যেভাবে খেলে জিতল ভারত
খেলা শেষে পরিষ্কার বোঝা গেছে, আসলে পুঁজিটাই কম ছিল। ঐ ২২২ রান জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলনা। অন্তত ২০/২৫ রান কম হয়েছে। খেলা শেষে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও স্বীকার করেছেন- রান ২৪০ থেকে ২৫০-এর মধ্যে হলে ভালো হতো।
খালি চোখে তা হয়নি, অস্ট্রেলিয়ান টিভি আম্পায়ার রড টাকারের ভুলে। তার ভুল ও বাজে সিদ্ধান্তে লিটন দাসের অসাধারণ ইনিংসটির অপমৃত্যু না ঘটালে হয়ত বাংলাদেশ কাঙ্খিত পুঁজি পেত।
কিন্তু তার বাইরেও কথা আছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বিশেষ করে দুই ওপেনার লিটন দাস ও মেহেদি মিরাজ ছাড়া বাকিরা পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠাউরে খেলতে পারেননি। তাদের হিসেব নিকেশটাই ছিল ভুল। প্রথম ২০ ওভারে প্রায় ৬ রান করে উঠেছে। এই চমৎকার সূচনা কাজে লাগিয়ে স্কোরবোর্ডকে কিভাবে ২৮০ + বা ৩০০‘তে নিয়ে দাঁড় করানো যায়, সে ভাবনাটাই ছিল না।
অথচ একটু ভেবে চিন্তে ব্যাট করলেই তা সম্ভব ছিল। পরের ২০ ওভারে গড়পড়তা চার-পাঁচ রান করে তুললেও ১০০ রান আসবে, তাই এখন সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলি, আলগা বল পেলে মারবো। না হয় খালি জায়গায় পুল করে এক-দুইয়ে খেলি। তাতে করে ৪০ ওভার শেষে রান ২০০ ছাড়িয়ে যাবে। হাতে উইকেট রেখে শেষ ১০ ওভার খেলতে পারলে আরও ৮০/৯০ রান রান তোলা যাবে অনায়াসে। তাহলে ৩০০ রানও হয়ে যাবে। মিডল অর্ডারে ইমরুল, মুশফিক, মিঠুন ও রিয়াদরা এমন ভেবে খেললেই স্কোরলাইন হতো লম্বা চওড়া। আরও মোটা তাজা।
কিন্তু তা আর দেখা গেল কই? ইমরুল, মুশফিক, মিঠুন আর মাহমুদল্লাহর কারো মাঝে অমন বোধ-উপলব্ধি এবং ক্রিকেটীয় চিন্তা-চেতনার লেশ মাত্র দেখা যায়নি। তা থাকলে তারা উইকেটে গিয়ে অমন তাড়াহুড়ো করতেন না। দ্রুত রান তোলার তাড়নায় ‘বিগ হিট আর যেনতেন ভাবে দৌঁড়ে রান নিতে গিয়ে তিন জন রান আউটও হতেন না।
কঠিন সত্য হলো, সেই সত্য কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে কম। অমন উদ্ভাসিত সূচনার পর মাঝ পথে অযথা বিগ হিট নেয়া এবং তাড়াহুড়ো করা যে ছিল বড় ধরনের ভুল, তাতেই ছন্দপতন, সে কারণেই সর্বনাশ; সেটাই যে প্রকারন্তরে বিপর্যয়ের সাথে আলিঙ্গনের সামিল- সে উপলব্ধিটাই যে খুব জরুরি। সে বোধ জাগ্রত হওয়া খুব জরুরি। তা না হলে ভুল ঢাকা পড়ে থাকবে। করণীয় কাজগুলো আর করা হবে না। সামনে আগানোও যাবে না।
আর একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দেই, মন দিয়ে লক্ষ্য করুন। শেষ বলে গিয়ে জিতলেও ভারতীয়দের কখনই রানের তাড়া ছিল না। তারা ধীরে সুস্থে খেলে গেছে। যে কারণে তাদের হাতে পর্যাপ্ত উইকেট ছিল। বাংলাদেশ ইনিংসে সাকুল্যে দুই অংকে পা রেখেছেন মাত্র তিনজন-লিটন দাস ( ১২১), মেহেদি হাসান মিরাজ (৩২) ও সৌম্য সরকার (৩৩)। বাংলাদেশ ইনিংসে জুটি বলতে একটি (লিটন ও মিরাজের প্রথম উইকেটে ১২১)। তারপর লিটন আর সৌম্য ষষ্ঠ উইকেটে ৩৭ রানের পার্টনারশিপ ছাড়া ২০ রানের জুটিও গড়ে ওঠেনি।
অন্যদিকে ভারতের দু অংকে পা রাখা ব্যাটসম্যান হলেন সাতজন। রোহিত শর্মা (৪৮), শিখর ধাওয়ান (১৫) , দিনেশ কার্তিক (৩৮), মহেন্দ্র সিং ধোনি (৩৩) কুলদ্বীপ যাদব (২৩), রবীন্দ্র জাদেজা ( ২৩), ভুবনেশ্বর কুমার (২১)। এবং সবাই বলের মেধা বুঝে খেলার চেষ্টা করেছেন। অযথা চটকদার, উচ্চভিলাষি এবং ঝুকিপূর্ণ ‘বিগ শট’ খেলার প্রবণতাই ছিল কম। যে কারণে বাংলাদেশের বোলারদের বিশেষ করে তিন পেসার অধিনায়ক মাশরাফি (১০ ওভারে ১/৩৫), রুবেল হোসেন (১০ ওভারে ২/২৬) ও মোস্তাফিজের (১০ ওভারে ২/৩৮) দারুণ মাপা ও সমীহ জাগানো বোলিংয়ের বিপক্ষেও ৩০-৪০ রানের কয়েকটি কার্যকর পার্টনারশিপ তৈরি হয়েছে।
প্রথম উইকেটে রোহিত-শিখর ৪.৪ ওভারে ৩৫, তৃতীয় উইকেটে রোহিত-দিনেশ কার্তিক ৩৭, চতুর্থ উইকেটে দিনেশ কার্তিক আর ধোনি ৫৪ এবং ষষ্ঠ উইকেটে কুলদ্বীপ যাদব ও রবীন্দ্র জাদেজা ৪৫ রানের জুটি গড়ে ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছেন।
মিডল ও লেট অর্ডারে পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠাউরে রয়ে সয়ে সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে আলগা বলের অপেক্ষায় থেকে ব্যাট চালনায় ভারতীয়রা অনেক বেশি ধৈর্য্য, দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলেই ৩০ ওভার পর্যন্ত সমান ৪ উইকেট হারানো ভারত দিন শেষে ৩ উইকেটের জয়ে মাঠ ছেড়েছে। আর সেখানে প্রথম উইকেটে ২০.৫ ওভার পার করা বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ইনিংসের ৯ বল আগে। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানটাও কিন্তু ম্যাচ ভাগ্য গড়ে দিতে রেখেছে বড় ভূমিকা। আমরা কি তা নিয়ে ভাবছি?
এগুলো নিয়েই ভাবা উচিত। আসলে খালি চোখের এসব ছোট খাট হিসেবই কিন্তু ক্রিকেটের সূক্ষ্ম হিসেব। আমরা ওসব সূক্ষ্ম বিষয়কে পাত্তাই দেই না। তা বাদ দিয়ে আবেগতাড়িত হই কোন একটা নির্দিষ্ট ইস্যুতে। আর সে কারণেই খুঁটিনাটি ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো অধরাই থাকে।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম