রিয়াদের ধ্রুপদী টেস্ট শতক
সকাল হলো সব্যসাচী ক্রিকেট লিখিয়ে ও বিশেষজ্ঞ জালাল আহমেদ চৌধুরীর প্রাণের আকুতি মাখা লিখা পড়ে, ‘একটি সম্ভবের রং জড়ানো স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছি। দ্বিতীয় দিন প্রায় লেজহীন ব্যাটিং তালিকা নিয়ে দিনভর ব্যাট করতে চাই। সংগ্রহে চাই অন্তত একটি ব্যক্তিগত শতক। তারপর শুনতে চাই স্পিন সঙ্গীতের উদারা, মুদারা-তারা।’
প্রথম ঘন্টা না যেতেই দেখি জালাল ভাই প্রেস বক্সে এসে হাজির। সাকিব তখন ধন্ধুমার চালাচ্ছিলেন। মনে হলো যেন লাঞ্চের বেশ আগেই সেঞ্চুরি হয়ে যাবে। কিন্তু না। ৮০ ‘তে পা দিয়েই আউট বালাদেশ ক্যাপ্টেন।
কি ব্যাপার, সেঞ্চুরি কি আর হবে না? আগের দিন অনিক (সাদমান ইসলামের ডাক নাম) আশা জাগিয়েও পারলেন না। আজ সাকিব নিশ্চিত শতক হাতছাড়া করলেন। তবে কি শতরান দেখার আশা আশাই থেকে যাবে?
শুধু বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক, জাতীয় প্রশিক্ষক ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ জালাল আহমেদ চৌধুরীর কথা বলা কেন; নির্বাচনী ডামাডোলের মাঝেও টিভি সেটের সামনে বসা থাকা কোটি বাংলাদেশ সমর্থক উন্মুখ হয়েছিলেন টাইগারদের কারো শতরান দেখতে। অবশেষে ঠিক চা বিরতির অল্প কয়েক মিনিট আগে সমর্থক-ভক্তদের সে প্রত্যাশা পূর্ণ হলো।
অভিষেক হওয়া ওপেনার সাদমান, অধিনায়ক সাকিব আশা জাগিয়ে সমর্থকদের আশা ভঙ্গের বেদনায় ডুবিয়ে ফিরলেও শেষ পর্যন্ত শতরান করলেন সহ-অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। একদম ‘ক্ল্যাসিক টেস্ট সেঞ্চুরি’ যাকে বলে!
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বেশির ভাগ টেস্ট শতরান মানেই সময় আর আর বলের হিসেব না মেনে নিজের মত এগিয়ে চলা। আলগা ডেলিভারি মানে মারার বল ছাড়াও মারা। বলের মেধা ও গুণ দেখে বিচার না করে খেলা। ধৈর্য্য, মনোযোগ ও মনসংযোগের চেয়ে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলার চেষ্টা করা। ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে বল দেখে ও বুঝে খেলে তিন অংকে পা রাখার প্রবণতা ও নজির দুই-ই কম। তাই সনাতন বা প্রথাগত টেস্ট সেঞ্চুরির চেয়ে ফ্রি স্ট্রোক প্লে‘র অবাধ, অনুপম প্রদর্শনীই বেশি।
কিন্তু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আজকের শতরানের ইনিংসটি ব্যতিক্রম। একদম চিরায়ত টেস্ট সেঞ্চুরি। কোনোরকম তাড়াহুড়ো ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা বল করেছেন। ভালো ডেলিভারিগুলোকে সমীহ দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ। একদম ব্যাকরণ মেনে রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলা যাকে বলে, তাই করেছেন। একদম ব্যাট ও প্যাড একসাথে রেখে বলের ঠিক পিছনে শরীর ও বাঁ পা এনে ডিফেন্স করেছেন। অপেক্ষায় থেকেছেন হাফ ভলি, ওভার পিচ আর শর্ট অফলেন্থের ডেলিভারির। সপাটে চালিয়েছেন। এর বাইরে সুযোগ মত সিঙ্গেলস-ডাবল নিতে ভুল করেননি। হ্যাঁ, সেঞ্চুরি পূরনের পর রানের তাড়া দেখিয়েছেন। হাত খুলে খেলার চেষ্টা ছিল। সেটা টিম প্ল্যানের অংশ বোঝাই গেছে।
কেমন ছিল রিয়াদের আজকের শতরানের ইনিংসটি? একটি পরিসংখ্যান দেখুন। ধারণা মিলবে। শতরানের আগে পর্যন্ত ব্যাট চালনার স্টাইল, ছন্দ ও লয় পাল্টাননি। একই গতি ও ছন্দে খেলেছেন। হাফ সেঞ্চুরি করতে সময় নিয়েছেন আড়াই ঘন্টার মত (১৫৬ মিনিট)। বল খেলেছেন ৮৮ টি। যার মধ্যে স্কোরিং শট ছিল ৩৪ টি (২৫টি সিঙ্গেলস, ৫টি ডাবলস আর ৪টি চার)।
একই ভাবে পরের পঞ্চাশ করতে আরও অনেক বেশি সময় নিয়েছেন। ২১৬ মিনিটে বল খেলেছেন ১১৫ টি। এর মধ্যে ৩০টি সিঙ্গেলস নিয়েছেন। সাথে ৫টি ডাবলস ছিল। একটি তিন এবং দুটি বাউন্ডারি। মোট ৩৮টি স্কোরিং শট।
নব্বই থেকে একশ পর্যন্ত পৌঁছতে মাহমুদউল্লাহ অপেক্ষা করেছেন ৪০টি বল। ১৬৩ বলে পা রাখেন নব্বইতে। আর ঠিক ২০৩ বলে পূর্ণ হয় তার সেঞ্চুরি। এই ধৈর্য্যটাই তার ইনিংসটাকে মহিমান্বিত করেছে।
একবারের জন্য ছটফট করেননি। ব্যাটিং দেখে বোঝাই যায়নি রানের তাড়া আছে । আসলে তার দরকারও ছিল না। কারণ, এমনিতে শেরে বাংলার পিচের অনেক বদনাম। হোম অফ ক্রিকেটের উইকেটের গায়ে ‘আনপ্রিডিক্টেবল’, ‘রহস্যময়’ আর ‘দূর্বোধ্য’ তকমা। কিন্তু এই টেস্ট যে পিচে হচ্ছে, তা মোটেই জটিল নয়। ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ না হলেও স্লো লো ট্র্যাক। ‘ইয়া বড় বড় টার্ন’, বিপজ্জনক বাউন্স, হঠাৎ নিচে নেমে যাওয়া-এসব কিছুই নেই।
এ পিচে ধৈর্য্য ধরে টিকে থাকাই বড় ইনিংস খেলার পূর্বশর্ত। মাহমুদউল্লাহ সে সত্য উপলব্ধিটা করেছেন একদম ঠিকমত। সেই পিচের চরিত্র পুরোপুরি জেনে-বুঝে, ধৈর্য্য ধরে উইকেটে টিকে থাকার চেষ্টা এবং কোনরকম ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা মনগড়া উচ্চভিলাষি শট খেলার চেষ্টা না করার পুরস্কার আজকের এ নান্দনিক টেস্ট শতক।
এই সঠিক ও সময়োচিত বোধ-উপলব্ধি ও শুদ্ধ টেস্ট ব্যাটিং শৈলিই মাহমুদউল্লাহকে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় শতরানের মুখ দেখালো। যেখানে ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে প্রথম শতকের পর দ্বিতীয় শতক পেতে আট বছরের অপেক্ষা, সেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতরানের মাঝে মাত্র ১৬ দিনের বিরতি ।
এই তো, গত ১৬ নভেম্বর এই মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে হার না মানা সেঞ্চুরি (১২২ বলে ১০১ *, চার বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায়)। সে ম্যাচে রানের তাড়া ছিল, তাই হাত খুলে খেলেছেন। আর এ ম্যাচে অমন রানের তাড়া ছিল না। সাদমান ও সাকিবের সাজানো ও এগিয়ে দেয়া পথে দেখে হাঁটলে নিজের পাশাপাশি দলকেও সামনে এগিয়ে নেয়া যাবে- এ বোধ ও উপলব্ধি থেকেই ধীরেসুস্থে খেলে ৩৭৬ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে ২৪২ বলে করেন ১৩৬ রান।
এ দুটি টেস্ট ইনিংস মাহমুদউল্লাহকে নতুন ভাবে চিনিয়ে দিল। মাঝে তার টেস্ট দলে থাকা নিয়েই জেগেছিল প্রশ্ন। কিন্তু ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ টেস্ট আর এ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে দু দুটি সেঞ্চুরির পর অতি বড় সমালোচকও কিছু বলতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, আজ রিয়াদ যা খেলেছেন, সেটাই সত্যিকার ও যথার্থ টেস্ট ব্যাটিং। ধৈর্য্য, সংযম, মনোযোগ-মনসংযোগ আর ব্যাকরণ মানা ‘চিরায়ত ধ্রুপদী’ টেস্ট ব্যাটিং।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম