশরাফি মুখে শুধু পাওয়ার প্লে’তে রান গতি বাড়ানোর তাগিদ দিলেও কালকের বাঁচা মরার লড়াইয়ে দল সাজানা বা টিম কম্বিনেশন ঠিক করাও বড় চ্যালেঞ্জ।
দেখা যাক, মাশরাফি এই চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে মোকাবিলা করেন?
এআরবি/এসএএস/জেআইএম