তবে কি এবারো চ্যাম্পিয়ন মাশরাফির রংপুর!
ক্রিকেট খেলাটাই অনিশ্চয়তায় ভরা। তাই বলাই হয়ে থাকে, ‘ক্রিকেট ইজ এ গেম অফ গ্লোরিয়াস আনসার্টেনিটি (ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তায় ভরা)।’ আর সেটা টি-টোয়েন্টি হলে তো কথাই নেই। ক্রিকেটের এই ফরম্যাট পুরোই অনিশ্চয়তায় ভরা। যাতে নিশ্চিত বলে কিছু নেই। ২০ ওভারের ক্রিকেটের পরতে পরতে ঠাসা উজ্জেনা। পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে পুরো ম্যাচ। শেষ বলে কিছু নেই। যে কোনো দিন, যখন তখন যে কোন ঘটনাই ঘটে যেতে পারে। এমনকি ঘটেও।
এই যেমন শুক্রবার রাতে ঘটলো তেমনই। বলা নেই, কওয়া নেই- হঠাৎ রান বন্যায় ভাসলো জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। চার-ছক্কার অবাধ প্রদর্শনীও ঘটলো। সবচেয়ে বড় কথা- দর্শক বিনোদন টি-টোয়েন্টি সত্যিকার আস্বাদন- সবই মিললো। যার জন্য হাহাকার না হোক, হা-পিত্যেশ ছিল এতদিন। এক ম্যাচের এক ইনিংসে সেঞ্চুরি করে ফেললেন রংপুর রাইডার্সের দুই ভিনদেশি অ্যালেক্স হেলস আর রিলে রুশো। ঠিক রান খরায় না ভুগলেও তেমন রান হচ্ছিল না এবারের বিপিএলে। হাই স্কোরিং গেম বলতে যা বোঝায় তাও হচ্ছিল কম।
কিন্তু শুক্রবার চট্টগ্রাম পর্বের প্রথম দিন দ্বিতীয় ম্যাচে সেই কমতির বদলে অনেক বেশি রানের দেখা মিললো। শীর্ষে থাকা চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে রংপুর রাইডার্স ২৩৯ রানের হিমালয় সমান স্কোর গড়ে ফেললো মাশরাফির দল। এক ইনিংসে বিপিএলের দু’দুটি নতুন রেকর্ড হলো।
একটি সর্বোচ্চ রানের। এর আগে বিপিএলের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ (২১৭) স্কোরটি ছিল ঢাকা ডয়নাইমাইটসের। রংপুরেরর বিপক্ষে ২০১৩ সালে। আর দ্বিতীয়টি হলো, এক ইনিংসে দুই সেঞ্চুরির রেকর্ডটি শুধু বিপিএলেই নয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসেই ঘটলো মাত্র তৃতীয় বার।
কাজেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হলো পূর্ব বার্তা বা সঙ্কেত না দিয়ে প্রবল ঝড় বইয়ে দেয়ার নাম!কিন্তু সেই অনিশ্চয়তায় ভরা ফরম্যাটেও একটি প্রায় নিশ্চয়তার বার্তা মিলেছে শুক্রবার রাতে। তাহলো, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের যে উইকেটে খেলা হয়েছে, পিচ যেমন ব্যাটিং বান্ধব ছিল- তেমন থাকলে সামনের চার দিনে আরও ঝড়ো উইলোবাজির দেখা মিলবে।
তারচেয়ে বড় কথা এমন নির্ভেজাল ব্যাটিং ট্র্যাকে খেলা হলে রংপুর রাইডার্সের পাল্লাই সবচেয়ে ভারি থাকবে। মানে মাশরাফির দলকে আটকানো কঠিন হবে।
তার প্রমাণ তো কালকের ম্যাচের স্কোরকার্ড; টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিধ্বংসী ওপেনার ক্রিস গেইল নীরব, নিস্ক্রীয়। মাত্র ২ রানে আউট। ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ব্যাটিং শৈলির অধিকারী যিনি, একটি ভাল বলকেও নিজের মত করে ফিল্ডারের নাগালের বাইরে দিয়ে মনগড়া শটে সীমানার ওপারে পাঠাতে যার জুরি মেলা ভার- সেই এবি ডি ভিলিয়ার্সও রান পাননি। ফিরে গেছেন ১ রানে; কিন্তু তারপরও ২০ ওভার শেষে রংপুরের স্কোরবোর্ডে শোভা পাচ্ছিল ২৩৯ রান।
এর মানেটা খুব পরিস্কার। এবারের বিপিএলে সবচেয়ে বিধ্বংসী উইলোবাজ রয়েছে রংপুর রাইডার্সে। যার দু’জন অ্যালেক্স হেলস এবং রিলে রুশো আগের রাতে জোড়া সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছেন। বাকি দু’জনের মানে গেইল ও ডি ভিলিয়ার্স এ উইকেটে ঝড় তোলার, প্রতিপক্ষ বোলিং দুমড়ে মুচগে চার ও ছক্কার নহর বইয়ে স্কোর বোর্ডটাকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে যাবার পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখেন।
তারাও নিশ্চয় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। এমন ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে তাদেরও হয়ত হাত নিশ-পিশ করছে। গেইল আর ডি ভিলিয়ার্স জ্বলে উঠলে কি হবে? ভাবুন একবার!
