গেইল প্রিয়, তবে তাকে অনুকরণ করি না : জাজাই
দিনের খেলায় চার-ছক্কার ফুলঝুড়িতো বহুদুরে, দিনের খেলায় রানই ওঠে না। ওঠেনিও। প্রথম দুইদিন প্রথম ম্যাচে কোন দল ১৩০’র বেশি করতে পারেনি। কারো ব্যাট থেকে ছক্কা বৃষ্টি ঝরেনি। কেউ পঞ্চাশও হাঁকাতে পারেননি।
কিন্তু সন্ধ্যার পরের চিত্রটা ভিন্ন। শিশির ভেজা শেরে বাংলায় বল দিনের চেয়ে দ্রুত ব্যাটে আসছে, ম্যুভমেন্ট, টার্ন দুই’ই থাকছে কম। কাজেই পরের ম্যাচে হাত খুলে খেলা তূলনামুলক সহজ। আগের দুইদিন সন্ধ্যার ম্যাচে তাই রান উঠেছে। ব্যাটসম্যানরা হাত খুলেও খেলেছেন।
২০ বছরের আফগান যুবা হযরতউল্লাহ জাজাই প্রথম দিন সন্ধ্যায় রাজশাহীর বিপক্ষে ব্যাটে ঝড় তুলেছিলেন; কিন্তু আজ খেলা দিনের আলোয়। খুলনার বিপক্ষে এদিন কি আর সেই ঝড়ো ব্যাটিং করতে পারবেন জাজাই? সেটাই ছিল দেখার।
যে পিচে দিনের আলোয় ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথ, এভিন লুইস, সাকিব আল হাসান, আন্দ্রে রাসেল কিংবা কাইরন পোলার্ডদের মত নামি-দামি ও আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটের সব স্পেশালিস্ট পারফরমাররা ব্যাটে ঝড় তুলতে পারেননি, সেখানে জাজাই কি ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে পারবেন?
এ কৌতুহলি প্রশ্নের জবাবে জাজাই দেখিয়ে দিলেন, তার ব্যাট বলে দিল, কে বলেছে দিনের বেলা স্লো উইকেটে ছক্কার ফুলঝুরি ছোটানো সম্ভব নয়? ছক্কার ফুলঝুরি ছোটানো সম্ভব। আমি ঠিকই ছক্কার নহর বইয়ে দিতে পারি। উইকেটের মন্থর গতি আর তুলনামুলক নীচু বাউন্স কোনটাই আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেনা। পারেওনি।
আর তাই আজও ৪১ বলে ৫৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে এবারের বিপিএলে দিনের খেলাগুলোর মধ্যে প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান এ আফগান। শুধু তাই নয়, আগের ম্যাচগুলোয় যা হয়নি, কেউ যা পারেনি ২০ বছরের জাজাই তাই করে দেখালেন। পাঁচ-পাঁচটি বিশাল ছক্কা ও তিন বাউন্ডারিতে হাঁকানো ইনিংস উপহার দিয়ে টানা দ্বিতীয় ম্যাচের ম্যাচ সেরাও হলেন তিনি।
প্রথম দিন রাজশাহীর বিপক্ষে সাত ছক্কা ও চার বাউন্ডারিতে ১৯০.২৪ স্ট্রাইকরেটে ৪১ বলে ৭৮ রানের হ্যারিক্যান ইনিংস উপহার দেয়া হযরতউল্লাহ জাজাই অবশ্য আজ নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। আজ ইনিংসে শুরুতে প্রায় আউট হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় ওভারে খুলনা টাইটান্স পেসার শরিফুলের বলে ডেভিডের হাতে জীবন পান মিড অনে। তখন জাজাইয়ের রান ছিল মাত্র ১২। ঢাকার স্কোর ছিল ১৩। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি এই আফগান।
প্রথম ছক্কা শরিফুলের করা দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে । শরিফুলকে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন। অফ স্ট্যাস্পের বাইরের লেন্থ বল টেনে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা ওই ওভারে চতুর্থ বলে বেঁচে গিয়ে ছয় নম্বর ডেলিভারিতে আবার ছক্কা।
শরিফুলের করা ইনিংসের পঞ্চম ওভারে প্রবল বেগে আক্রমণ। এক ওভারে তিন ছক্কা ও দুই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে মাঠ গরম করে ফেললেন। ওই ওভারের প্রথম বলে লং অনের ওপর ছক্কা দিয়ে শুরু। দ্বিতীয় বলে বাউন্ডারি। তৃতীয় বল ডট। চতুর্থ বল আবার বাউন্ডারি। পাঁচ নম্বর ডেলিভারিতে লং অফের ওপর দিয়ে ছক্কা। ছয় নম্বর ডেলিভারি ওয়াইড। অতিরিক্ত ডেলিভারিতে আবার ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা।
পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে জাজাইয়ের (১৮ বলে ৪১ রান) ঝড়ো ব্যাটিংয়ের কারণেই ওভার পিছু ১২ রান করে পায় ঢাকা ডায়নামাইটস। তাই রান ওঠে এক উইকেটে ৭২। এর পর ফিল্ডিং বিধিবদ্ধতা উঠে যাবার পর জাজাই খানিক স্লো হয়ে যান।
পরের ৯ রান করতে সময় নেন। নবম ওভারে মাহমুদউল্লাহকে ছক্কা হাঁকিয়ে পঞ্চাশ পূর্ণ করেন। ১২ নম্বর ওভারে অফ স্পিনার স্টার্লিংয়ের বলে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান সাজঘরে। অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরের লেন্থ বল স্পিন করে বেরিয়ে যাবার পথে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে সপাটে হাঁকান হযরতউল্লাহ জাজাই। কিন্তু এবার আর ছক্কা হয়নি। সীমানার আগেই ধরা পড়েন তিনি।
তারপর রনি তালুকদার, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড আর শুভাগত হোমদের আর কেউ পঞ্চাশ বহুদুরে, তিরিশের ঘরেও পৌঁছুতে পারেননি। জাজাইয়ের সেই উড়ন্ত সূচনাই ঢাকাকে বড় ইনিংসের পথে অনেকদুর এগিয়ে দেয়। সে কারণেই ম্যাচ সেরা হলেন জাজাই।
পাওয়ার প্লে’র ছয় ওভারে রুদ্রমূর্তি ধারণ করা জাজাই হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেন ২০০ স্ট্রাইকরেটে ২৫ বলে। পাঁচ ছক্কা ও তিন বাউন্ডারিতে। ৩০+১২ = ৪২ রান আসে শুধু চার ও ছক্কায়। ঝড়ো উইলোবাজিতে মোট ইনিংসে ১৩টি সিঙ্গেলসও নেন। আর একটি ডাবলস। বাকি ১৩ ডট বল।
ওপরের পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, জাজাই ঠিক হিসেব কষেই খেলেছেন। খেলা শেষে নিজেই বললেন, ‘দিনের বেলায় উইকেট সন্ধ্যার মত থাকে না। বেশ কঠিন পিচ। বল থেমে আসে। একটু নিচেও থাকে। বিগ শটস খেলা বা ফ্রি স্ট্রোক প্লে করা সহজ নয়। আমি তারপরও চেষ্টা করেছি।’
আগের দিনই জানিয়েছেন ভয়ঙ্কর ওপেনার ক্রিস গেইল তার আদর্শ। তবে আজ খুলনার বিপক্ষে ম্যাচ সেরা হয়ে প্রেসের সামনে জাজাই বলে দিলেন, গেইল তার প্রিয় ব্যাটসম্যান। আদর্শও। তবে তাকে নকল বা কপি করেন না।
তার ভাষায় আমি আমার মতই খেলি। আফগান প্রিমিয়ার লিগে টি-টেন আসরে ১২ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। কিন্তু তারপরও মনে ছিল রাজ্যের সংশয়-সন্দেহ, সুনিল নারিন, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ডদের মত বড় তারকার সাথে আমি কি প্রথম একাদশে জায়গা পাবো?
মঙ্গলবার পড়ন্ত বিকেলে শেরে বাংলার কনফারেন্স হলে সে কথা জানিয়ে জাজাই বলেন, ‘আমি দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে সত্যি সংশয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো, আমার প্রথম ম্যাচ খেলা হবে না; কিন্তু কোচ আমাকে বললেন, নাহ তুমি খেলবা।’
ঢাকা কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন যেন পাকা জহুরি। খাঁটি হীরা চিনতে ভুল করেননি এ পোড় খাওয়া ক্রিকেট দ্রোণাচার্য্য। শেরে বাংলার স্লো উইকেটেও আজ জাজাই যে ঝড় তুললেন, তাতে মিললো এক পরিষ্কার বার্তা, ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি পিচ পেলে আরও দুর্দমনীয় হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে তার।
বিশেষ করে সিলেটে প্রতিপক্ষ বোলিং দুমড়ে মুচড়ে আরও বড়সড় কিছু করেও ফেলতে পারেন এ আফগান।
এআরবি/আইএইচএস/এমকেএইচ