ক্যারিবীয় ‘গতি দানব’দের কথা মনে করাচ্ছেন ওশান থমাস
দীর্ঘ দেহ, লম্বা রানআপ। ধীরে ধীরে দৌড়ে এসে বলটি করলেন। ব্যাটসম্যানের কাঁধ বরাবর কিংবা মাথার ওপর দিয়ে চোখের পলকে বলটা বেরিয়ে গিয়ে জমা পড়লো উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। হঠাৎ, ব্যাটসম্যানেরও বোঝার উপায় থাকলো না। কিংবা প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা বলটি হয়ে গেলো ইয়র্কার অথবা অফ স্ট্যাম্পের ওপর পড়ে হলো ইনসুইংগার। উপড়ে গেলো ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প। উপড়ানো স্ট্যাম্পটি শূন্যে গোত্তা খেলো কয়েকবার। এই হলো ডান হাতি ক্যারিবীয় পেসার ওশান থমাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
ছোট্ট ক্যারিয়ার, মাত্র ৪টি ওয়ানডে এবং ৩টি টি-টোয়েন্টি খেলা হয়েছে তার। বয়সটাও খুব কম। মাত্র ২১ বছর। ছোট্ট এই সময়টাতে এমন অনেকগুলো মধুর স্মৃতি জমা হয়ে গেছে ওশান থমাসের ঝুলিতে, যেগুলো গ্যালারিতে বসে দেখতে দেখতে ক্রিকেট বোদ্ধাদের স্মরণে পড়ে যেতে থাকলো ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, কোর্টনি ওয়ালস কিংবা কার্টলি অ্যামব্রোসদের কথা।
ক্যারিবীয় নস্টালজিয়ায়ও ভুগতে শুরু করে দিয়েছেন হয়তো অনেকে। বিশেষ করে পুরনো ক্রিকেট বোদ্ধারা। ৭০, ৮০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যা যারা দেখেছেন, তাদের কাছে ওশান থমাস যেন ম্যালকম মার্শাল কিংবা জোয়েল গার্নারদের এক তরুণ সংস্করণ।
কি নেই তার বোলিংয়ে? গতি, বৈচিত্র্য, সুইং, বাউন্স, লাইন-লেন্থ; একজন জেনুইন পেস বোলারের যতগুলো গুণ আর বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, সবগুলোই বিদ্যমান ওশান থমাসের ডান হাতে।
তার বিষাক্ত গতির সর্বশেষ উদাহরণটা দেয়া যাক। মিরপুরে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে টস হেরে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের ওপেনার লিটন দাসকে ছোড়া তার ইয়র্কারটি এতটাই গতিময় ছিল যে, ফ্লিক করার পরও সেটি গিয়ে সোজা আঘাত হানে ব্যাটসম্যানের পায়ের গোড়ালির অরক্ষিত নরম অংশটিতে। রানের তাড়ায় দৌড়ে তৎক্ষণাত হয়তো জায়গা পরিবর্তন করলেন লিটন; কিন্তু নন স্ট্রাইক প্রান্তে এসে সোজা শুয়ে পড়লেন তিনি। ফিজিও এসে পরীক্ষা করার পর স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল বাংলাদেশের এই ওপেনারকে। ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেট নিয়েছিলেন থমাস।
ওশান থমাসের আবিস্কারক কে? খুব বেশি খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন নেই। ক্রিস গেইল। ২০১৬ সালে একটি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে সোজা গেইলের মাথা বরাবর বাউন্সার ছুড়ে মারেন থমাস। ওই সময় তার বয়স মাত্র ১৯। তার অবিশ্বাস্য গতি এবং বাউন্স দেখে তো অবাক গেইল! কাল বিলম্ব না করে সিপিএলে নিজের দল জ্যামাইকা তালাওয়াহসে ভিড়িয়ে নেন থমাসকে। পরের মৌসুমে যদিও গেইল চলে যান সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস প্যাট্রিয়টসে। থমাস থেকে যান জ্যামাইকায়। এবার মুখোমুখি হলেন দু’জন। এবার গেইলকে গতি এবং বাউন্স দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন এই উদীয়মান পেসার।
সর্বশেষ (২০১৮) সিপিএলে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় ছিলেন বিপিএলে রংপুর রাইডার্স এবং আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের কোচ টম মুডি। সেখানেই এক ম্যাচে তিনি দেখলেন, কিভাবে এক দুর্দান্ত ইয়র্কারে সাই হোপের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন থমাস। সেই ঘটনা চোখে লেগে থাকলো মুডির।
সিপিএল থেকে ফিরে আসার পর বিপিএলের আগামী মৌসুমের জন্য যে প্লেয়ার্স ড্রাফট অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে চোখ বন্ধ করে থমাসকে দলভুক্ত করে নিয়েছেন টম মুডি। আগামী বিপিএলে এই ক্যারিবীয় পেসারই হতে যাচ্ছেন রংপুর রাইডার্সে মুডির অন্যতম বড় হাতিয়ার। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদেও জায়গা পেতে যাচ্ছেন ক্যারিবীয় এই উদীয়মান পেসার।
