‘আনপ্রেডিক্টেবল’ শেরে বাংলাই টাইগারদের সাফল্যের স্বর্গ!
অধিনায়ক মাশরাফি বারবার বলে থাকেন, ‘শেরে বাংলার উইকেট আনপ্রিডিক্টেবল।’ শুধু মাশরাফি নন, টিম বাংলাদেশের যারা চালিকাশক্তি, ব্যাটিং-বোলিংয়ের মূল অস্ত্র সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, তামিম ইকবাল এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরাও তাই মনে করেন। তাদের মুখেও বেশ ক’বার শোনা গেছে, ‘হোম অফ ক্রিকেটের পিচ রহস্যময়। দূর্বোধ্য।’
যাদের কথা বলা হলো, সন্দেহাতীতভাবে তারাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র। টিম বাংলাদেশের সেরা সম্পদ। সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র ও মূল চালিকাশক্তি। পাশাপাশি তারা এই মাঠে খেলে খেলেই আজ সু-প্রতিষ্ঠিত। বছরের বড় সময় অনুশীলন, ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক খেলায় সময় কাটে এই শেরে বাংলায়।
তারা যখন এই মাঠের উইকেটকে ‘আনপ্রিডিক্টেবল’ বলেন, তখন চিন্তা জাগে বৈকি! কিন্তু বাস্তবে তা মেলানো কঠিন। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যে মাঠের উইকেট নিয়ে খোদ স্বাগতিকদেরই সর্বোচ্চ সংশয়-সন্দেহ, বাস্তবে সেই শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম আসলে টিম বাংলাদেশের সাফল্যের স্বর্গ।
ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানাচ্ছে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সাফল্য যে এই শেরে বাংলাতেই রচিত হয়েছে! সীমিত ওভারের ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি ম্যাচও যেমন শেরে বাংলায়, সবচেয়ে বেশি জয়ও এই মাঠে।
একদিনের ফরম্যাটে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ম্যাচ খেলেছে ৩৫৫টি। যার মধ্যে টাইগাররা জিতেছে ১১৮টিতে। ওই ৩৫৫ ম্যাচের ৯১টি হয়েছে শেরে বাংলায়। যার মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ৪৪ টিতে। আর হেরেছে ৪৬ টিতে। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এখন পর্যন্ত টাইগাররা অংশ নিয়েছে ৮৩ ম্যাচে। যার মধ্যে জয় পেয়েছে ২৫টিতে। সেখানে হোম অফ ক্রিকেটে ২০ ম্যাচে টাইগারদের জয় সংখ্যা সাতটি।
ওপরের পরিসংখ্যানে একটি বিশেষ বার্তাও আছে। তাহলো, উইকেটের চরিত্র, গতি-প্রকৃতি তথা আচরণ নিয়ে স্বাগতিক সিনিয়র ক্রিকেটার এবং তিন ফরম্যাটের অধিনায়কদের সংশয়-সন্দেহ থাকলেও বাস্তবে শেরে বাংলাই টিম বাংলাদেশের সবচেয়ে অনুকুল ক্ষেত্র। এ মাঠের ‘আনপ্রিডিক্টেবল-রহস্যময়’ পিচই আসলে সাফল্যের কেন্দ্র।
এই পিচে ভাল খেলার মূলমন্ত্র কি? সাফল্যের সম্ভাব্য কৌশলই বা কেমন? তা সবচেয়ে ভাল জানেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররাই। তাই তো এই মাঠে খেলা মানেই সাহস, আস্থা ও আত্ববিশ্বাস বেড়ে যাওয়া। শেরে বাংলায় ফেরা যেন তাই আপন ঘরে ফেরা।
সিলেট থেকে ফিরে আজ (বুধবার) দুপুরে অনুশীলনে দলের প্রতিটি সদস্যর চোখে মুখে অন্যরকম প্রাণ চাঞ্চল্য। দুপুরে মেঘে ঢাকা কনকনে বাতাসে আলোর স্বল্পতায় পশ্চিম দিকের ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে ফিল্ডিং, ক্যাচিং আর সেন্টার উইকেটের পাশে বিগ হিট প্র্যাকটিস হলো টাইগারদের।
পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য খানিক আলো ছড়ালেও শীতের প্রকোপ ছিল বেশ। এমন শীতে একটু জুবুথুবু থাকাই স্বাভাবিক। সেখানে টাইগারদের চোখ মুখে একটা অন্যরকম চনমনে ভাব। প্রত্যেকের শরীরি ভাষা বলে দিচ্ছিলো, ‘এসে গেছি আসল জায়গায়। সিলেটে পারিনি তাতে কি? শেরে বাংলায় ঠিক ঘুরে দাঁড়াবো।’
