‘অধিনায়ক হিসেবে রেকর্ড গড়ার চেয়ে দলের সদস্য থাকাই বেশি গর্বের’
১৭ বছর আগে যখন শুরু করেছিলেন, তখন ছিলেন হরিণ চপল আর চিতাসম ক্ষিপ্র। শুরু থেকেই খেলাটা ছিল খুব পছন্দের। ভালোলাগার ও উপভোগের। কি দারুণ জোরে বল করতেন! তখন মাইল মিটার তেমন ছিল না, তবে এখন বোঝা যায় মাশরাফিও ক্যারিয়ারের শুরুতে কয়েক বছর ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতেন; কিন্তু ‘ইনজুরি’ সে প্রচন্ড গতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যত সময় গড়িয়েছে, ততই ইনজুরি আর অপারেশন পেয়ে বসেছে তাকে। এক সময় তো ইনজুরি-অপারেশন আর মাশরাফি মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েছিলো। ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় কেটেছে ইনজুরি আর অপারেশনের ধকল সামলাতে সামলাতে।
এই ইনজুরি আর অপারেশন শুধু ক্রিকেটার মাশরাফির ক্যারিয়ারে পথেই বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি, তার টেস্ট ক্যারিয়ারকে শেষ করে দেয়নি। ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের পরিসংখ্যানের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আজ তার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান যেমন, তার চেয়ে ঢের উজ্বল থাকতো মাশরাফির রেকর্ড।
ক্রিকেটার, বোলার মাশরাফিকে ভোগানোর পাশাপাশি ‘অধিনায়ক মাশরাফিরও’ বড় ক্ষতি করেছে ইনজুরি। ২০০৯ সালে দেশের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে খেলতে গিয়েই ইনজুরির শিকার হয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ২০১০ সালে আরও একবার নেতৃত্ব পেয়েছিলেন ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু সেবারও মাঠ থেকেই ইনজুরির কবলে পড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে।
এরপর আবার চার বছর পর ক্যাপ্টেন্সি পেলেন। কেমন ছিল অধিনায়ক মাশরাফির পথ চলা? এটা ঘরের মাঠে তার শেষ ওয়ানডে সিরিজ কি না? আর তাই যদি হয়, তাহলে ১৪ ডিসেম্বর শুক্রবার মানে আগামীকালের ম্যাচটিই কি দেশে ক্রিকেটার ও অধিনায়ক মাশরাফির শেষ ম্যাচ? এখনো সে গুঞ্জন অনেকের মুখে মুখে।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, বারবার তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি নিয়ে কুটনৈতিক ভাষায় কথা বলায় মাশরাফিকে আজ প্রেস কনফারেন্সে আর শেষ সিরিজ বা দেশের মাটিতে এটাই শেষ কিনা, এমন প্রশ্ন করা হয়নি।
তবে তার অধিনায়ক জীবন নিয়ে কথা হলো। অধিনায়কের যাত্রা কেমন ছিল? শুক্রবার অধিনায়ক হিসেবে ৭০ নম্বর ম্যাচ তার। এ ম্যাচটিই তাকে নিয়ে যাবে এক অন্য উচ্চতায়। ‘অধিনায়ক’ মাশরাফি উঠে যাবেন ম্যাচ সংখ্যায় সবার ওপরে। হাবিবুল বাশারের ৬৯ ম্যাচ টপকে মাশরাফিই হবেন ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি, ৭০ বার নেতৃত্ব দেয়া অধিনায়ক।
তা নিয়েই কথা উঠলো। ক্যরিয়ারের শুরুতে কখনো অধিনায়ক হবার স্বপ্ন দেখতেন কি না? আর পুরো অধিনায়ক জীবনটাকে কিভাবে দেখছেন? সবচেয়ে বেশি ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার অনুভুতি কি? এসব প্রশ্নই করা হলো মাশরাফিকে।
সাধারণতঃ কোনো অর্জন-প্রাপ্তির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আবেগ-উচ্ছাস এড়িয়ে যান। তবে আজ মাশরাফির স্বীকার করলেন, ‘ওয়ানডেতে দেশকে সবচেয়ে বেশিবার নেতৃত্ব দেয়ার অনুভুতি অবশ্যই অন্যরকম ভাললাগার।’
তবে এর শেষাংশে আছে মাশরাফি মার্কা কথোপকোথন, ‘২০১৪ সালে যখন আবার নেতৃত্ব পাই, তখন নিজেকে নিয়ে ভবিষ্যতে চিন্তা করা বা খেলোয়াড় হিসেবে নিজে কোনো কিছু সেট করতাম না। ভাবটা এমন ছিল, যেভাবে আছে চলতে থাকুক যতদিন চলে। এভাবেই চিন্তা করেছি। এভাবে করতে করতে প্রায় চার বছর হতে যাচ্ছে। এভাবেই আমার অধিনায়ক জীবন এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বেশি সময় অধিনায়কত্ব করতে পেরেছি যা আমার এবং আমার পরিবারের জন্য খুবই গর্বের। কাল যদি মাঠে নামতে পারি, তাহলে ওয়ানডে ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি অধিনায়কত্ব করার সুযোগ হবে। সেটাতো অবশ্যই এটা নাইস ফিলিংস। তবে আমার কাছে দলের ১১জন, যারা পারফর্মার আছে সেই দলের মেম্বার হয়ে থাকাও কিন্তু বিরাট গর্বের ব্যাপার।’
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অধিনায়ক মাশরাফির সময়টা কেমন কাটলো? এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফির ব্যাখ্যা, ‘আসলে কোনরকম আশা নিয়ে শুরু করিনি। দু’বার অধিনায়কত্ব পেয়েছি। শুরুতে এক-দুই-তিন বা চার-পাঁচ ম্যাচ পর ইনজুরিতে পড়ে গিয়েছি। কতবার আহত হয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েছি, একদম গুণে বলা কঠিন; কিন্তু বেশ শুরুতে আমি ইনজুরির কারণে দল থেকে বাদ পড়েছি। লং টাইম বাইরে ছিলাম। পরেরবার আবার একই পরিস্থিতি। অধিনায়কত্ব আমার ইস্যু ছিল না। আমার জন্য বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলাটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। পরেরবার যখন অধিনায়কত্ব পেয়েছিলাম তারপর থেকে অনেক কিছু আমি ভাবিনি। আর প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যখন দল পরিচালনার দায়িত্ব পাই, তখন অনেক আশা ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে তখন ফুল রিদমে খেলছিলাম। ২০০৮ সালে আমি লাল বলে খুব ভালো ফর্মেও ছিলাম। আসলে তখন অনেক আশা ছিল।’
তিনি পিছন ফিরে তাকানোর মানুষ নন। তবে ওপরের কথাগুলো বলে দেয় ইনজুরি আর অপারেশন যে তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সর্বনাশ ডেকে এনেছে- সেটাও একটা বড় দুঃখ। যার প্রকাশ হয়ত নেই। তবে যন্ত্রনা আছে অবশ্যই। সেটা চোখে দেখা যায় না। মাশরাফিও বুঝতে দেন না। তবে ভিতরে অস্ফুট যন্ত্রনার কাঁটা বিধেই আছে।
এআরবি/আএইচএস/এমকেএইচ