প্রসঙ্গতঃ সিপিএলে ১০ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়েছেন তিনি। পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিং তারই। যদিও স্পিনার ফাওয়াদ আহমেদের চেয়ে চার উইকেট কম পেয়েছেন তিনি।
তবে ওশান থমাসকে তখনও বাইরের দুনিয়া খুব একটা চিনতে পারেনি। ঘরোয়া ক্রিকেটেই গতির ঝড় তুলেছেন শুধু। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেললে তো তাকে চেনার কথা নয় বাইরের কারও। ওশান সে সুযোগটাও পেয়ে গেলেন সম্প্রতি ভারতের বিপক্ষে শেষ হওয়া ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
ভারতের বিপক্ষে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম ম্যাচেই একাদশে সুযোগ পেয়ে গেলেন ওশান থমাস। মধ্য গ্রীষ্মে গগণ উদ্ভাসিত করে দিনের প্রথম সূর্যটা যখন বিকিরণ ছড়াতে শুরু করে, তখনই বোঝা যায়, সেই দিনের তাপমাত্রাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ওশান থমাস নিজের উদয়লগ্নে তেমনই বিকিরণ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছেন। শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ২২ গজে গতির ঝড় তোলার জন্যই আবির্ভাব ঘটেছে তার।
‘ক্যারিবীয় গতিঝড়ে’র কথা এতদিনে যারা ভুলতে বসেছিলেন, ওশান থমাস তাদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেই ক্যালিপসো সুর এখনও হারিয়ে যায়নি। তার গতিতে কুপোকাত হবে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা, আর সেই আনন্দে গ্যালারিতে উঠবে ক্যালিপসোর নতুন সুর।
গুয়াহাটিতে ভারতের বিপক্ষে থমাসের নিজের অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারের ডেলিভারিগুলো ছিল যথাক্রমে ঘণ্টাপ্রতি ১৪৭, ১৪৭, ১৪০, ১৪৯, ১৪৭ এবং ১৪৭ কিলোমিটার। ওভারের শেষ বলটি মোকাবেলা করেছিলেন শিখর ধাওয়ান এবং সেই বলটি ব্যাটের কানায় লাগিয়ে তিনি টেনে আনেন স্ট্যাম্পে। বোল্ড হয়ে গেলেন ধাওয়ান। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ওভারেই প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করে দিলেন থমাস।
টি-টোয়েন্টি অভিষেকের প্রথম ওভারেও একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে প্রথম ওভারেই সাজঘরের পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। ১৪৭ কিলোমিটার গতির ইনসুইংগারের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন রোহিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ১১০ রানে বেধে রাখার পর সহজ লক্ষ্যেই ব্যাট করতে নেমেছিল ভারত। কিন্তু থমাসের গতির সামনে এই ১১০ রানই ভারতের জন্য হয়ে ওঠে বিশাল এক লক্ষ্য।
শুধু রোহিত শর্মাকেই নয়, শিখর ধাওয়ানকেও বোল্ড করেছিলেন তিনি। শিশিরের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বল একটু বেশিই বাউন্স হচ্ছিল। বল স্কিড করছিল বেশি। রোহিত শর্মাকে উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য করার পর শিখর ধাওয়ানের স্ট্যাম্পই উপড়ে দিলেন তিনি। ওই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত দিনেশ কার্তিক এবং ক্রুনাল পান্ডিয়া মিলে ভারতকে রক্ষা করেন।
ওই ম্যাচের ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরেও গেলেও ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মার প্রশংসা কুড়িয়ে নিলেন থমাস। তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ওশান দুর্দান্ত একটি প্রতিভার নাম। তার উচ্চতা এবং জাম্পই তাকে অনেকটুকু এগিয়ে রেখেছে। যদি নিয়মিত লাইন এবং লেন্থ বজায় রেখে সঠিক জায়গায় বল করে যেতে পারে, তাহলে আমার মনে হয় বিশ্বে এমন কোনো ব্যাটসম্যান নেই যে তাকে মোকাবেলা করতে পারবে।’