বছরের বেশিরভাগ সময় শেরে বাংলায়ই চলে ক্রিকেট চর্চা। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্র্যাকটিস চলে আর এখানে খেলাও হয় অনেক বেশি। মনে হতে পারে, সে কারণেই বুঝি এ মাঠে এসে আরও বেশি সতেজ ও ফুরফুরে হয়ে পড়া। সেটা অবশ্যই আছে; কিন্তু তারচেয়ে বড় কারণ হলো উইকেট। শেরে বাংলার পিচে করণীয় কি? ব্যাটিং ও বোলিংয়ের অ্যাপ্রোচটা কেমন হওয়া উচিৎ? সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ, লিটন, সৌম্য, মিরাজ ও মোস্তাফিজদের তা খুব ভাল জানা।
তাই এই পিচে ঘুরে দাড়ানোর সাহস, বিশ্বাস ও আস্থাটাও বেশি। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শক্তির জায়গাই শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এখানকার আলো-বাতাস এবং পরিবেশ। টিম বাংলাদেশের শক্তি, সামর্থ্যের সাথে শেরে বাংলার উইকেটের রসায়ন মিলে যায় খুব।
সবার জানা, শেরে বাংলার পিচ মানেই ‘স্লো-অ্যান্ড লো।’ বল পিচ পড়ে ঢিমে-তালে ঠেলা গাড়ির গতিতে আসবে। বাউন্সও থাকবে কম। এ উইকেট তাই তুলানামূলক কম গতির, বিশেষ করে স্পিন সহায়ক। বাংলাদেশের বোলিংয়ের সাথে পুরোপুরি মানানসই।
দলে চার চারজন পেসার থাকলেও দ্রুত গতির ‘এক্সপ্রেস’ বোলার মোটে একজন; রুবেল হোসেন। বাকিরা মানে মোস্তাফিজ, সাইফউদ্দিন আর আবু হায়দার রনি আসলে মিডিয়াম পেস বা জেন্টাল মিডিয়াম। আর সাথে সাকিব-মিরাজের স্পিন। পুরো বোলিং শক্তিটা একদম শেরে বাংলার পিচ উপযোগি। তাদের সাজানো বোলিংয়ে এই মাঠে হাত খুলে খেলতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যায় অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানেরও। কারণ বল আসে থেমে এবং একটু নিচু হয়ে।
সেখানে এভিন লুইস, সাই হোপ, হেটমায়ার, নিকোলাস পুরান আর কিমো পল কার্লোস ব্রাথওয়েটদের উত্তাল উইলোবাজি করা কঠিন হবে বৈকি। এই মাঠে ভাল খেলার প্রথম শর্তই হলো, রয়ে সয়ে এবং যতটা সম্ভব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল দেখে খেলা। সেট হবার আগে ঝড়ো বা আক্রমণাত্মক উইলোবাজি অনেক কঠিন।
অথচ সিলেটে তা ছিল না। তাই ক্যারিবীয়রা মিরাজ, সাইফউদ্দিন, রনি ও মোস্তাফিজকেও মুড়ি মুড়কির মত উড়িয়ে মেরেছেন। সিলেটে ক্যারিবীয়দের ব্যাটে ছক্কা বৃষ্টিও হয়েছে; কিন্তু শেরে বাংলায় এমন উত্তাল উইলোবাজি করা যে বেশ কঠিন কাজ হবে!
একইভাবে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার শেলডন কট্টেল ও ওশান থমাসের সংহার মূর্তি ধারণ করার সুযোগও কম। সিলেটে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার শেলডন কট্টেল আল ওশান থমাসের দ্রুত গতির শর্ট বল ভুগিয়েছে তামিম, লিটন, সৌম্য ও সাকিবের মত তুখোড় উইলোবাজদেরও। কারণ, বাংলাদেশের অন্য সব পিচ, বিশেষ করে শেরে বাংলার চেয়ে দ্রুত ও একটু বেশি উচ্চতায় শরীরে এসেছে।
শেরে বাংলায় তা হয় না। হয়ত কাল বৃহস্পতিবারও হবে না। তাই অন্য সময় হোম অব ক্রিকেটের পিচই টিম বাংলাদেশের বড় সম্পদ। বড় শক্তি। বড় নির্ভরতাও। কালও (বৃহস্পতিবারও) নিশ্চয়ই অমন স্লো-লো পিচেই খেলা হবে।
আর যদি তাই হয়, তাহলে সিলেটে ম্রিয়মান ও অকার্যকর সাকিবের দল ঠিক বৃহস্পতিবার শেরে বাংলায় অনুকুল পরিবেশে আবার জ্বলে উঠবে।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম