আবার সিরিজ সেরা হবেন সাকিব!
বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কে? এক কথায় বলা কঠিন। যত বড় পন্ডিত-বোদ্ধা আর বিশেষজ্ঞই হোন না কেন, এক বাক্যে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। একজনকে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান আখ্যা দিতেও দ্বিধায় পড়ে যাবেন। কয়েকটি নাম উঠে আসবে। মোহাম্মদ আশরাফুল? নামের পাশে যত নিন্দার কাটাই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা উইলোবাজের তালিকায় তার নামই আসবে সবার আগে। এরপর পর্যায়ক্রমে উঠে আসবে মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, তামিম ইকবাল আর মুশফিকুর রহিমের নাম।
একইভাবে সব সময়ের সেরা পেসার কে? এখানেও একই অবস্থা। পর্যায়ক্রমে কয়েকটি মুখ ভেসে আসবে- প্রয়াত দৌলতুজ্জামান, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, জি এম নওশের প্রিন্স আর মাশরাফি বিন মুর্তজা। এদের মধ্য থেকে একজনকে সবার সেরা বলাও সহজ কম্ম নয়।
একই অবস্থা স্পিনারদের ক্ষেত্রেও। সব সময়ের সেরা স্পিনার হিসেবেও কাউকে এককভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। এক নামে বলা যাবে না-তিনিই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা স্পিনার। তবে নজরুল কাদের লিন্টু, মোহাম্মদ রফিক আর সাকিব আল হাসান তিনজনই থাকবেন ঐ দৌঁড়ে।
মোদ্দা কথা-সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা পেসার ও স্পিনার হিসেবে কাউকে একককভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা পারফরমার ও অলরাউন্ডার নির্বাচনে কোনই সমস্যা নেই। এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের সেরা পারফরমার ও চৌকশ ক্রিকেটার অতি অবশ্যই সাকিব আল হাসান। পারফরমার সাকিবের ধারে কাছে কেউ নেই। অলরাউন্ডার সাকিবের তুলনা সাকিব নিজেই। বল ও ব্যাট হাতে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পারফরম করা এবং দলের সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখায় সাকিব অনন্য। তার ধারে কাছে কেউ নেই।
আসলে সাকিব হলেন জাত পারফরমার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে তার গায়ে যে সেরা অলরাউন্ডারের তকমা এঁটেছে, সেটাও এমনি এমনি নয়। তার পারফরমেন্স, সময় মত বল ও ব্যাট হাতে বার বার জ্বলে ওঠাই তাকে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের খেতাবে ভূষিত করেছে।
বলা হয় বাংলাদেশ ‘পঞ্চ পান্ডবের’ দল। মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর ওপর পুরো দল নির্ভরশীল। মোটেই মিথ্যে নয়। সত্য কথা। ঘুরে ফিরে ঐ পাঁচ সিনিয়র, পরিণত ও অভিজ্ঞ পারফরমারই টিম বাংলাদেশের প্রধান চালিকাশক্তি ও সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। কিন্তু ঐ পাঁচজনের মধ্য থেকে যদি আবার একজন পারফরমারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে বলা হয়, তাহলে চলে আসে সাকিব আল হাসানের নাম। কারণ সাকিবই টিম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বড় শক্তি ও নির্ভরতা। তার বোলিং দলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাই বাংলাদেশ টেস্ট , ওয়ানডে আর টি টোয়েন্টি-তিন ফরম্যাটেই সাকিবের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পরিসংখ্যান সে সাক্ষীই দিচ্ছে। পারফরমার সাকিবের বল আর ব্যাট দুই'ই সমান উজ্জ্বল। ব্যাটসম্যান সাকিব তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের তিন শীর্ষ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় আছেন। টেস্টে সাকিব রান তোলায় তৃতীয় (৫৫ টেস্টে ৩৮০৭)। তামিম (৫৬ টেস্টে ৪০৪৯) ও মুশফিকুর রহিমের (৬৬ টেস্টে ৪০০৬ ) পিছনে।
ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের (১৮৬ ম্যাচে ৬৪৫০) পর রান তোলায় সাকিব (১৯৫ খেলায় ৫৫৭৭) দ্বিতীয়। একইভাবে টি-টোয়েন্টিতেও তামিম (৭০ খেলায় ১৫৪৮) ইকবালের পর সাকিব (৭১ ম্যাচে ১৪৭১) দ্বিতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী।
বল হাতেও সাকিবের জয় জয়কার। টেস্টে একমাত্র বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ২০০ + (৫৫ টেস্টে ২০৫) উইকেট শিকারি। ওয়ানডেতে মাশরাফির (২০০ ম্যাচে ২৫৭) পর দ্বিতীয় সর্বাধিক (১৯৫ ম্যাচে ২৪৭) উইকেট শিকারি সাকিব। আবার টি-টোয়েন্টিতেও সাকিবই বাংলাদেশের এক নম্বর ও সফলতম বোলার (৭১ খেলায় ৮৫ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে)।