মাত্র ২১ বছর বয়সেই ভারত সফরে এসে থমাস বুঝিয়ে দিলেন, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা গতিময় বোলার হতে যাচ্ছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত যে ক’টি উইকেট পেয়েছেন, তাতেই নিজের যোগ্যতা এবং প্রতিভা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গত বছর সিপিএলে সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলকে ১৫০ কিলোমিটার গতির ইয়র্কারে বোল্ড করেছিলেন তিনি। ভারত সফরে নিয়মিতই স্বাগতিকদের টপ অর্ডারে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কে এমনটা পেরেছিল? এই এক সফরেই শিখর ধাওয়ানকেই তিনবার বোল্ড করেছিলেন তিনি।
বিরাট কোহলির মত ব্যাটসম্যান, যিনি খুবই কম ভুল শট খেলে থাকেন, তিনিই কি না থিরুভানানথাপুরামে ৫ম ওয়ানডে ম্যাচে থমাসের বলে একবার পরাস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে তুলে দিয়েছিলেন প্রথম স্লিপে। যদিও গতির কারণে ওই ক্যাচটি ধরতে ব্যর্থ হন জেসন হোল্ডার। কয়েক ওভার পর আবারও রোহিত শর্মার ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে রামদিনের হাতে ক্যাচ জমা দিলেন থমাস। কিন্তু আম্পায়ার হাত তুলে জানিয়ে দিলেন, ওটা ছিল ওভার স্টেপিং, অর্থ্যাৎ নো বল।
শেষ পর্যন্ত কোহলি-রোহিতের ব্যাটে ভারতই জিতেছিল ৯ উইকেটের বিনিময়ে। যদি ওই ম্যাচে কোহলির ক্যাচটা হোল্ডার ফেলে না দিতেন কিংবা থমাস নো বলটি না করতেন, তাহলে ম্যাচের চিত্র কি হতে পারতো? ইতিহাস তো ভিন্নভাবেও লেখা হতে পারতো সেদিন।
এত গতি কোত্থেকে আসে থমাসের বলে? খুব বেশি বিশ্লেষণেরও হয়তো প্রয়োজন নেই। একে তো তার উচ্চতা। ৬ ফুটেরও বেশি। সঙ্গে লম্বা রানআপ। গতি এমনিতেই চলে আসার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত গতিটা আসে, যখন বলটা ডেলিভারি দেন, তার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা লাফ দেন থমাস। ওই লাফের কারণেই বলের গতি বেড়ে যায়। যে কারণে বাউন্সও পেয়ে যান অনায়াসে। যে কোনো উইকেটেই তাই সমান কার্যকর থমাস। একজন বোলারের মধ্যে এতগুলোর সমন্বয়ই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে দারুণ বিপদে ফেলে দেয় এবং তার বলকে বুঝে ওঠার আগেই উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
তবে থমাস বিশ্বাস করেন, শুধু গতি দিয়েই তিনি কাঙ্খিত সাফল্য পাবেন না। এর সঙ্গে বোলিংয়ে বৈচিত্র্যও আনতে হবে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘একজন পেস বোলারের জন্য শট বল করা খুবই সহজ একটি কাজ। তবে আমি চাই আমার বাউন্সার কিংবা গতি- যেন ব্যাটসম্যানকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং সে জায়গা থেকেই আমি উইকেট পেতে পারবো।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক কার্লোস ব্র্যাথওয়েট মন্তব্য করেন, থমাস একটি দুর্দান্ত প্রতিভা এবং যে কোনো অতীতকে সে ছাড়িয়ে যেতে পারবে। তিনি বলেন, ‘আমরা তার (থমাস) সঙ্গে কথা বলেছি। জানিয়ে দিয়েছি, তার জন্য দলে জায়গা থাকবে। তার কাজ হবে নিয়মিত ফিট থেকে নিজেকে আরও উপরের দিকে তুলে নেয়া। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলই তাকে পরবর্তী মাইকেল হোল্ডিং কিংবা জোয়েল গার্নার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।’
মাইকেল হোল্ডিং এবং জোয়েল গার্নারদের মত কিংবদন্তিদের নাম এখনই উচ্চারিত হতে শুরু করেছে থমাসের নামের পাশে। তবে ইডেন গার্ডেনে যেভাবে তিনি বল হাতে আগুন ঝরিয়েছেন, তাতে গ্যালারির অনেকেই ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ম্যালকম মার্শালের সঙ্গে তাকে তুলনা করতে শুরু করেছেন। যার (মার্শাল) ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন হয়েছে কিছুদিন আগে।
মাত্রই ক্যারিয়ার শুরু করেছেন ওশান থমাস। এখনই তার নাম কিংবদন্তিদের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এভাবেই যদি ক্যারিয়ারটা এগিয়ে নিতে পারেন, প্রতিনিয়ত শিখতে পারেন এবং সেগুলো মাঠে প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে সত্যি সত্যি একদিন হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার কিংবা ম্যালকম মার্শালদের সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে ক্রিকেট বিশ্বে উচ্চারিত হবে তার নামও।
আইএইচএস/এমএস