লো স্কোরিং ম্যাচ অথচ এক রূদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের গল্প
এবি ডি ভিলিয়ার্স ঠিকই বলেছিলেন, শুধু বিগ স্কোর হলে, আর চার ও ছক্কার ফুলঝুরি ছুটলেই খেলা জমবে- এমন কোন কথা নেই। লো স্কোরিং গেমও জমতে পারে।
তাই তো চট্টগ্রামের ডি ভিলিয়ার্সের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল এমন কথা, ‘সব উইকেটই যদি ব্যাটিং সহায়ক হয়, সব উইকেটেই যদি চার ও ছক্কার ফুলঝুরি ছোটে, রানের ফলগুধারা বয়- তাহলে খেলা জমবে না। বরং তা একপেশে ও বিরক্তিকর মনে হবে।’
তার ভাবটা ছিল এমন, টি-টোয়েন্টি মানেই বিগ হিটিং, পিঞ্চ হিটিং, চার ও ছক্কার অবাধ প্রদর্শনী এবং ১৮০ প্লাস স্কোরের খেলা নয়। শুধুই ব্যাটসম্যানদের কর্তৃত্ব ফলানোর ক্ষেত্রও নয়। কখনো কখনো কম রানের খেলাও জমে উঠতে পারে। লো স্কোরিং ম্যাচেও ব্যাটসম্যানদের ওপর প্রভাব ও কর্তৃত্ব খাটিয়ে বোলাররাও ম্যাচ ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন।
একদম শতভাগ সত্য কথা। আজ (শুক্রবার) রানার্সআপ ঢাকা ডায়নামাইটস আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ‘লো স্কোরিং গেমটাও’ দারুণ জমে উঠেছিল। এক কথায় টান টান উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ঠাসা এক ম্যাচ হলো শুক্রবার ছুটির দিনে।
যেখানে ১২৭ রানের মামুলি পুঁজি নিয়েও শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়ল ইমরুল ও তামিমের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ন্স। যে ম্যাচের হিরো কোন ব্যাটসম্যান নন, একজন বোলার; কুমিল্লার মিডিয়াম পেসার সাইফউদ্দিন।
২২রানে ৪ উইকেট দখলের পাশাপাশি ডেথ ওভারে মাপা ও বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং করে দলকে ১ রানের অবিস্মরণীয় জয় উপহার দিয়ে ম্যাচ সেরা হলেন সাইফউদ্দিন। চট্টগ্রামে পাঁচ দিন হেলস, রুশো, এবি ডি ভিলিয়ার্স, লরি ইভান্সরা ব্যাট হাতে মাঠ মাতিয়েছেন।
এবার ঢাকায় শেষ পর্বের প্রথম ম্যাচে দু’দলের সব তারকা ব্যাটসম্যানদের পেছনে ফেলে ম্যাচের আলোচিত ও সেরা পারফরমার সাইফউদ্দিন।
এবারের আসরে শেরে বাংলায় বেশ কয়েকটি ম্যাচেই গড়পড়তা স্কোর ১২০-১৩০ রান উঠেছে। কিন্তু তার বেশীর ভাগই জমেনি। একতরফাভাবে শেষ হয়েছে। তবে আজকের খেলাটি ব্যতিক্রম। এ ম্যাচে আগে ব্যাট করা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ১২৭ রানে অলআউট হয়েছে। জবাবে ঢাকা ডায়নামাইটস ২০ ওভারে ১২৬ রানে আটকে গেলো। কিন্তু খেলা হয়েছে পুরো ২০ + ২০ = ৪০ ওভার।
পুরো খেলায় কুমিল্লা ওপেনার তামিম ইকবালের ৩৮ রানই সর্বোচ্চ। এছাড়া ঢাকার দুই ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান কাইরন পোলার্ড (৩৪) আর আন্দ্রে রাসেল (৩০ নটআউট) উল্লেখযোগ্য স্কোরার। গোটা ম্যাচে নজরকাড়া পারফরমারদের সবাই বোলার- ঢাকার রুবেল হোসেন ৪/৩০, সাকিব ২/২৩ ও সুনিল নারিন ২/২৫ আর কুমিল্লার সাইফউদ্দিন ৪/২২, মেহেদি হাসান ২/২২।
কিন্তু সেই বোলারদের নৈপুণ্যও আজ দর্শক এবং ঢাকা ও কুমিল্লার ভক্ত) সমর্থকরা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। পুরো ম্যাচে ওঠা-নামার পালা ছিল দারুণ। কখনো বোলাররা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের টুটি চেপে ধরেছেন। আবার কখনো ব্যাটসম্যানরা বোলারদের ওপর চেপে বসেছেন।
মোটকথা, পুরো ম্যাচের পরতে পরতে উত্তেজনা-আকর্ষণ ছিল। শেষ ওভারে ঢাকার জয়ের জন্য দরকার ছিল ১৩ রানের। সাইফউদ্দিনের করা শেষ ওভারের প্রথম বলে ব্যাটে সংযোগ ঘটাতে না পেরে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়িয়ে বিদায় নেন ঢাকার পেসার রুবেল হোসেন।
উইকেটে আসেন আরেক পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীব। প্রথম বলে সিঙ্গেলস নিয়ে অপর প্রান্তে ১৯ বলে ২১ রানে নট আউট থাকা আন্দ্রে রাসেলকে স্ট্রাইক দেন শাহাদাত হোসেন রাজীব। তৃতীয় ও চতুর্থ বলে কোন রান নিতে পারেননি আন্দ্রে রাসেল। যে কারণে শেষ দুই বলে ঢাকার দরকার পড়ে ১২ রানের।
তৃতীয় বলটি শর্ট কভারে পুশ করেন। আর চার নম্বর বল তার ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় উইকেটরক্ষক এনামুল হক বিজয়ের গ্লাভসে। পাঁচ নম্বর ডেলিভারিতে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে বসেন ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার আন্দ্রে রাসেল।
আন্দ্রে রাসেল তার নাগাল বা আয়ত্বে বল পেলেই উড়িয়ে মারবেন। গুড লেন্থ, ফুল লেন্থ, এমনকি থ্রি কোয়ার্টার লেন্থে বল ফেলাও নিরাপদ নয়। সামনে এসে লং অফ, লং অন কিংবা বোলারের মাথার ওপর দিয়ে সোজা তুলে সীমানার ওপারে পাঠাবেন। আর শর্ট বল করলে নির্ঘাত ছক্কা খেতে হবে।
তাই ইয়র্কার লেন্থই হতে পারে আদর্শ জায়গা। সাইফউদ্দিন পঞ্চম ডেলিভারিটি অফ স্ট্যাম্পের অন্তত ফুট খানেক বাইরে ওয়াইড ইয়র্কার ছোড়েন। ওই বলকে ছক্কা হাঁকানো খুব কঠিন ছিল। বড়জোড় পয়েন্টের ওপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানো সম্ভব ছিল; কিন্তু সবাইকে অবাক করে বলের ঠিক পিছনে না গিয়ে শরীর একটু দুরে রেখে সেই বলকে কভার ও এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে তুলে ছক্কা হাঁকিয়ে বসেন আন্দ্রে রাসেল।
সুতরাং, শেষ বলে প্রয়োজন পড়ে ছয় রানের। ছক্কা মারতে পারলেই জয় ঢাকার; কিন্তু সাইফউদ্দিনের পারফেক্ট ইয়র্কার পায়ের ওপর গিয়ে পড়লে আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি রাসেলের। বল তার ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে ফাইন লেগ দিয়ে সীমানার ওপারে চলে গেলেও ১ রানের রূদ্ধশ্বাস এক জয় নিশ্চিত হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের।
কম রানের অথচ ব্যাট ও বলের টান টান উত্তেজনা ও আকর্ষণীয় লড়াই দেখলো শেরে বাংলা। যা অনেকেরই স্মৃতিপটে আঁকা থাকবে বহুদিন।
এআরবি/আইএইচএস/এমকেএইচ