ভক্ত-সমর্থক হবার দরকার নেই। অতিবড় সমালোচকও শুক্রবার রাতে ম্যাচ শেষে মানছেন, ‘জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট এমন ব্যাটিং সহায়ক থাকলে রংপুর রাইডার্স যে কারো চেয়ে শক্তিশালী, বিপজ্জনক ও কঠিন প্রতিপক্ষ।’
তাই শুক্রবার রাতে এক সহযোগি সাংবাদিকের রসিকতা, ‘আরে এ উইকেট তো রংপুর রাইডার্সের জন্য পয়োমন্তঃ ভেন্যু। ফাইনাল পর্যন্ত বিপিএলের সবকটা ম্যাচ যদি চট্টগ্রামের এমন ব্যাটিং উইকেটে হয়- তাহলে মাশরাফির দলকে আটকায় এমন সাধ্য কার? তারা অনায়াসে হেঁটে হেঁটে ট্রফি জিতে নেবে।’
ওই সহযোগি সাংবাদিকের এমন মন্তব্যকে শুধু রসিকতা ভাবার কোনই কারণ নেই। সেটা ঘটাই বাস্তব। চরম সত্য। আগের বারও সত্যেরই দেখা মিলেছিল। ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর জনসন চার্লস- তিন বিধ্বংসী উইলোবাজের রথে চড়েই সাফল্যের আকাশে উড়েছিল রংপুর।
এবার গেইলের সাথে আছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স, অ্যালেক্স হেলস আর রিলে রুশো। যাদের আছে বিগ হিট নেবার সর্বোচ্চ ক্ষমতা। উইকেট ভালো থাকলে, মানে বল ঠিক গতি ও বাউন্সে ব্যাটে আসলে আর ম্যুভমেন্ট কম থাকলে তারা যে কোন বোলিংকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারেন।
শতভাগ ব্যাটিং কন্ডিশন পেলে তাদের রান করতে বড় শট খেলতে আর বাজে ও আলগা ডেলিভারির অপেক্ষায় থাকতে হয় না। একটা ভাল বলকেও অনায়াসে মুড়ি মুড়কির মত হাওয়ায় উড়িয়ে সীমানার ওপারে পাঠাতে পারেন। গেইল, হেলস, রুশো আর ডি ভিলিয়ার্সের বিগ শট খেলার ইচ্ছে যেমন প্রবল, দক্ষতা-পারদর্শিতাও অনেক। সাথে বড় শটে সীমানার ওপারে পাঠানোর শক্তিও প্রচুর।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই খুনে মনসিকতা আর ‘বিগ হিট’ নেবার মত পারফরমার এবারের বিপিএলে আছেন হাতে গোনা ক’জন মাত্র। কুমিল্লার স্টক উইলোবাজ এভিন লুইস, খুলনা টাইটান্সের পল স্টার্লিং, রাজশাহী কিংসের লরি ইভান্স আর চিটাগাং ভাইকিংসের রবি ফ্রাইলিংক আছেন ঐ কাতারে। তার মানে অন্য দলে গড়ে একজন করে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান।
তারাও সবাই টপ অর্ডার নন। কেউ মিডল অর্ডার আবার কেউবা নিচের দিকে ব্যাট করেন। আর সেখানে রংপুরের চার-চারজন বিপজ্জনক আর অতি আক্রমণাত্মক উইলোবাজ। কাকতালীয়ভাবে সবাই ওপরের দিকে ব্যাট করেন। ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম চার ব্যাটসম্যানই হলেন গেইল, অ্যালেক্স হেলস, রিলে রুশো আর এবি ডি ভিলিয়ার্স। প্রথম দু’জন ওপেন করেন। রুশো তিন আর ডি ভিলিয়ার্স চারে খেলেন।
খেলাটি মাত্র ২০ ওভারের; অর্থ্যাৎ ১২০ বলের। সে ফরম্যাটে এমন চারজন খুনে মানসিকতাসম্পন্ন আর বড় শটস খেলার পর্যাপ্ত সামর্থ্যবান ব্যাটসম্যানই যথেষ্ঠ। তারা সবাই দাড়িয়ে গেলে যে কি হবে! তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়ত, প্রলয় বয়ে যাবে! অন্ততঃ দু’জনার ব্যাট কথা বললেও যে আর কিচ্ছু লাগে না, লাগার কথাও না, লাগবেও না- তাতো শুক্রবার রাতেই জানা গেলো।
