আফগান ‘সুলতানে’র বিপিএল বিজয়
গজনির সুলতান মাহমুদ ১৭বার দিল্লি বিজয় করেছিলেন। আফগান এই বীরের বীরত্বের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। কাবুল থেকে বেশি দুরে নয় গজনি। মাঝে ওয়ার্দাক আর লওগার, এরপরই গজনি। তার লাগো পাকতিয়া। এই জায়গাগুলো যেন ইতিহাসের বিচরণ ক্ষেত্র। গজনির পাশেই পাকতিয়া থেকে অভ্যুদয় আরেক নতুন সুলতানের। ব্যাট এবং বলকে ঢাল-তলোয়ার বানিয়ে যিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বকে জানান দিয়েছেন ক্রিকেটকে শাসন করতে এসেছেন।
আফগান ক্রিকেটের পোস্টার বয় কে? রশিদ খান, মুজিব-উর রহমান, মোহাম্মদ শাহজাদ, আসগর আফগান নাকি মোহাম্মদ নবি? কাউকেই পেছনে ফেলা যাবে না। একএকজন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে সমস্ত জঞ্জাল ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানো তারকা এরা। আফগানদের স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো এসব তারকার মাঝে আরও একটি লুব্ধকের দেখা মিলতে শুরু করেছে।
হজরতউল্লাহ জাজাই। মাত্র ২০ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং তাণ্ডবের খবর ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিকেট বিশ্বের আনাচে-কানাচে। টি-টোয়েন্টিতে বলতে গেলে আরও একটি রত্ন পেয়ে গেলো আফগানিস্তান। প্রথমবারেরমত আয়োজিত আফগান প্রিমিয়ার লিগে খেলতে গিয়েই গত অক্টোবরে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
জাজাইকে প্রথম চেনা সেদিনই। নিজের আদর্শ ক্রিস গেইলের বিরুদ্ধেই খেলতে নেমেছিলেন সেদিন। গেইলের ৪৮ বলে করা ৮০ রানের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের ওপর ভর করে বলখ লিজেন্ডস করে ২৪৪ রান। বিশাল স্কোর তাড়া করতে নেমে হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের কাবুল জাওনান জিততে পারেনি। হেরেছে ২১ রানে। ২৪৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে করেছিল ২২৩ রান।
কিন্তু জাজাই সেদিন যে কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, সেটাই বরং হাই স্কোরিং ম্যাচের চেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয়। এক ওভারের ৬ বলে টানা ৬টি ছক্কার মার মারেন তিনি। আবদুল্লাহ মাজারির ওভারের প্রতিটি বলকেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বাউন্ডারির ওপারে আছড়ে ফেলেন তিনি। ১২ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর ১৭ বলে ৬২ রান করে আউট হয়েছিলেন তিনি সেদিন।
কিন্তু ওই এক ওভারে ৬ ছক্কা দিয়েই সবার নজর কেড়ে নেন হজরতুল্লাহ জাজাই। নিজের ঝলক যে শুধু ওই এক ওভারের ৬ ছক্কার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন, তা নয়। হজরতুল্লাহ জাজাই একে একে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশনে নেমেছেন।
ধুমকেতুর মত হঠাৎ উদিত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আসেননি। সেটা জানান দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলতে এসেই। হজরতুল্লাহ জাজাই। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞা বলতে যাদের চোখে এতদিন গেইল, ডি ভিলিয়ার্সদের চেহারা ভেসে উঠতো, তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে এসেছেন জাজাই। ব্যাট হাতে তার মাঠে নামা মানেই যেন টর্নেডোকে সঙ্গে নিয়ে নামা।
তার সেই ঝলকই এখন দেখা যাচ্ছে বিপিএলের ৬ষ্ঠ আসরে। আফগান প্রিমিয়ার লিগে এক ওভারে তার মারা ৬ ছক্কা দেখেই ঢাকা ডায়নামাইটস ড্রাফট থেকে কিনে নেয় তাকে। রশিদ খান, মুজিবুর রহমানরা বিগ ব্যাশে খেলছেন। এ কারণে আসলেন বিপিএলে। আফগানদের বড় প্রতিনিধি হয়ে আসলেন জাজাই। কিন্তু তিনিই যে শেষ পর্যন্ত তুরুপের তাস হয়ে উঠবেন, সেটা কে জানতো!
বিপিএলে জাজাইয়ের অভিষেক হলো রাজশাহী কিংসের বিপক্ষে, উদ্বোধনী দিনেই। দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে টস হেরে ব্যাট করতে নামার পর ওপেনিংয়ে সুনিল নারিনকে নিয়ে রীতিমত ঝড় তুলেন দিলেন এই আফগান তরুণ তুর্কী। একের পর এক বলকে তিনি আছড়ে ফেলতে লাগলেন বাউন্ডারির ওপারে।
৪১ বল খেললেন। বাউন্ডারি ৪টি এবং ওভার বাউন্ডারি অর্থ্যাৎ ছক্কা মারলেন ৭টি। রান করলেন ৭৮। হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের এমন বিধ্বংসী ইনিংসের ওপর ভর করে ঢাকা ডায়নামাইটস সংগ্রহ করে ১৮৯ রান। ফল, ৮৩ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়।
এবারের বিপিএলে দিনের সাড়ে ১২টায় শুরু হওয়া ম্যাচগুলো হচ্ছে লো স্কোরিং। ব্যাটসম্যানদের পক্ষে রান তোলা খুবই কঠিন। চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটানো তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণাকে পাল্টে দিলেন জাজাই। আজ দিনের ম্যাচে তারা মুখোমুখি হলো খুলনা টাইটান্সের। আগের ম্যাচে হেরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দলের সামনে ছিল প্রথম জয় পাওয়ার আকাংখা।
কিন্তু টস হেরে ব্যাট করতে নেমে সেই হজরতউল্লাহ জাজাই আবারও জ্বলে উঠলেন ব্যাট হাতে। সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়ে রীতিমত টর্নেডো বইয়ে দিলেন খুলনার বোলারদের ওপর। ৩৫ বল খেলে ৩টি বাউন্ডারি এবং ৫ ছক্কায় তিনি করলেন ৫৭ রান।
এমন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গজনির না হোক, পাশের রাজ্য পাকতিয়ার নতুন সুলতান হিসেবে আবির্ভুত হলেন হজরতউল্লাহ জাজাই। যিনি হয়ে উঠছেন আফগান ক্রিকেটের যুবরাজ হিসেবে। ক্রিকেটের ব্যাটকে তলোয়ার বানিয়ে একের পর এক বিপিএল জয় করে যাচ্ছেন তিনি।
এখনও পর্যন্ত দুই ম্যাচ খেলে দুটিতেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নিলেন তিনি। সেরার পুরস্কার জয়ের পর জানিয়ে দিলেন গেইল তার আদর্শ হলেও, গেইলকে মোটেও অনুকরণ করেন না। নিজের মত করেই খেলে যান। নিজের মত করে খেলেই ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছেন, আগামীর টি-টোয়েন্টি শাসন করতেই আসছেন তিনি।
আইএইচএস/এমএস