অথচ সুযোগ পাওয়া নিয়েই সংশয় ছিল ‘সেঞ্চুরিয়ান’ ইভান্সের
শুরুতে যাদের দিয়ে সাজানো হয়েছিল রাজশাহী কিংসের ওপেনিং জুটি, সেই সৌম্য সরকার (৪+১১+০+১৮+২) আর মুমিনুল হক (৮+৪৪+৩+১৪+৭) নিজেদের নামের প্রতি সুুবিচার করতে পারেননি একদমই।
তাদের মান অনুযায়ী রীতিমত খারাপই খেলেছেন। ক্রিকেটীয় ভাষায় মুুমিনুল ও সৌম্য ফর্মে নেই। ভক্ত-সমর্থক ও অনুরাগিদের মন খারাপ হলেও কঠিন বাস্তবতা হলো ঐ দুই বাঁহাতিকে শেষ পর্যন্ত বাইরে রেখেই দল সাজাতে বাধ্য হয়েছে রাজশাহী কিংস।
ওপেনিং সংকট কাটাতে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে এসে শাহরিয়ার নাফীসকে খেলানো হচ্ছে। অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ পরিবর্তিত ওপেনার হিসেবে তিন ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। মানে রাজশাহী কিংসের শুরু ভালোর বদলে দিনকে দিন খারাপই হচ্ছিল।
অবশেষে ইনিংসের শুরু ভাল করতে লরি ইভান্সের শরনাপন্ন হওয়া। এবার শুরু থেকেই আছেন দলে। তবে ওপেনার হিসেবে নয়। ৩১ বছর বয়সী এই ইংলিশ ওপেনার নন। দলে তার পজিশন মূলত মিডল অর্ডার। এবারের আসরে প্রথম চার ম্যাচ খেলেছেন মিডল অর্ডারে; চার থেকে ছয়ে।
প্রথম দিন ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে নেমেছিলেন চার নম্বরে। রান করতে পারেননি। ফিরে যান ১৩ বলে ১০ রানে। তারপর পজিশন বদল। খুলনা টাইটান্সের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে পাঁচ নস্বরে নেমে ১ রানে থাকেন নট আউট। তিন ও চার নম্বর খেলায় ব্যাটিং পজিসন আরও এক ধাপ নিচে নামে।
তিন নম্বর ম্যাচে ঢাকার বিপক্ষে ছয় নম্বরে খেলতে নেমে শহীদ আফ্রিদীর বলে ০ রানে লেগ বিফোর হয়ে ফেরা। চার নম্বর ম্যাচে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ছয় নম্বরে নেমে ২ (৭ বলে) রানে আউট। মানে চার থেকে ছয়- তিন পজিশনে চার ম্যাচ খেলে সাকুল্যে ১৩ রান।
তারপর ১৫ জানুয়ারী সিলেটে খুলনা টাইটান্সের বিপক্ষে তাকে ইনিংসের সূচনার দায়িত্ব দেয়া। সেখানেও চরম ব্যর্থ। খুলনা পেসার জুনায়েদ খানের বলে ০ রানে আউট। ব্যাটিংয়ের এমন হতশ্রী অবস্থা যার, তাকে খেলানোয় আছে রাজ্যের ঝুঁকি।
দেশী আর বিদেশী নেই, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এতটা খারাপ খেলার পর কাউকে একাদশে রাখা আর ওপেন করতে পাঠানো রীতিমত বিস্ময়কর! সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই অভাবনীয় কাজটি করেছে রাজশাহী কিংস টিম ম্যানেজমেন্ট।
আজ (সোমবার) দুপুরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে খেলানো হলো এ ইংলিশকে। টিম লিস্টে ১১ জনে তার নাম দেখে প্রেস বক্সে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
এমনিতেই রানে নেই, তার ওপর ঠিক আগের ম্যাচে ওপেন করতে নেমে ফিরে গিয়েছিলেন ০ রানে, এরকম যার অবস্থা- সেই লরি ইভান্সকে আজ দুপুরে ওপেন করতে দেখে বিস্ময়ের মাত্রাটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। কিন্তু মাঠে নেমে সব হিসেব নিকেশ পাল্টে দিলেন লরি ইভান্স।
আগের পাঁচ ম্যাচের অনুজ্জ্বলতা ও ব্যর্থতা কাটিয়ে খেলে ফেললেন এক অনিন্দ সুন্দর ইনিংস। শুধু সুন্দর, নজরকাড়া আর দারুণ বললে কম বলা হবে। সম্ভবত তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা ব্যাটিংটাই করলেন। কারণ এই ফরম্যাটে আগে কখনো শতরান করা সম্ভব হয়নি তার।
আগের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৯৬। আজ শেরে বাংলায় সেই অধরা শতক স্পর্শ করলেন। ৬২ বলে ১০৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দিয়ে একদম ‘জিরো থেকে হিরো’ লরি ইভান্স। শেষ পর্যন্ত শক্তিশালি ও কঠিন প্রতিপক্ষ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রাজশাহী কিংসের জয়ের নায়কও এই ইংলিশ।
দলের অবস্থা ভাল ছিল না একদমই। শুরু ভাল হয়নি যথারীতি। ওপেন করতে নামা শাহরিয়ার নাফীস (৫), অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ (০) ও মার্শাল আইয়ুব (২) কিছুই করতে পারেননি। পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভার যেতেই (৬.১ ওভারে) ২৮ রানে সাজঘরে ঐ তিন টপ অর্ডার।
এরকম অনিশ্চিত সূচনা আর ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় দাড়িয়েও যে ভাল খেলা যায়, বড় ইনিংস সাজানো সম্ভব- তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন লরি ইভান্স। চাপের মুখে বিপদ ও সংকট কাটাতে শুরুতে বেশ কিছুক্ষণ খেলেছেন সতর্ক ও সাবধানে। তাই পঞ্চাশ করতে একটু বেশী (৪০ বল) সময় নিয়ে ফেলেছেন।
তারপর যেই না সঙ্গী হিসেবে রায়ান টেন ডেসকাটকে পাওয়া ঠিক তখনি খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে হাত খুলতে শুরু করা। তাই পরের পঞ্চাশ আসলো মাত্র ২১ বলে। শেষ পর্যন্ত ১৬৭.৭৪ স্ট্রাইকরেটে ৬২ বলে ১০৪ রানে নট আউট।
এই রানের ৭২ এসেছে শুধু চার (নয় বাউন্ডারিতে ৩৬) ও (ছয় ছক্কায় ৩৬) ছক্কায়। ডাবলস নিয়েছেন পাঁচটি। বাকি ২৪ শুধু সিঙ্গেলসে। বলার অপেক্ষা রাখে না ঐ ২৪ সিঙ্গেলসের বেশীর ভাগ নিয়েছেন পঞ্চাশের আগে। পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, ইভান্সের হাফসেঞ্চুরিতে ছিল পাঁচ বাউন্ডারি ও দুই ছক্কার মার।
এমন এক অসাধারণ ইনিংস গড়ার পথে ইভান্স সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের রায়ান টেন ডেসকাটকে। চতুর্থ উইকেটে ডেসকাটকে (৪১ বলে ৫৯) সাথে নিয়ে লরি ইভান্স ১৪৮ রানের বিশাল জুটি গড়ে ফেলেন।
যার ওপর ভর করে রাজশাহী পায় ১৭৬ রানের লড়াকু পুুঁজি। যা শেষ পর্যন্ত যথেষ্ঠ বলে প্রমাণ হয়। আর দলকে অমন লড়িয়ে পুঁজি গড়ার কারিগর হিসেবে ম্যাচ সেরা হন ইংলিশ লরি ইভান্স।
আগের চার ম্যাচে মোটে ১৩ রান করার পর সুযোগ পাওয়াই বড় বিস্ময়! এ ম্যাচ খেলা নিয়ে তার নিজেরও সংশয় ছিল। ইভান্স আশা করেননি আজ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে সুযোগ পাবেন। প্লেয়ার্স লিস্টে নিজের নাম দেখে তাই খানিক বিস্মিতও হয়েছিলেন!
খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে এসে লরি ইভান্স নিজেও অকপটে স্বীকার করলেন, ‘আগের ম্যাচগুলোয় আমি ভাল খেলিনি একদমই। রান পাইনি। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট তারপরও আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। কোচ এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিরা আমাকে খেলার সুযোগ দিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
লরি ইভান্সের কথা শুনে মনে হয়েছে আজকের ম্যাচের আগে কাল বিসিবি একাডেমি মাঠে অনুশীলনে তার পারফরমেন্স নিশ্চয়ই পাখির চোখে পরখ করেছেন কোচ ল্যান্স ক্লুজনার ও ম্যানেজার সাজ্জাদ আহমেদ শিপন (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার)।
রাজশাহী কিংস ফ্র্যাঞ্চাইজি ও টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লরি ইভান্স বলে ওঠেন, ‘জানি না কেন যেন আগের দিন প্র্যাকটিসে খুব ভাল লাগছিল। বিপিএল খেলতে আসার পর কালই প্রথম প্র্যাকটিসে ফুরফুরে লাগছিল।’
অনেক কথার ভীড়ে ইভান্স জানিয়ে দিয়েছেন তিনি খুব ভাল প্রস্তুতি নিয়ে বিপিএল খেলতে আসেননি। তাইতো মুখে এমন কথা, ‘আসলে আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগ আর টি-টেন খেলার পর আমি ক্রিকেট থেকে একটু দূরেই ছিলাম। এর মধ্যে আমি বিয়েও করেছি। সব মিলে আমি যখন বাংলাদেশে আসি তখন আসলে খুব ফর্মে ছিলাম না।’
একে তো ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা, তার ওপর এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন কন্ডিশনে কঠিন উইকেটে খেলতে নামা। সব মিলে রীতিমত বিপাকে পড়ে যাওয়া। তা স্বীকার করে ইভান্স বলেন, ‘এখানে উইকেট বেশ কঠিন। এবং আমার দেশের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন।’
কথায় বুঝিয়ে দিলেন, আজ সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি যে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তার কথা, ‘আমার জন্য আবারো ওপরে ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাওয়া ছিল বড় সুযোগ। আমি ভাল খেলতে মুখিয়ে ছিলাম। অনেক পরিশ্রমও করেছি। লক্ষ্য ছিল বেসিক মেনে খেলার চেষ্টা করা।’
এমন এক ইনিংস যে কারো জন্যই স্পেশাল। ইভান্সও মানলেন, ‘আজকের ইনিংসটা সত্যিই স্পেশাল। হ্যাঁ, এটা বিশেষ কিছু আমার কাছে। কারণ আমি আসলে এ ম্যাচ খেলার কথা ভাবিনি। আগের পারফরমেন্স তেমন ছিল না। তারপরও কোচ এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিরা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। তারা যে আমার সামর্থ্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন, তাই আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ ।’
ডেসকাটকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ঐ ডাচ ক্রিকেটারের প্রশংসা করে ইভান্স বলেন, ‘ডেসকাট সাপোর্ট দিয়েছেন ভালই। তার সাথে খেলতে গিয়ে আমি স্বস্তি পাই। এক পর্যায়ে আমরা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ওপর চাপ তৈরী করতে সক্ষম হই।’
এআরবি/এসএএস/এমএস