দুটোই দারুণভাবে সামলালেন ব্রাথওয়েট
ক্রিকেট বিশ্ব তাকে চিনেছিল দু’বছর আগে ২০১৬ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টির ফাইনালে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে শেষ ওভারের প্রথম চার বলে পরপর ছক্কা হাকিয়ে সারা ক্রিকেট বিশ্বে আলোড়ন তুলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২০ ওভারের ফরম্যাটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন কার্লোস ব্রাথওয়েট।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১৯ রান দরকার ছিল ক্যারিবীয়দের। ব্রাথওয়েট তিন বলে তিন ছয়ে ১৮ রান করার পর চার নম্বর ডেলিভারিতে আবার ছক্কা হাঁকালে অবিস্মরণীয় জয়ের দেখা পায় উইন্ডিজ। বেশ রাতারাতি পেস বোলিং অলরাউন্ডার হলেও ওই চার বলে চার ছক্কায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টির বিশ্বসেরার মুকুট পরিয়ে নিজেও রাতারাতি বিশ্ব তারকা বনে যান ব্রাথওয়েট।
সেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটার শনিবার আবার আলোচনায়, শিরোনামে। নাহ, তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে ৫০ রানে জিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে, সে কারণে নয়। শনিবার ব্রাথওয়েট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু আসলে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের ভুল ও তুঘলকি সিদ্ধান্তের পর মাঠে অধিনায়কোচিত আচরণের কারণে।
মাঠে দলকে ধরে রাখা এবং উত্তেজনা প্রশমিত করার কাজটি ঠান্ডা মাথায় সম্পাদন করা ব্রাথওয়েট খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পুরো ঘটনাটি সাংবাদিকদের সঙ্গে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা অনেক ঝানু, অভিজ্ঞ ও পরিণত ক্রিকেটারের পক্ষেও সম্ভব হত কি না সন্দেহ। কিন্তু ৩০ বছর বয়সী ব্রাথওয়েট মাঠ ও মাঠের বাইরেও দেখিয়ে দিলেন, আমি দক্ষ সেনাপতি।
বাংলাদেশ ইনিংসের চতুর্থ ওভারে ওশেন থমাসের পরপর দুটি সঠিক ও আইনসিদ্ধ ডেলিভারি ‘নো বল’ ডাকেন আম্পায়ার তানভীর আহমেদ। সেই সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ক্যারিবীয়রা। টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার হয়, দুটির একটিও নো বল ছিল না। একবারও বোলার ওশেন থমাসের সামনের পা পপিং ক্রিজের বাইরে যাননি। তা নিয়ে উইন্ডিজ ক্রিকেটারদের ক্ষোভ। আট মিনিট খেলা বন্ধ।
একপর্যায়ে ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো‘র গ্র্যান্ডস্টান্ডের তিনতলা থেকে নিচে নেমে আসা এবং উইন্ডিজ ক্যাপ্টেন ব্রাথওয়েটকে বুঝিয়ে-সুুঝিয়ে মাঠে ফেরানো। ম্যাচ রেফারির সঙ্গে কথা বলার পর খানিক উত্তেজিত ক্ষুব্ধ ব্রাথওয়েট দল বল নিয়ে আবার চলে আসেন মাঠে এবং শেষঅবধি ৫০ রানের জয় নিয়ে মাঠে ছাড়েন।
আগেই বলেছিলেন, টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিততে মুখিয়ে আছে তার দল। কারণ, এই জয়টা তারা দেশবাসীকে বড়দিনের উপহার হিসেবে দিতে চান। ব্রাথওয়েটের সে আশা পূরণ হয়েছে। খেলা শেষে শেরেবাংলার প্রেস কনফারেন্সে জয়ের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে ব্রাথওয়েট এটাকে দারুণ টিমওয়ার্ক ও টিম পারফরমেন্সের ফসল বলে অভিহিত করেছেন।
তার ব্যাখ্যা, 'পাওয়ার প্লের ছয় ওভারে আমরা ৮৮ রান তুলেছি। এই প্রায় ওভার পিছু ১৫ রান তোলাই বলে দেয় আমাদের ভালো খেলার ইচ্ছে ও দৃঢ় সংকল্প থাকলে আমরা পারি। যদিও বোলিং ইউনিট হিসেবে আমরা ততটা ভালো করতে পারিনি। তারপরও আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো মাঠে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর ও আমাদের তরুণ ক্রিকেটাররা নিজেদের নার্ভ ঠিক রেখেছিল। তারা উত্তেজিত হয়নি। নিজেদের মনোযোগ ও মনোসংযোগ হারায়নি। যখন মাঠে সবকিছুই আমাদের বিপক্ষে ছিল, ঠিক সেইসময় প্রতিপক্ষর স্কোর চার ওভারে ৬০ রানে চলে গিয়েছিল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা ম্যাচে ফিরে এসেছি এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছেড়েছি।’
খালি চোখে সবাই দেখেছেন আম্পায়ার তানভীর আহমেদের পরপর দুটি পরিষ্কার ও আইনসিদ্ধ বোলিংকেও নো বল ডেকে বিতর্কিত হয়ে খেলার সৌন্দর্য হানি ঘটানোর পাশাপাশি স্বাভাবিক ছন্দ আর গতিও নষ্ট করেছেন আম্পায়ার তানভীর। কিন্তু আম্পায়ারের ওই ভুল সিদ্ধান্তের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্যাপ্টেন ব্রাথওয়েট ফোর্থ আম্পায়ার, থার্ড আম্পায়ার এবং ম্যাচ রেফারির কাছে গিয়ে কয়েক মিনিট কথা বলেছেন।
সেসময় তিনি কি বলেছিলেন? পুরো ঘটনাটিকে ব্রাথওয়েট কীভাবে দেখছেন? নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তাহলে শুনুন, খেলা শেষে প্রেস কনফারেন্সে সে প্রশ্নই করা হয়েছে ব্রাথওয়েটকে। তিনিও দারুণ গুছিয়ে জবাব দিয়েছেন। একদম পরিণত মস্তিষ্কের পাকা কথাবার্তা। এতটুকু আবেগতাড়িত না হয়ে ভীনদেশের প্রচার মাধ্যমের সামনে কতটা সাজানো-গোছানো কথা-বার্তা বলা যায়, ঠিক তাই বলেছেন ব্রাথওয়েট।
কথা বলার সময় তাকে খেয়াল রাখতে হয়েছে কোনোভাবেই যাতে 'কোড অফ কন্ডাক্ট' ভঙ্গ না হয়। আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি এবং প্রতিপক্ষ বাংলাদেশকে এতটুকু ছোট না করে রীতিমতো এক মৌখিত বিবৃতি দিয়ে ফেলেছেন ব্রাথওয়েট।
তবে তার একটি ক্ষোভের জায়গা আছে। তা হলো- তার মনে হয় এবার বাংলাদেশ সফরে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে বেশ ক’টি সিদ্ধান্ত তার দলের বিপক্ষে গেছে।
এ সম্পর্কে ব্রাথওয়েট বলেন, ‘আমি দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পরই ম্যাচ রেফারির কাছে গিয়েছিলাম। তাকে বলেছি, আমার মনে হয় না এ সিরিজে কোনও ফিফটি ফিফটি সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে গেছে। সবগুলো ডিসিশন বাংলাদেশের পক্ষে গেছে। আমি কখনও কারও বিপক্ষে প্রতারণার অভিযোগ আনতে চাই না। আমি তা বলতেও চাই না। তারা (আম্পায়াররা) পেশাদার। আমি ভাবতে চাই না যে, আম্পায়াররা পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত দিতেই মাঠে নেমেছেন। ভালো করে বলতে গেলে, আমি তাদের বিপক্ষে প্রতারণার অভিযোগ আনিনি। তবে ম্যাচ রেফারির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজের সব ফিফটি ফিফটি ডিসিশন আমাদের বিপক্ষে গেছে। এটা সত্যি লাল ও সাদা- দুই বলেই আমরা আমাদের সেরাটা উপহার দিতে পারিনি। তবে এটাও ঠিক আম্পায়ারিং আমাদের ভালো খেলায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে।’
ওই ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গিয়ে ব্রাথওয়েট বলেন, ‘সবার জানা নো বলের রিভিউ হয় না। আম্পায়ার নো না ডাকলে তখন সেটা রিভিউ নেয়া যায় বা রিভিউ করার নিয়ম আছে। কিন্তু এখানে আম্পায়ার নো ডেকে ফেলেছেন। সবাই দেখেছেন যা মোটেই নো বল ছিল না। অবশ্যই তখন বোলার থমাস ছিল চাপে। যে বলে উইকেট পাবার কথা, সেখানে তার বলে ফ্রি হিট- খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা বাড়তি আবেগ ও উত্তেজনা ভর করেছিল তার ওপর। অধিনায়ক হিসেবে আমার তখন দায়িত্ব ছিল দলকে সামলানো। আমি সেই চেষ্টাই করেছি। যেহেতু বারবার ফিফটি ফিফটি সিদ্ধান্তগুলো আমাদের বিপক্ষে যাচ্ছিল, তাই অধিনায়ক হিসেবে আমার কর্তব্য ছিল ম্যাচ রেফারিকে বিষয়টি বলা।’
‘একপর্যায়ে ম্যাচ রেফারির সঙ্গে কিছু কঠিন কথাও বলতে হয়েছে। তার সঙ্গে কিছু ও মৃদু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর অবশেষে জট পাকানো সমস্যার সমাধান হয়। এরপর আমি আমার ক্রিকেটারদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি। এখান থেকে না খেলে মাঠ ছাড়া বা সিরিজ খুইয়ে ফিরে যাওয়া ভালো দেখায় না, ঠিকও হবে না। তাই সবাইকে বলি, সামর্থ্যের শেষবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে। এর মধ্যে আমি ম্যাচ রেফারির কাছে পাঁচ মিনিট সময়ও চাই। যাতে করে ছেলেরা নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি মনোযোগ-মনোসংযোগটাও ফিরে পেতে পারে। ম্যাচ রেফারিকে ধন্যবাদ, তিনি আমার সে অনুরোধ রেখেছেন। ওই সময় পাওয়ায় আমারও সুবিধা হয়। আমি সহযোগী ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত পাই। তাদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, আমাদের লড়াই করতে হবে। সবাই উদ্দীপ্ত হয় এবং বলতে থাকে এ ম্যাচ জিততে হবে আমাদের। জয়ের জন্য লড়তেও হবে।’
এআরবি/এসএএস/জেডএ