ক্রিকেট এমনই বাদ পড়বো আবার ফিরবো : সাইফউদ্দীন
ক্রিকেট যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালো-মন্দ খুব কাছাকাছি। অল্পসময়ের ক্যারিয়ারে এই দুই রূপের পার্থক্যটা খুব কাছ থেকে দেখলেন সাইফউদ্দীন। মূলত পেস বোলার। ডেথওভারে মাপা বোলিংটাও নাকি ভালোই জানা। সাথে নিচের দিকে ব্যাটিংটাও করেন। পারেনও মোটামুটি সে অর্থে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই গত বছরই অভিষেক ফেনীর এ যুবার।
কিন্তু ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি কোনো ফরম্যাটেই সে অর্থে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারেননি। উল্টো গত বছর শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রোটিয়া অলরাউন্ডার মিলারের হাতে বেদম মার খেয়ে ক্যারিয়ারটাই হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত।
প্রোটিয়া মিলারের হাতে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এক ওভারে পাঁচ ছক্কা হজম করা সাইফউদ্দীন সহসাই আবার জাতীয় দলে ফিরবেন- অতি বড় সাইফউদ্দীনভক্তও হয়তো তা ভাবেননি।
কিন্তু বাস্তবতা হলো সাইফউদ্দীন আবার জাতীয় দলে ফিরলেন এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে নজর কাড়লেন। ২১ অক্টোবর শেরে বাংলায় প্রথম ম্যাচে ইমরুল কায়েসের সাথে সপ্তম উইকেটে রেকর্ড ১২৭ রানের পার্টনারশিপ গড়ে দলকে ২৭০‘র ঘরে পৌঁছে দিতে রেখেছেন কার্যকর অবদান। প্রথম তিন খেলায় (সর্বোচ্চ ১৬ রানসহ) মাত্র ৩০ রান করা সাইফ ওই ম্যাচে ওয়ানডেতে প্রথম ফিফটিও হাঁকিয়ে বসেন (৫০ )।
আর আজ সেই সাইফউদ্দীন অন্য ভূমিকায়; ডেথওভারে দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং। হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে চমৎকার আউট সুইংয়ে কটবিহাইন্ড করে শুরুতে ব্রেক থ্রু উপহার দেয়া সাইফউদ্দীন ৪৫ রানে তিন উইকেট দখল করে হয়েছেন ম্যাচ সেরা।
তার বোলিংয়ে ঢাকা পড়ে গেছে দুই দলের তিন উইলোবাজ ব্রেন্ডন টেইলর (৭৫), লিটন দাস (৮৩) ও ইমরুল কায়েসের (৯০) তিন তিনটি নজরকাড়া ইনিংস।
এই যে খারাপ ও অনুজ্জ্বল পারফরমেন্সের কারণে বাদপড়া আবার ফিরে এসে নতুনভাবে জ্বলে ওঠা- কীভাবে দেখেন সাইফউদ্দীন? এমন ফেরার কথা কি কখনো ভেবেছিলেন? সাইফউদ্দীনের স্বপ্রতীভ জবাব, ‘হ্যাঁ, এমন কামব্যাক অবশ্যই ভালো লাগার। অনেক ভালো লাগছে। আসলে ক্রিকেট খেলাটা এমনই। বাইরে থাকব, আবার ফিরব। ভালো খেলব। ইনজুরির কারণে বা অফফর্মের কারণে বাইরে চলে যাব। আবার ফিরে নিজেকে মেলে ধরবো। এসব মাথায় নিয়েই খেলতে হয়।’
এই ম্যাচের পারফরমেন্সের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাইফউদ্দীন বলেন, ‘যেহেতু আমাকে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে কাউন্ট করে আমার প্রথম স্কিল অবশ্যই বোলিং। বলে উইকেট পেলে বা ইকোনমি বল করলে ভালো লাগে। পাশাপাশি ব্যাটিংটা। চেষ্টা করি দুই বিভাগেই ভালো করার।’
বোলিং নিয়ে কী ধরনের কাজ করেছেন? এমন প্রশ্নর জবাবে সাইফউদ্দীন বলেন, ‘অবশ্যই কাজ করতে হয় প্রতিদিন। কিছুটা মানসিক বিষয় নিয়ে সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। যেহেতু আগের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোয় ভালো করিনি। অনেক খরুচে ছিলাম, এগুলো নিয়ে কথা বলছি।’
শেষ পাঁচ ওভারে কোনো চার-ছক্কা হজম না করা এবং ১৯ রান দেয়া প্রসঙ্গে সাইফউদ্দীনের কথা, ‘উইকেট অনেক ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। মাথায় ছিল ২৫০ এর আগে থামাব জিম্বাবুয়ানদের। মোস্তাফিজ খুব ভালো বোলিং করেছে। পাশাপাশি আরেক দিকেই সুনিয়ন্ত্রিত বোলিং দরকার ছিল। আমি ওই কাজটাই করেছি যাতে মোস্তাাফিজকে সাপোর্ট দেয়া যায়। ওভারে ৫, ৭ রান দিতে পারি এমন লক্ষ্য ছিল।’
নতুনভাবে ফিরে এসে উইকেট পাবার পর উদযাপনটাও পাল্টে ফেলেছেন। এখন অভিনব উদযাপন সাইফউদ্দীনের। সে উদযাপনপর্ব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাইফ বলেন, ‘উদযাপন নিয়ে কিছু নাইবা বললাম। ওটা রহস্যই থাক। পরে বলব।’
ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপে বোলিংয়ে মার খাওয়ার পর এমনভাবে ফেরার রহস্য কী? প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সাইফ তার বাবার একটি উক্তি টেনে আনেন। বলেন, ‘আমি আসলে কিছু সময় সাফল্য পেতে গেলে একটু হোঁচট খাই। আমার বাবা বলতেন একটা ছেলে হাঁটা শিখতে গেলে বারবার হোঁচট খায়। তাই বলে কি তার হাঁটা বন্ধ হয়ে যায়? একইরকম আমিও মার খাব। ওখান থেকেই তো শিখব। আমি ছোটবেলা যখন অনূর্ধ-১৫, ১৭ খেলতাম। যখন মিরাজ অধিনায়ক ছিল। তখন থেকেই ডেথওভারে এক্সপেরিয়েন্স। হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম কয়েকটা ম্যাচ ওইরকমভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারিনি। কিন্তু মিরাজের সঙ্গে আমার কথা হয়, মোস্তাফিজের সঙ্গে কথা হয়। সে খুব অভিজ্ঞ বোলার। কীভাবে কী করলে সাফল্য পাওয়া যায়।’
তার দলের লিটন দাস ১৭ রানের জন্য সেঞ্চুরি করতে পারেননি। ইমরুল কায়েস আরও কাছে গিয়ে ১০ রান দূরে ফিরে এসেছেন সাজঘরে। ধারণা ছিল দুই টাইগার ওপেনারের কেউই হয়তো ম্যাচ সেরা হবেন। কিন্তু দিন শেষে ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠেছে সাইফউদ্দীনের হাতে।
সাইফ নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না এ জন্য। বোঝাই গেল আশা করেননি, ম্যাচ সেরার মনোনয়ন পাবেন। তাইতো মুখে এমন কথা, ‘আসলে চেষ্টা ছিল দলের জন্য কিছু দেব। ম্যান অব দ্য ম্যাচ ভাবনায় ছিল না। নাম (ম্যাচ সেরায়) কিছুটা অবাক হয়েছি। কিন্তু দল জিতছে এটাই খুশি।’
আজকের ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফি তাকে পঞ্চম ওভারেই বোলিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। বল করতে প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই উইকেট। আউট সুইংয়ে জিম্বাবুয়ান অধিনায়ক মাসাকাদজাকে ফিরিয়ে দেয়া।
অত আগে বোলিং করতে আসা এবং শুরুতেই ব্রেকথ্রু উপহার দেয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাইফউদ্দীন বলেন ওঠেন, ‘আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম ম্যাশ ভাই আমাকে আনুক। অবশ্যই থাঙ্কস তিনি আমাকে তখন বল করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি চাচ্ছিলাম যে কিছু একটা করে দেখাতে। কারণ আমি খুব ভালো জানি আমি খেলছি রুবেল ভাই অসুস্থ থাকার কারণে। এই জন্য ভেতরে ভালো কিছু করার বাড়তি তাড়া ছিল। আমার এমন কিছু করতে হয়ত যে পরের ম্যাচে সুযোগ পাই। যাতে সবার নজরে আসি।’
মিলারের হাতে পাঁচ ছক্কা খাওয়ার কথা মনে আছে এখনো? সাইফউদ্দীনের চোয়াল শক্ত করা জবাব, ‘মনে থাকবে যতদিন ক্রিকেট খেলব। কিন্তু সেটা মাথায় রেখে তো ক্রিকেট খেলতে পারব না।’
নিজ দলের বর্তমান অবস্থা কেমন? এ প্রশ্নর জবাবে সাইফউদ্দীন বলেন, ‘প্রতিটা সিরিজ জেতাই আনন্দের। এর পাশাপাশি সবচেয়ে ভালো লাগছে আমাদের জেতার পেছনে সবসময় সিনিয়র প্লেয়ারদের অবদান থাকে। গত দুই ম্যাচ জুনিয়ররা অবদান রাখতে পেরেছে। সুযোগ পেলে ইনশাআল্লাহ সবাই আরও ভালো করবে।’
এআরবি/বিএ