তাই অন্ধের মত রংপুরের পক্ষে বাজি ধরাই যায়। বলে দেয়া যায়, যত অনিশ্চয়তায় মোড়ানোই থাকুক না কেন, উইকেট যদি ভাল থাকে, বল ঠিক গতি ও উচ্চতায় যদি ব্যাটে আসে- তাহলে এবারো রংপুর রাইডার্সের পাল্লা অনেক বেশি ভারি। সম্ভাবনা খুব বেশি। মাশরাফির দলকে আটকানোর ক্ষমতা আসলে অন্য কোন দলের নেই।
শুক্রবারের ম্যাচ শেষে চিটাগং ভাইকিংস অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম অকপটে স্বীকার করেছেন, এমন বিধ্বংসী আর ব্যাটিং ঝড় সামলানো সত্যিই কঠিন। আসলে অসহায়ই মনে হয়। তার ধরা গলায় মন্তব্য, ‘আসলে রংপুরের ব্যাটিং লাইনআপে এমন চারজন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান আছেন, যারা জ্বলে উঠলে তাদের আটকে রাখা খুব কঠিন।’
অন্যদিকে রংপুর অধিনায়ক মাশরাফি মনে করেন, ‘গেইল, হেলস, রুশো আর ডি ভিলিয়ার্সের মত চার-চারজন অতি আক্রমণাত্মক উইলোবাজ দলে থাকা এক বিরাট স্বস্তি। ড্রেসিং রুমে চিন্তা কম থাকে। তার ভাষায় এতে করে জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে।’
মাশরাফির উপলব্ধি, এখনও পর্যন্ত যে তিন ভেন্যুতে (রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা, সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম আর জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম) খেলা হয়েছে, তার মধ্যে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেটকেই তার সবচেয়ে ব্যাটিং বান্ধব উইকেট বলে মনে হয়েছে। মাশরাফির অনুভব, তার দলের ব্যাটিং লাইনআপ বিশেষ করে টপ ও মিডল অর্ডারের সাথে এমন ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি পিচ সবচেয়ে যুতসই ও মানানসই।
শুক্রবার রাতে খেলা শেষে প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্ন উঠল, আচ্ছা! পুরো আসরে এমন পিচ কি মিস করেছেন? চট্টগ্রামের শতভাগ ব্যাটিং সহায়ক পিচই কি রংপুর রাইডার্সের জন্য আদর্শ বা অনুকুল ক্ষেত্র?
মাশরাফি একটু ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছেন। যার সারমর্ম হলো, সাগরিকার এই উইকেটটিই তার দলের জন্য সবচেয়ে অনুকুল। কারণ তার দলের ওপরের চার ব্যাটসম্যানই ফ্রি স্ট্রোক মেকার। বল ব্যাটে আসলে তাদের স্বচ্ছন্দ ও সাবলিল ব্যাটিং করতে সুবিধা হয়। তারা নিজেদের মত করে খেলতে পারেন।
আর গেইল, হেলস, রুশো ও ডি ভিলিয়ার্সরা নিজের মত করে খেলতে পারলে কি হয়, কি হবে? তা কি আর নতুন করে বলার দরকার আছে? মাশরাফি আর মুশফিকের কথা থেকে কি বেড়িয়ে আসলো?
উইকেট যদি ব্যাটসম্যানদের বন্ধু হয়, তাহলে গেইল, হেলস, রুশো আর ডি ভিলিয়ার্সের রংপুর বাকি দলগুলোর চেয়ে ঢের এগিয়ে। তার মানে এবারো শেষ হাসি তাহলে মাশরাফির রংপুরেরই?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম