তিন রেকর্ডে সাজানো মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি যেন আলোকবর্তিকা
ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে-‘আচ্ছা, এটা কি শুধুই ডাবল সেঞ্চুুরি?’ নাকি ‘থ্রি ইন ওয়ান’? খালি চোখে আজ শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু ঐ এক ডাবল সেঞ্চুরির বাইরে আরও তিনটি অনুসঙ্গ আছে।
এক নম্বর অনুসঙ্গ : টেস্টে মুশফিকুর রহিমের এটা দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। ২০১৩ সালে গল টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০ ‘র পর আজ আবার ডাবল সেঞ্চুরি।
দুই নম্বর অনুসঙ্গ : একমাত্র উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুুরি।
তিন নম্বর অনুসঙ্গ : সহযোদ্ধা সাকিব আল হাসানের করা ২১৭ রান টপকে টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইনিংসের মালিক বনে যাওয়া।
শেরে বাংলায় সোমবার দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে ঘুরে ফিরে মুশফিকের ঐ তিন তিনটি কৃতিত্বের কথাই সবার মুখে মুখে। কিন্তু এগুলোই কি সব? মুশফিকুর রহিমের ২১৯ রানের ইনিংসটি কি শুধু ঐ তিনটি মাইলফলক আর রেকর্ডে সীমাবদ্ধ?
খালি চোখে তাই। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট, পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় মুশফিকুর রহিমের এ ইনিংসটি শুধুু রেকর্ডে মোড়ানো নয়, যার ব্যপ্তি, পরিধি ও সীমা অনেক বড়।
মুশফিকের এ ইনিংস টেস্টে বাংলাদেশের মুখ রক্ষার ইনিংস। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য প্রমাণের প্রতিক। এ ইনিংস টাইগারদের রান খরার মাঝে এক পশলা ভারী বৃষ্টি। এ ইনিংস পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে জয়ের পথে হাঁটার অনুপ্রেরনা।
ওপরের কথা গুলো এতটুকু আবেগতাড়িত সংলাপ ভাবার কোনই অবকাশ নেই। বাড়াবাড়ি বলারও উপায় নেই। ঘষা বাস্তব। এক কথায় মুশফিকুর রহিমের এক ডাবল সেঞ্চুরিতে আছে অনেকগুলো সময়োচিত ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নর জবাব।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এ বছর জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট থেকে খারাপ সময় শুরু হয়েছে। যা সিলেটে দ্বিতীয় টেস্ট পর্যন্ত বহাল ছিল। সবার জানা, এই সময়ে চার টেস্টে বাংলাদেশ শুধু হারই মানেনি, চরম রান খরায় ভুগেছে। টাইগার ব্যাটসম্যানরা রান করতেই ভুলে গিয়েছিলেন। আট ইনিংস একবারের জন্য ২০০ রান হয়নি। শুধু দলগতভাবে ব্যর্থ হওয়াই নয়, গত আট ইনিংসে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রান ছিল ৬৪।
সেই না পারা ও ব্যর্থতা জন্ম দিয়েছে কিছু প্রশ্নর। সমালোচকরা আবার নড়েচড়ে বসে বলতে শুরু করেছিলেন, ‘আরে ওয়ানডেতে ভালো দলের তকমা গায়ে আঁটলেও টেস্টে কিছুই পারে না বাংলাদেশ। এখন ঘরের মাঠে ঐ জিম্বাবুয়ের সাথেও হারে। খাবি খায়।’
সেই ‘শনির দশা’ কাটাতে আর অপবাদ ঘোচাতে দলগত পারফরম্যান্স ও বড় জয়ের আগে দরকার ছিল কিছু দুর্দান্ত ব্যক্তিগত নৈপুন্য। যার দ্যুতি ও আলোচ্ছটায় কেটে যাবে এখনকার ঘোর অন্ধকার।
আগের দিন মুমিনুল হকের ১৬১ রানের আলো ঝড়ানো ইনিংস ও মুশফিকের সংগ্রামী শতকেই সে অন্ধকারে আবার আলোর বিচ্ছুরন চোখে পড়েছে। আজ দ্বিতীয় দিন মুশফিকুর রহিমের সত্যিকার ও যথার্থ ‘টেস্ট ব্যাটিংয়ে’ বাংলাদেশ আবার আলোর পথে। একদম খাদের কিনারা থেকে উঠে মুশফিকুর রহিমের চওড়া ব্যাটে ভর করে রীতিমত রান পাহাড়ের চূড়োয়।
চালকের আসনে পুরোপুরি বসতে না পারলেও মুমিনুল হক আর মুশফিকুর রহিমের শতরানে ঢাকা টেস্টের লাগামটা আগের দিনই হাতে চলে এসেছিল টাইগারদের। আর আজ দ্বিতীয় দিন শেষে টাইগাররা এমন এক উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে শুধু জয়ের কথাই ভাবা যায়।
আশার কথা, ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলার পর মুশফিকুর রহিমও জয়ের স্বপ্নই দেখছেন। আর তাই তো খেলা শেষে ১৯ মিনিটের বেশি সময়ের প্রেস মিটে অনেক কথার ভীড়েও মুশফিকুর রহিমের মুখে এমন একটি কথা বেরিয়ে এসেছে, যার মধ্যেই পরিষ্কার ফুটে উঠেছে কি চেয়েছে আর কি করতে চাচ্ছে টাইগাররা।
‘আমরা চেয়েছি আমাদের যেন আর দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে না হয়। এই জন্য প্রথম ইনিংসটা যত বড় করা যায় সেই চেষ্টা করেছি’- এই এক সংলাপেই আছে বাংলাদেশের লক্ষ্য, পরিকল্পনা ও প্রত্যাশার কথা।
তার মানে এ ম্যাচে মুশফিকুর রহিম আর মুমিনুল হকের বড় ইনিংস, ৫০০ + স্কোর সবই এক সুতোয় গাঁথা। মানে সিলেটে ব্যর্থতার ষোলকলা পূরণের পর এ ম্যাচে যেন ‘ধনুক ভাঙ্গা’ পণ করে নেমেছিল রিয়াদের দল-আমাদের যার যা সামর্থ আছে, তার সেরাটা উপহার দিতে হবে। তবেই জয়ের সম্ভাবনা থাকবে। তাইতো ৫০০ + রান করে জয়ের নেশায় বুঁদ হওয়া।
তামিম-সাকিব ইনজুরির কারণে দলে নেই, তাই ব্যাটিংয়ের সব দায় দায়িত্ব বর্তেছে মুশফিক আর মুমিনুলের কাঁধে। যাদের আছে বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্য ও ইতিহাস। বাস্তবে তাদের দুজনার হাতেই এ ম্যাচে বাংলাদেশের সাফল্যের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে।
আগের দিন মুমিনুল তার বড় ইনিংস সাজানোর গল্প বলতে গিয়ে বার বার মুশফিকুর রহিমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বলেছিলেন , মুশফিক ভাই আমাকে গাইড করেছেন। প্রয়োজনীয় বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে বড় ইনিংস খেলতে সাহায্য করেছিলেন।
আর আজ দ্বিতীয় দিন ডাবল সেঞ্চুরির পর মুশফিকের কন্ঠে মুমিনুলের প্রশংসা। দিন শেষে বলেন, ‘ডাবল সেঞ্চুরি একা করা যায় না, বড় জুটি থাকা লাগে। শুধু আমি না, মুমিনুলও অনেক ভালো ব্যাট করেছে। মিরাজ আর রিয়াদ ভাইও ভালো খেলেছে। আমি তাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। সব মিলিয়ে ভালো লাগছে।’
সেই ভালো লাগা স্বার্থক হবে তখনই ,যখন দল জিতবে। খারাপ সময় কাটিয়ে আবার আলোয় ফিরতে ব্যাটসম্যানদের যা করে দেখানোর; মুশফিক, মুমিনুল, মিরাজরা তা করে দেখালেন। এখন বাকি কাজটা বোলারদের হাতে।
মুশফিকও তাই মনে করছেন, ‘আমাদের বোলারদের অনেক কাজ বাকি আছে। কারণ আমাদের বিশ উইকেট নিতে হবে। কাল প্রথম সেশনটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সেশনটা কাজে লাগাতে পারলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে। আমাদের আসলে প্রথম ইনিংসের রান খুব দরকার ছিল। আর উইকেটও আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছে। কাল আরও ‘উল্টা পাল্টা’ হবে।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই উল্টো পাল্টা বলতে মুশফিক বুঝিয়েছেন উইকেট ভাঙ্গবে, কোথাও কোথাও বিশেষ পপিং ক্রিজের আশ পাশে বোলারদের বুটে ক্ষত সৃষ্টি হবে, তখন স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ব্যাটিং আরও কঠিন হবে। স্পিনাররা বাাড়তি সাহায্য পাবেন। পড়ন্ত বিকেলে তাইজুলের বলই টার্ন করছিল। সামনের তিন দিনে উইকেট থেকে সাহায্য পেলে তাইজুল-মিরাজরা হয়ে উঠতে পারেন আরও ভয়ঙ্কর। আর তাতেই দুঃসময়ে আলোকবর্তিকার মত জয়ের দেখা মিলতে পারে বাংলাদেশের।
আর এই জয়টা পেলেই পূর্ণতা পাবে মুশফিক-মুুমিনুলদের ব্যক্তিগত সাফল্যগুলো। একই সাথে জবাবও দেয়া হবে সেই সব সমালোচকদের, যারা বলছিলেন-বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে পারে না। প্রমাণ হয়ে যাবে, মাঝে খাবি খেলেও আসলে টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজটা ধরে খেলতেও জানে টাইগাররা।
এআরবি/এমএমআর/আরআইপি