যার ব্যাট ও বল এত উজ্জ্বল, সমানভাবে দ্যুতি ছড়ায়, তিনি অলরাউন্ডার হিসেবে সবার সেরা হবেন এবং নিজের পারফরমেন্সের দ্যুতিতে মাঠ আলোকিত করার পাশাপাশি দলের সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাই সব ফরম্যাটে সাকিবই বাংলাদেশের এক নম্বর ম্যাচ জেতানো পারফরমার।
খুব পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরেও বল ও ব্যাট হাতে সমান নৈপুণ্যের ছটায় টেস্ট সিরিজ সেরা পারফরমার হয়েছেন সাকিব।
আসুন ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সাকিবের পারফরমেন্সটা খুব সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক :
চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে (৩৪+১ ) ৩৫ রান করার পাশাপাশি (৩/৪৩+২/৩০) ৫ উইকেট এবং ঢাকায় দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ৮০ রান আর বল হাতে (৩/২৭+১/৬৫) ৪ উইকেট। দুই টেস্টে ১১৫ রান আর ৯ উইকেট। আর তাতেই টেস্ট সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠে সাকিবের হাতে।
এরপর ওয়ানডেতে প্রথম ম্যাচে ১০ ওভারে ৩৬ রানে ১ উইকেট ও ব্যাট হাতে ২৬ বলে ৩০। দ্বিতীয় ম্যাচে দলের টপ স্কোরার (৬২ বলে ৬৫) আর উইকেট না পেলেও অসাধারণ বোলিং (১০ ওভারে মাত্র ২৮ রান) । শেষ ম্যাচে ব্যাটিং পাননি। বল হাতে ৯ ওভারে ২/৪০। শাই হোপ ওই সিরিজে দুই সেঞ্চুরি করে না বসলে হয়তো ওয়ানডেতেও সাকিবের হাতেই উঠতো সিরিজ সেরার পুরস্কার।
টি-টোয়েন্টিতেও সাকিব দূর্বার। সিলেটে প্রথম ম্যাচে দল ৮ উইকেটে করুণভাবে হারলেও সাকিব একাই লড়েছেন। সর্বাথিক ৬১ (৪৩ বলে) রান আসে তার ব্যাট থেকেই। আর বল হাতে ৩.৫ ওভারে ৩২ রানে উইকেটশুন্য।
শেরে বাংলায় দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে সর্দি জ্বর, বুকে গলায় ঠান্ডা এবং পেটের পীড়ায় প্রায় সারা দিন অনাহারে থেকেও মাঠে নেমে বল ও ব্যাট হাতে অনন্য সাকিব। একাই ম্যাচ ভাগ্য গড়ে দেন। বৃহস্পতিবার শেরে বাংলায় ২২ থেকে ২৩ হাজার ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ বাঙালি বিজয়ের মাসে প্রাণভরে উপভোগ করেছেন সাকিবের ‘ওয়ানম্যান শো।’ সাকিবময় ম্যাচ। ব্যাট হাতে ২৬ বলে ৪২ রানের হার না মানা ইনিংস শেষে ২০ রানের ৫ উইকেট শিকারি সাকিবই ম্যাচসেরা। আগামীকাল শেষ ম্যাচেও বাংলাদেশের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনিই থাকবেন, বলা যায়।
পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছেম তিন মাস আগে সেন্ট কিটস ও ফ্লোরিডার তিন ম্যাচের টি টোয়েন্টি সিরিজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে সিরিজসেরা পারফরমার ছিলেন সাকিব।
তিন ম্যাচে তার পারফরমেন্স ছিল এমন :
প্রথম ম্যাচে ১৯ ও ০ উইকেট । দ্বিতীয় ম্যাচে ৩৮ বলে ৬০ ও ২/১৯ আর তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ২২ বলে ২৪ ও ১/২২। মানে তিন খেলায় এক ফিফটিসহ ১০৩ রান এবং ৩ উইকেট।
এবারও তো সিরিজ সেরার হাতছানি সাকিবের সামনে। আগের ম্যাচের মত ৪০+ ইনিংস আর পাঁচ উইকেট পেলে তো কথাই নেই। ত্রিশোর্ধ্ব রানের একটি কার্যকর ইনিংস আর ওভার পিছু সাত রানের আশপাশে দুই থেকে তিন উইকেট নিতে পারলেই ব্যাস; আবার সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠতে পারে সাকিবের হাতে।
এমনিতেই গত ম্যাচে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়ে তামিম, মুশফিক ও সাব্বিরকে পিছনে ফেলে সর্বাধিক চারবার টি-টোয়েন্টির ম্যাচসেরা হয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে করেছেন আরও সমৃদ্ধ। আর এবার দলকে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতিয়ে ম্যাচ সেরা পারফরমার হতে পারলে সাকিবের সাফল্যের ডানায় যুক্ত হবে আরও এক সোনালি পালক।
সাকিব কি তা পারবেন? যদি নাও পারেন, তারপরও তিনিই সেরা ম্যাচ উইনার। সেরা পারফরমার ও অলরাউন্ডার। আর পারলে তা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সবাই বলবে, সত্যিই সাকিব অন্য মাপের ও ভিন্ন মাত্রার পারফরমার। ইনজুরি, অসুস্থতা কিংবা শৃঙ্খলাজনিত কারণে সাসপেন্সনের খাড়ায় পড়ে যখনই মাঠে ফেরেন, তখনই নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। যেন ‘চার্জড আপ ব্যাটারি।’ অন করলেই শতভাগ কার্যকর। নৈপুণ্যের দ্যুতিতে মাঠ মাতানো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং দল জেতানোয় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ায় যার জুড়ি মেলা ভার।
তাই তো সাকিব বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা পারফরমার, অলরাউন্ডার ও সবচেয়ে বড় ম্যাচ উইনার।
এআরবি/এমএমআর/এমকেএইচ