এবার তাইজুল-মিরাজের দিকেই তাকিয়ে পুরো দেশ
দিন শেষে বাংলাদেশের ভক্ত ও সমর্থকদের অনুভুতি মিশ্র। কেউ কেউ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রান খরায় ভোগা এবং নিজেকে খুঁজে না পাওয়া রিয়াদ ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে একদম প্রয়োজনীয় সময়ে জ্বলে উঠে আসলে ‘এক ঢিলে দুই পাখি শিকার’ করেছেন। নড়বড়ে হয়ে পড়া টেস্ট ক্যারিয়ারে আবার স্থিতি এনে দিয়েছে। সেই সাথে দলকেও জয়ের পথে খানিকদুর এগিয়েও দিয়েছেন তিনি।
আবার অন্যমতও আছে। অন্যপক্ষর বক্তব্য হচ্ছে, ‘মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কি একটু দেরিতে ইনিংস ঘোষণা করলেন?’ জিম্বাবুয়েকে ৪৪৩ রানের টার্গেট দেয়ার দরকার কি ছিল? ৩৮০ থেকে ৪০০ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেই তো হতো।
যে দল বাংলাদেশে এবারের আগের তিন ইনিংসে ৩০৩ রানের বেশি (এ টেস্টের প্রথম ইনিংস) করতে পারেনি, সেই দল চতুর্থ দিন শেষ দুই সেশন আর শেষ দিন তিন সেশনে ৪০০ রান করে ফেলবে? এমন ভাবা একটু রক্ষণাত্মক ও খানিক নেতিবাচক হয়ে গেল না?
নাকি রান খরায় ভোগা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ নিজের সেঞ্চুরির জন্য একটু বেশি সময় খেলে তারপর ইনিংস ঘোষণা করলেন? ওই ঘোষণাটা আরও অন্তত ঘণ্টা খানেক না হোক, ১০ ওভার আগে আসলে কি এমন ক্ষতি হতো? তাতে শেষ বিকেলে জিম্বাবুয়ের আরও ১টি/২টি উইকেট বেশি পড়তে পারতো। তাতে হয়তো রিয়াদের টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় আর দেশের মাটিতে প্রথম শতকটি হতো না, তাতে কিইবা এমন আসতো-যেত?
বরং জিম্বাবুয়েকে আরও বেশি সময় ধরে ব্যাট করতে হতো। তাদের আজ আরও একটি বা দুটি উইকেট হারানোর সম্ভাবনাও থাকতো। দিন শেষে এমন আলোচনা-পর্যালোচনা তুঙ্গে।
আসলে টেস্ট ক্রিকেটও জীবনের মতই। ক্ষণে ক্ষণে না হোক সেশনে সেশনে এর রূপ ও রং বদলায়। কাল পড়ন্ত বিকেলে একদম চালকের আসনে বসা বাংলাদেশ আজ সকালে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে হঠাৎই অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলো। ২১৮ রানে এগিয়ে থাকা দলটি জিম্বাবুয়েকে ফলোঅনে না পাঠিয়ে নিজেরা আবার ব্যাট করতে নামে।
তাতে একটা বড়সড় স্কোরের টার্গেট ছুড়ে দিতে গিয়ে উল্টো ২৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল টাইগাররা। এমন অবস্থায় দরকার ছিল শক্ত হাতে হাল ধরা। অধিনায়ক রিয়াদ সেই অতি দরকারী কাজটিই করে দিয়েছেন। মোহাম্মদ মিঠুনকে সাথে নিয়ে পঞ্চম উইকেটে ১১৮ রানের জুটি গড়ে বিপর্যয় কাটিয়ে দিয়েছেন টাইগার অধিনায়ক।
মিঠুন ৬৭ রানে ফিরে গেলেও মিরাজকে সাথে নিয়ে সপ্তম উইকেটে রিয়াদ ৭৩ রানের আরও একটি অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়লে আবারও অবস্থা পাল্টে যায়। একদম নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। রিয়াদও আট বছর পর টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় এবং দেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলেন।
