নিজ শহরে প্রথমবার ওয়ানডেতে নেই তামিম, নেই চট্টগ্রামেরও কেউ!
আরব সাগর পাড়ের মুম্বাই যদি হয় ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের খনি; দুই মাস্টার ব্যাটসম্যান সুনিল গাভাস্কার-শচীন টেন্ডুলকারের শহর। ইউনুস খান, মোহাম্মদ ইউসুফ, সেলিম মালিক ও আজহার আলী সহ পাকিস্তানের ক্রিকেটে সর্বাধিক নামী ব্যাটসম্যানের শহর যদি হয় লাহোর- তাহলে চট্টগ্রাম অতি অবশ্যই বাংলাদেশের সর্বাধিক বড় ব্যাটসম্যানের জন্ম, বেড়ে ওঠা আর ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠার শহর।
কারণ বন্দর নগরী বরাবরই ক্রিকেটের শহর, ক্রিকেটারদের শহর। চট্টগ্রামবাসীর ক্রিকেট প্রেম ভালবাসা প্রবল। ক্রিকেট চর্চাও প্রচুর। বাংলাদেশের একমাত্র শহর, যেখান থেকে থেকে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী ব্যাটসম্যান উঠে এসেছেন। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের সেরা ১০ উইলোবাজের অন্তত পাঁচজন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আকরাম খান, তামিম ইকবাল, নাফিস ইকবাল ও আফতাব আহমেদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এই চট্টগ্রাম মহানগরীতে।
এর বাইরে জাতীয় দলের সাবেক তিন ওপেনার নুরুল আবেদিন নোবেল, জাহিদ রাজ্জাক মাসুম, নাজিমউদ্দীন ও দেশের হয়ে প্রথম এশিয়া কাপ খেলা শহিদুর রহমান শহিদও এই চট্টগ্রামেরই সন্তান। বন্দর নগরীতেই তাদের ক্রিকেটের হাতে খড়ি। হোক তা টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি; ইতিহাস জানাচ্ছে চট্টগ্রামে খেলা মানেই চট্টলার সন্তানের প্রতিনিধিত্ব থাকা।
এই শহরে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ হয়, সেই তখন থেকে চট্টগ্রামের অন্তত এক বা দুজন ক্রিকেটার ছিলেন বাংলাদেশ দলে।
রাজধানী ঢাকার পর দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সুতিকাগার চট্টগ্রাম শুধু বড় বড় ব্যাটসম্যানের শহরই নয়, আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজক শহর হিসেবেও চট্টগ্রাম অনেক পুরোনো। সেই ৭০ দশকের মাঝামাঝি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি), ডেকান ব্লুজ এবং পাকিস্তানের পুরোদস্তুর টেস্ট দল খেলে গেছে এই বন্দর নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পর দেশের ক্রিকেটের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেন্যু চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম।
এই শহরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর এশিয়া কাপে বাংলাদেশ আর ভারতের ম্যাচ দিয়ে শুরু ওয়ানডে ক্রিকেটে চট্টগ্রামের ভেন্যুর অভিষেক। সেই ম্যাচে চট্টগ্রামবাসীর প্রতিনিধি ছিলেন আজকের বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নানু। ঐ ম্যাচের একাদশে ছিলেন চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা জাহিদ রাজ্জাক মাসুমও।
ভারতের বিপক্ষে ঐ ম্যাচে টিম বাংলাদেশের স্কোরই ছিল সাকুল্যে ৯৯/৮। টপ স্কোরার (২২) ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেছেন নান্নু। ১৯৯০ সালে ভারতে এশিয়া কাপে তার নেতৃত্বেই অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল।
সেই এশিয়া কাপের দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে, তারিখ ১৯৮৮ সালের ২৯ অক্টোবর; ভেন্যু এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে অভিষেক হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সফল সেনাপতি বর্তমানে বোর্ড পরিচালক আকরাম খানের। আইসিসির সহযোগী সদস্যদের শ্রেষ্ঠত্ব মাপার আসর আইসিসি ট্রফি বিজয়ের সফল অধিনায়ক এই আকরাম খান। তার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
নান্নু (১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপই শেষ), আকরাম (২০০৩ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে) উপাখ্যান শেষ হলেও দেশের ক্রিকেটে বন্দর নগরীর কর্তৃত্ব শেষ হয়নি। আকরাম খানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হবার বছর খানেকের মধ্যেই টেস্ট অভিষেক ঘটে তারই ভাই চট্রগ্রাম তথা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচতি মুখ নামী ফুটবলার ও দক্ষ সংগঠক ইকবাল খানের বড় ছেলে নাফিস ইকবালের। সেই অনুর্ধ্ব-১৭ থেকে উঠে আসেন আকরাম খানের ভাইপো নাফিস ইকবাল।
পরিপাটি ব্যাটিং শৈলির নাফিস ১১ টেস্ট আর ১৬ ওয়ানডে খেলেছেন। এক বছর পর নাফিসের সঙ্গী হন চট্টগ্রামের আরেক কৃতি ব্যাটসম্যান আফতাব আহমেদ। নাফিস ও আফতাব যুব দলের হয়ে খেলে পরে জাতীয় দলে নাম লিখান আফতাব। তাদের কয়েক বছর পর (২০০৮ সালে) অভিষেক হয় আরেক টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান নাজিমউদ্দীনের। নাজিমের ক্যারিয়ার খুব বড় হয়নি। তিনটি টেস্ট , ১১ ওয়ানডে ৭ টি টোয়েন্টি খেলেছেন নাজিম। এ তিনজনের মধ্যে আফতাব একটু বেশী সময় জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার আন্তর্জাতিক ওয়ানডে সংখ্যা ৮৫ আর টেস্ট খেলেছেন ১৬ টি। ১১ টি টি টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছেন। তামিমের আগে জাতীয় দলের ‘ড্যাশিং’ উইলোবাজের তকমাটি ছিল আফতাবের গায়ে। আফতাবের ক্যারিয়ার শেষ হবার আগেই অভিষেক হয় তামিম ইকবালের। তারপর থেকে জাতীয় দলে চট্টগ্রামের একক প্রতিনিধি বনে যান তামিম ইকবাল।
মোদ্দা কথা সেই ১৯৮৮ সালে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ দিয়ে যে চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে ওয়ানডে আয়োজন, তার পর যখনই কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়েছে বন্দর নগরীতে, তখনই চট্টগ্রামের কেউ না কেউ খেলেছেন। নান্নু, আকরাম, নোবেল, শহীদ ও মাসুমদের পথ ধরে এগিয়ে আসেন নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদ ও নাজিমউদ্দীন। এই তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের পর পরই জাতীয় দলে চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হন তামিম ইকবাল। সাফল্য, ব্যক্তিগত অর্জন ও কৃতিত্বে চাচা আকরাম খান ও বড় ভাই নাফিস ইকবালকে ছাপিয়ে তিন ফরম্যাটে দেশের সবচেয়ে সফল উইলোবাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তামিম এখন ক্রিকেট বিশ্বেই জায়গা করে নিয়েছেন।
ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে নিজ শহর চট্টগ্রামে কোন ম্যাচ মিস করেননি তামিম। ১০ বছর পর সেই নিজ শহরে এবার নেই তামিম। হাতের কব্জির ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছেন বাইরে। ইংল্যান্ডে গিয়ে চিকিৎসা শেষে এখন রিহ্যাব করছেন তামিম।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ইনজুরি এবার তামিমকে ঠেলে দিয়েছে এই সিরিজের বাইরে। এখন তামিম নেই, চট্টগ্রামের প্রতিনিধিও নেই। একাদশে বহুদূরে, স্কোয়াডেই বন্দর নগরীর কোন ক্রিকেটার নেই। সময়ের হিসেব কষলে ১০ বছর পর চট্টগ্রামে কোন ওয়ানডে হচ্ছে, যাতে চট্টগ্রামের একজন ক্রিকেটারও নেই।
ওয়ানডে অভিষেকের পর থেকে তামিম ২৩ টি ওয়ানডে মিস করেছেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সবকটা ওয়ানডে খেলেছেন। ২০১০ সালে ছিলেন না নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশের সিরিজে। তারপর আবার ২০১১-২০১২ সালেও সব ম্যাচই খেলেছেন। ২০১৩ সালে তিনটি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। ২০১৪ সালেও সাত ম্যাচ জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামা হয়নি। ঠিক তার পরের দুই বছর মানে ২০১৫-২০১৬ সালে একটি ম্যাচও বাদ যায়নি। সব ওয়ানডেই খেলেছেন। ২০১৭ সালে দুটি মাত্র ম্যাচ খেলতে পারেননি।
তবে তামিমের ক্যারিয়ারে এবছর মানে ২০১৮ সালই ইনজুরির বছর হয়ে দেখা দিয়েছে। এবছর এরই মধ্যে তামিম খেলতে পারেননি ছয়টি একদিনের ম্যাচ। তার নিজ শহর চট্টগ্রামে শেষ দুই ওয়ানডে যোগ হলে খেলতে না পারা ম্যাচের সংখ্যা দাড়াবে আটটি।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই প্রথম নিজ শহরে ওয়ানডে মিস করছেন তামিম। খান পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ অথচ সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাকে আজকের ম্যাচে মিস করবে তার নিজ শহর চট্টগ্রামও।
তামিমের বড় ভাই নাফিস ইকবালও ছোট ভাইকে অনেক মিস করছেন। যদিও বিপিএলের কারণে এখন নিজ শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকাতেই থাকতে হচ্ছে নাফিসকে। মাত্র তিনদিন পরে বিপিএলের প্লেয়ারস ড্রাফট। নাফিস ইকবাল হচ্ছেন খুলনা টাইটানসের ম্যানেজার। তাই এখন রাজধানীতে ব্যস্ত সময় কাটছে নাফিসের।
চট্টগ্রামে না থাকায় খেলা দেখা হবে না, তার ওপরে তামিমও নেই। দুইয়ে মিলে মন ভালো নেই নাফিসের, ‘আমার মতো চট্টলাবাসী মিস করবে তামিমকে। আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্য ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ। তারা হয়তো মাঠে গিয়ে খেলা দেখবে। আমার চাচা আকরাম খান ম্যানেজার হয়ে দলের সঙ্গেই আছে। তবে ছোট ভাই তামিম নেই, তা ভাবতে সত্যিই খারাপ লাগছে। কারণ তামিম জাতীয় দলে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকে, অনেক পরিশ্রমও করে। তাই সে যখন খেলতে পারে না, আমাদের সত্যিই খুব খারাপ লাগে, এবারও লাগছে।’
এআরবি/এসএএস/আরআইপি