মুশফিকের এমন ব্যাটিংয়ের পেছনের রহস্য
নিঃসন্দেহে দলের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান তিনি, অনুশীলনেও দলের অন্য সবার চেয়ে বেশিই সময় দেন; কিন্তু চলতি বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ঠিক নিজের সামর্থ্যের পুরোটা দিতে পারছিলেন না বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীম।
বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র আট রানের জন্য সেঞ্চুরি পাননি। সুরাঙ্গা লাকমলের বোলিংয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন ৯২ রান করে। এরপর কেটে গেছে ৫টি টেস্ট ম্যাচের ৯টি ইনিংস; কিন্তু হাসছিলো না মুশফিকের ব্যাট।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ২ রান করা দিয়ে শুরু মুশফিকের রানখরায় ঢুকে যাওয়ার। মাঝের ৮ ইনিংসে তার রানগুলো ছিলো যথাক্রমে ১, ২৫, ০, ৮, ২৪, ৩১, ৩১ ও ১৩। এ সময়গুলোতে মুশফিকের ব্যাটিং অর্ডার নিয়েও কথা হয়েছে বিস্তর।
দলের সেরা ব্যাটসম্যান খেলবেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার নম্বর পজিশনে- এমনটাই আশা করেন সবাই; কিন্তু চার নম্বরে নামলে ঠিক হাসে না মুশফিকের ব্যাট। সেখানেও আছে অন্যরকম বিপত্তি। ৮০ থেকে ৯০ ওভার উইকেটকিপিং করে চার নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামাটাও আবার শারীরিক ঝক্কির কারণ। তাতে ক্লান্তি ও অবসাদের ছাপ থেকেই যায়। তারপরেও মাঝের ৯ ইনিংসের পাঁচটিতে নেমেছিলেন চার নম্বরে; কিন্তু তার কেবল একটি ইনিংসেই দুই অঙ্ক পেরিয়েছিল তার ব্যাট।
ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দ্বিতীয় টেস্ট থেকে ছয় নম্বরে খেলতে থাকেন তিনি। এতে বিস্তর সমালোচনা হলেও ব্যাট হাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন মুশফিক। চার ইনিংসের প্রতিটিতেই ভালো শুরুও পেয়েছিলেন; কিন্তু বড় করতে পারেননি। দুইবার আটকেছেন ৩১ রানে। ছিলো ভালো করার প্রতিশ্রুতি।
অবশেষে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হেসেছে মুশফিকের ব্যাট। হাঁকিয়েছেন ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রেখেছেন বড় কিছু করার। দিন শেষ করেছেন ১১১ রানে অপরাজিত থেকে।
ম্যাচের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ জানিয়েছিলেন, তিন-চার নম্বরে নামার চেয়ে পাঁচ-ছয় নম্বরে নেমে ব্যাটিং করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ্য মুশফিকের।
যে কারণে ইনিংসের নবম ওভারে মাত্র ১৬ রানের মাথায় দুই উইকেট পতনের পরেও চার নম্বরে মুশফিককে না পাঠিয়ে নামিয়ে দেয়া হয় অভিষিক্ত মোহাম্মদ মিঠুনকে। দুই ওভার পরে মিঠুন রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফিরে গেলে নিজের পছন্দের পাঁচ নম্বর পজিশনেই নামার সুযোগ পান মুশফিক।
দলের রান তখন মাত্র ২৬, নতুন বল হাতে তিন উইকেট তুলে নিয়েছেন জিম্বাবুয়ের পেসাররা। তখনো বেশ সুইং ও মুভমেন্ট পাচ্ছিলেন কাইল জার্ভিস, টেন্দাই চাতারারা। টানা ৯ ইনিংস ধরে রানখরায় ভুগতে থাকা যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য এমন পরিস্থিতি খুব একটা অনুকুল নয়। তবু মুশফিক নিজের রানে ফেরার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিলেন এ দিনটিকেই।
ইনিংসের দ্বাদশ ওভারের দ্বিতীয় বলে উইকেটে আসার পরে খেলেছেন একদম দিনের শেষ বল পর্যন্ত। মিরপুরে নিজের প্রথম এবং ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ষষ্ঠ সেঞ্চুরিতে অপরাজিত রয়েছেন ১১১ রান করে। চতুর্থ উইকেটে মুমিনুল হককে সাথে নিয়ে গড়েছেন রেকর্ড ২৬৬ রানের জুটি, দলকে নিয়ে গেছেন সুবিধাজনক অবস্থানে, পূরণ করেছেন ঘরের মাঠে টেস্ট ক্যারিয়ারের ২০০০ রান।
দল কিংবা মুশফিকের নিজের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অপরাজিত এ সেঞ্চুরির মূল্য অপরিসীম। মুশফিকের রান খরার অবসানের দিনে বাংলাদেশ দলও টানা আট ইনিংস পরে পেরিয়েছেন দুইশো রানের বাঁধা। দিন শেষে দলের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ৩০৩ রান।
২৩১ বলে ৯ চারের মারে ১১১ রানে অপরাজিত রয়েছেন মুশফিক, স্ট্রাইকরেট পঞ্চাশেরও নিচে (৪৮.০৫) । মুশফিকের অন্যান্য যেকোনো ইনিংসের তুলনায় এ ইনিংসে সৌন্দর্য, শৌকর্য্য ও দ্যুতি ছিলো কম। উইকেটে গিয়ে সেট হতে সময় নিয়েছেন খানিক। থিতু হওয়ার পরেও মাতেননি স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে। খেলেছেন রয়ে-সয়ে, গাইড করেছেন অপর প্রান্তে থাকা মুমিনুল হককে।
এ ইনিংসে সৌন্দর্য্য তুলনামূলক কম থাকলেও, স্পষ্টত ছিলো রান করার তীব্র ইচ্ছা, আকাঙক্ষা এবং দলকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার তাড়না। যে কারণে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে খেলেননি কোনো বড় শট, রান করেছেন সিঙ্গেল-ডাবলসে নির্ভর করেই। ২৩১ বলের ইনিংসে বল সীমানা ছাড়া করেছেন মাত্র ৯ বার, বাউন্ডারি থেকে এসেছে কেবল ৩৬ রান।
অনুশীলনে দলের সবচেয়ে বেশি সময় দেয়া তথা পরিশ্রমের মাত্রা অন্য সবার চেয়ে বেশি দেয়ার ফলটাও এই ইনিংসে পেয়েছেন মুশফিক। জার্ভিস-চাতারাদের পেস কিংবা সিকান্দার রাজা-ব্রেন্ডন মাভুতাদের আঁটোসাঁট বোলিংয়ের বিপক্ষে খেলেছেন ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের সাথে।
তার ইনিংসে বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে যে টানা ১০-১২ বল ধরে রান করতে পারছিলেন না। কিন্তু ধৈর্য্য হারাননি একবারও। কেননা তিনি অপেক্ষায় ছিলেন বড় কিছু করার, নেমেছিলেন দলকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে।
আর একারণেই মাভুতার করা ইনিংসের ৭৫তম ওভারের প্রথম বলে, নিজের মুখোমুখি ১৮৭তম ডেলিভারিতে তড়িঘড়ি করে নেয়া এক রানে শতরান পূরণ হতেই উল্লাসে ফেটে পড়েন মুশফিক। দুই হাত আকাশ পানে ছড়িয়ে দিয়ে যেনো বুঝাতে চান লক্ষ্য তার আকাশছোঁয়া।
আকাশছোঁয়া লক্ষ্য মাথায় রেখে সেঞ্চুরির পরেও ধৈর্য্য হারাননি মুশফিক। ১৮৭ বলে সেঞ্চুরি পূরণ করার পরে খেলেছেন আরও ৪৪টি বল। কিন্তু রান করেছেন মাত্র ১১টি। কেননা তার লক্ষ্য ছিলো নিজের উইকেট বাঁচিয়ে রেখে সাজঘরে ফেরা, দলকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।
প্রথম দিন শেষে দুটি কাজেই সফল মুশফিক। মুমিনুল হকের সাথে জুটি গড়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন সুবিধাজনক অবস্থানে, নিজের উইকেটটাও বাঁচিয়ে রেখেছেন ১১১ রানে অপরাজিত থেকে। দ্বিতীয় দিন সকালে দলীয় সংগ্রহটা পাহাড়সম করতে মুশফিকের ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। দেখার বিষয় কোথায় গিয়ে থামেন ‘অন্যরকম’ এক সেঞ্চুরি করা মুশফিক।
এসএএস/আইএইচএস/পিআর