দলের প্রয়োজনে রিয়াদের ১২২ বলে চার বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায় সাজানো ১০৪ রানের ইনিংসটি অবশ্যই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রতীক। রিয়াদ এমন কার্যকর তথা সময়োচিত পারফরমেন্সের জন্য টিমমেট, সমর্থক ও ভক্তদের প্রশংসাধন্যও হয়েছেন।
তারপরও কথা থেকে যাচ্ছ। কেউ কেউ রিয়াদের ইনিংস ঘোষণাকে বিলম্বিত ঘোষণা বলেও অভিহিত করেছেন। তারা প্রায় তিন যুগ আগের ঘটনার উপমা টানছেন।
ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৯৮৩ সালের ১৪-১৯ জানুয়ারি হায়দ্রাবাদে ভারতের বিপক্ষে এক অন্যরকম ইনিংসের ঘোষণা দিয়ে আলোচিত-আলোড়িত হয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান।
ইমরান যখন ডিক্লেয়ার করেন তখন পাকিস্তানের ব্যাটিং গ্রেট জাভেদ মিয়াঁদাদ ২৮০ রানে ছিলেন নট আউট। অনিশ্চয়তার ভরা ক্রিকেটে নিশ্চিত বলে কিছু নেই। ওই ম্যাচে জাভেদ যে ট্রিপল সেঞ্চুরি করতেনই তা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে ম্যাচের যা চালচিত্র ছিল, তাতে ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না।
কারণ জাভেদ মিয়াদাদ আর মুদাসসর নজর তৃতীয় উইকেটে ৪৫১ রানের জুটি গড়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। যাতে মুদাসসর নজরও রেখেছিলেন বড় অবদান। তার সংগ্রহ ছিল ২৩১ রান। হাতে পর্যাপ্ত সময়ও ছিল। জাভেদ হয়ত অনায়াসে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারতেন; কিন্তু পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান ঠিক তৃতীয় দিন মধ্যাহ্ন বিরতির আশপাশে ইনিংস ঘোষণা করে বসেন। যদিও সে ঘোষণা বৃথা যায়নি।
প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেটে তোলা ৫৮১ রানে ইমরানের ইনিংস ঘোষণার পর ভারত প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়ে যায় ১৮৯ রানে। ইমরান একাই পতন ঘটান ৬ উইকেটের। ভারতীয়দের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয় ২৭৩ রানে। পাকিস্তান পায় ইনিংস ও ১১ রানের বিরাট এবং স্মরণীয় এক জয়। তবে জাভেদ মিয়াঁদাদের টেস্ট ক্যারিয়ারে আর ট্রিপল সেঞ্চুরি করা হয়নি।
১২৪ টেস্টে ৮৮৩২ রান করা জাভেদ ২৩বার তিন অংকে পা রাখলেও আর কখনো ২৮০ রান করতে পারেননি; কিন্তু ওই ম্যাচ জেতা ইমরান খানের ইনিংস ঘোষণাটি এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে পরিগনিত হয়। টেস্টে এখনো সেই ইনিংস ঘোষণাকে বিভিন্ন সময় উপমা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
জিম্বাবুইয়ানরা যদি শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচ ড্র করে ফেলেন, তাহলে কিন্তু অধিনায়ক রিয়াদের বিলম্বিত ইনিংস ঘোষণা এবং শতরান সমালোচনার খোরাক হবে। কারণ চার সেশনের একট শেষ। উইকেট পড়েছে দুটি। কাল শেষ দিন তিন সেশনে পতন ঘটাতে হবে আরও আট উইকেটের।
এখন অধিনায়ক রিয়াদের পাশাপাশি পুরো বাংলাদেশ তাকিয়ে দুই স্পিনার তাইজুল ও মিরাজের দিকে। দুই পেসার মোস্তাফিজ ও খালেদ আজ চতুর্থ দিন শেষেও ছিলেন উইকেটশূন্য।
আজ শেষ সেশনে যে দুটি উইকেট পড়েছে, তাইজুল ও মিরাজ তা ভাগ করে নিয়েছেন। জিম্বাবুইয়ান ক্যাপ্টেন মাসাকাদজা ফিরে গেছেন অফ স্পিনার মিরাজের বলে স্লিপে মুমিনুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে। আরেক ওপেনার ব্রায়ান চারির ৪৩ রানের সাহসী ইনিংসটি শেষ হয় বাঁ-হাতি স্পিনার তাইজুলের টার্নে। লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার আগে অবশ্য ১ রানেই সাজঘরে ফিরতে পারতেন; কিন্তু তাইজুলের করা ইনিংসে দ্বিতীয় ওভারে চারির ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে প্রথম স্লিপে যাওয়া ক্যাচ ফেলে দেন মেহেদি মিরাজ। এরপর মিরাজের হাত ফষ্কে আরও একটি ক্যাচ বেরিয়ে যায়। সেটা পেসার খালেদের বলে; কিন্তু দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো মিরাজ মাসাদকাদজার ( ৫ রানে) ক্যাচ ফেলে দেন।
পরে অবশ্য তা পুষিয়েও দিয়েছেন মিরাজ। তার বলেই আউট হয়েছেন জিম্বাবুইয়ান অধিনায়ক। বৃহস্পতিবার শেষ দিনে জিম্বাবুয়েকে করতে হবে আরও ৩৬৭ রান। হাতে ৮ উইকেট।
বাংলাদেশের মাটিতে কোন দলের চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটি অস্ট্রেলিয়ার। ২০০৬ সালে ফতুল্লায় ৩০৭ রান তাড়া করে জিতেছিল তারা। শেষ দিনে ৯০ ওভারে (ওভার পিছু চার রানের বেশি) প্রায় পৌনে চার’শো (৩৬৭) রানের টার্গেট ছুঁয়ে জেতাটা জিম্বাবুয়ের জন্যও হবে হিমালয়ের চুড়ায় ওঠার মত।
যে কোনো উইকেটে টেস্টের শেষ দিন ৩৬৭ রান যে অনেক! তাই বাংলাদেশের পরাজয়ের চিন্তায় ডোবার কোনই কারণ নেই। শেষ দিন উইকেট স্পিনারদের সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করলে তো কথাই নেই। তখন তাইজুল আর মিরাজের বল সাপের মত ঘুরবে। জিম্বাবুইয়ান মিডল ও লেট অর্ডার ব্যাটিংয়ের পক্ষে সেই স্পিন ভেলকি সামলে ম্যাচ বাঁচানো হবে আরও কঠিন।
তবে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা যেভাবে মুড়ি মুড়কির মত ক্যাচ ফেলছেন (প্রথম ইনিংসে ছয়টি, দ্বিতীয় ইনিংসে এরই মধ্যে দুটি) তা খানিক চিন্তার বিষয় বৈকি। ফিল্ডাররা ক্যাচ ফেলে দেয়ায় এখনও নামের পাশে টেস্ট উইকেট যোগ করতে পারেননি অভিষিক্ত পেসার খালেদ। অথচ এ তরুণের বলে তিন তিনটি ক্যাচ হয়েছে হাতছাড়া।
একইভাবে কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের বলেও প্রথম ইনিংসে ক্যাচ ড্রপ হয়েছে। ফিল্ডারদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়ায় দুই পেসার চতুর্থ দিন শেষেও উইকেটশূন্য। সেখানে জিম্বাবুয়ের পেসাররা একের পর এক উইকেট পেয়েছেন।
এটা সত্য যে কাইল জারভিস, তেন্দাই চাতারা, ডোনাল্ড তিরিপানো শেরে বাংলায় গত চারদিন যথেষ্ট ভালো বল করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে যে লাইন ও লেন্থে বল ফেললে ব্যাটসম্যানের সমস্যা হয়, স্বচ্ছন্দ্যে খেলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জিম্বাবুয়ের ফাস্ট বোলাররা প্রায় সর্বক্ষণ অফ স্ট্যাম্প ও তার আশপাশে ড্রাইভিং জোনের একটু পেছনে বল করে টাইগারদের কাছ থেকেও আদায় করে নিয়েছেন সর্বাধিক সমীহ। সেই কাজটি পারেননি মোস্তাফিজ ও খালেদ। তাই বাংলাদেশের ভরসা দুই স্পিনার তাইজুল ও মিরাজ।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর