আসল লড়াই হয়েছে ভারতীয় স্পিনারদের সঙ্গে বাংলাদেশের পেসারদের!
‘আবার সেই শিরোপা না পাবার আক্ষেপ।’
‘এশিয়া কাপ অধরাই থাকলো।’
‘তীরে এসে আবার তরি ডুবলো বাংলাদেশের।’
‘হাত মেলানো দূরত্বে গিয়ে আবার জয় হলো হাতছাড়া’-নানা শিরোনাম।
যার সব কটায় আছে একটা নৈপথ্য বারতা। তাহলো, বাংলাদেশ একদম জয়ের খুব কাছে মানে দোরগোড়ায় গিয়ে হেরেছে। পরিসংখ্যানও তাই বলছে। খেলার চালচিত্রও তেমন সাক্ষীই দিচ্ছে।
পুঁজি ছিল মোটে ২২২। তা নিয়ে রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, আম্বাতি রাইডু, মহেন্দ্র সিং ধোনির গড়া শক্তিশালি ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ভিত কাপিয়ে জয়ের সম্ভাবনা জাগানো যে রীতিমত চিন্তার অতীত! কিন্তু শুক্রবার রাতে দুবাই স্টেডিয়ামে অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে ঐ মাঝারি পুঁজি নিয়েও দারুণ লড়াই করে একদম শেষ বলে গিয়ে হেরেছে মাশরাফির দল।
ফাইনালের আগে এবারের এশিয়া কাপে বাংলাদেশ যে তিন ম্যাচ জিতেছিল, তার সব কটাই আগে ব্যাট করে। যার দুটি পুঁজি ছিল গড়পড়তা আড়াইশো। তবে কালকের পুঁজি ছিল সবচেয়ে কম। তাও আসরের সবচেয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও পরিণত ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে। যে দলে আছেন রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ানের মত আক্রমণাত্মক ও বিশ্বসেরা ওপেনার।
রোহিত শর্মার কথা বলে শেষ করা যাবে না। একমাত্র উইলোবাজ, একদিনের ক্রিকেটে যার আছে তিন তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ যে দুুটি বিশ্ব আসরের নক আউট পর্বে হেরেছে তার দুুটিতেই (প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, পরের বার ২০১৭ সালের ১৫ জুন ইংল্যান্ডের বার্মিংহ্যামে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে) সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলেন।
কিন্তু কাল তিন টাইগার পেসার রুবেল, মাশরাফি ও মোস্তাফিজ মিলে রোহিত, ধাওয়ান, রাইডু আর ধোনির মত ঝানু উইলোবাজকে আটকে রেখেছিলেন। তাদের মাপা ও সমীহ জাগানো অসাধারণ বোলিংয়ের মুখে ভেস্তে যায় ভারতীয়দের স্বচ্ছন্দ-সাবলীল ব্যাটিং। সে কারণেই খেলা গড়ায় শেষ ওভারের শেষ বল পর্যন্ত ।
শেষ অবধি বাংলাদেশের বোলাররা খেলাকে আকর্ষণীয় করেছেন। ভারতের বিশ্বমানের ব্যাটিং লাইন আপে ভয় ধরিয়ে, ড্রেসিং রুমে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা জাগিয়ে এবং অগণিত ভারত সমর্থককে পরাজয়ের শঙ্কায় শঙ্কিত করে শেষ বলে গিয়ে হার মেনেছেন। বাংলাদেশের এ পরাজয়কে বীরোচিত হার বলেই পরিগণিত করা হচ্ছে।
ভক্ত ও সমর্থকদের মন খারাপ। শিরোপা না পাবার আক্ষেপ পোড়াচ্ছে। তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, টাইগাররা কি নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যটা ঠিকমত পালন করতে পেরেছেন? খেলার চালচিত্র এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং ও বোলিং কি হয়েছে? বোলিংয়ের ওপর দোষ চাপানোর তেমন কোন সুযোগ নেই। বোলাররা যা করেছেন, তা যথেষ্ট। দুবাইয়ের ব্যাটিং সহায় উইকেটে সাকিব আল হাসানের মত তুখোর স্পিনার না থাকার পরও শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করা রীতিমত কৃতিত্বের।
পুঁজি খুব কম। অযথা গতি সঞ্চার, শর্ট অফ লেন্থে বল ফেলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সাহস ও ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়া এবং অফ স্ট্যাম্পের আশপাশে শর্ট বল করে কাট, পুল খেলার বাড়তি সময় ও জায়গা দেয়া হবে ‘আত্মঘাতি’। তিন পেসার রুবেল, মাশরাফি আর মোস্তাফিজের মাঝে এ বোধ উপলব্ধিটা ছিল। অযথা গতি সঞ্চারের চেষ্টা না করে উইকেট সোজা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছেন তিন পেসার।
মিড অফ, মিড অন ওপরে নিয়ে খেলার প্রায় অর্ধেক সময় ঠিক ড্রাইভিং জোনের নিচে উইকেট সোজা বল করে রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, দিনেশ কার্তিক, আম্বাতি রাইডু, এমএস ধোনি ও রবীন্দ্র জাদেজার মত ব্যাটসম্যানকেও উইকেটে বেঁধে রেখেছিলেন মাশরাফি, রুবেল ও মোস্তাফিজ।। একজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানও তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে পারেননি। ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা শুরুতে কিছুটা সময় কিছু আক্রমনাত্মক শটস খেললেও ধীরে ধীরে তাকেও খোলস বন্দী করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা।
উইকেটের চরিত্র বুঝে অযথা শর্ট পিচ ডেলিভারি না করে এবং অফস্টাম্পের বাইরে বাড়তি জায়গা না দিয়ে ফিল্ডিং পজিশন ঠিক রেখে জায়গামত বল ফেলতে পারলে যে বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপেরও ধৈর্য্যর পরীক্ষা নেয়া যায় এবং তাদের রীতিমত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়া সম্ভব- কাল রাতে বাংলাদেশের বোলাররা; বিশেষ করে তিন পেসার তাই করে দেখিয়েছেন।
দুর্ভাগ্য, স্পিনাররা ব্যাকআপ করতে পারেননি। একমাত্র বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপুর ১০ ওভারে উঠেছে ৫৬ (এক উইকেট)। দুই অফস্পিনার মিরাজ (৪ ওভারে ২৭) ও রিয়াদও (৬ ওভারে ১/৩৩) রান গতি নিয়ন্ত্রণে ছিলেন ব্যর্থ। তারা ১০ ওভারে দিয়েছেন ৬০। অর্থাৎ তিন স্পিনার মিরাজ , রিয়াদ ও নাজমুল অপুর ২০ ওভারে ভারতীয়রা পেয়েছেন ১১৬। ওভার পিছু ৫.৮ রান দেয়ার বিপরীতে তিন স্পিনারের পকেটে জমা পড়েছে মোটে দুই উইকেট।
সেখানে তিন পেসার মাশরাফি (১০ ওভারে ১/৩৫), রুবেল (১০ ওভারে ২/২৬ ) ও মোস্তাফিজ (১০ ওভারে ২/৩৮) ৩০ ওভারে শুধু ভালো জায়গায় বল ফেলে রান গতি নিয়ন্ত্রণেই রাখেননি, উইকেটেরও পতন ঘটিয়েছেন। তিন পেসার মিলে ৯৯ রান দিয়ে ভারতীয় ইনিংসের অর্ধেকটার পতন ঘটিয়েছেন। ধাওয়ান আর কার্তিক ছাড়া রোহিত, রাইডু, ধোনি, জাদেজা ও ভুবনেশ্বর-পাঁচজনের উইকেট জমা পড়ে তিন পেসারের পকেটে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
উল্টোদিকে ভারতীয় বোলিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন চার স্পিনার ইয়ুজবেন্দ্র চাহাল (৮ ওভারে ১/৩১), কুলদ্বীপ যাদব (১০ ওভারে ৩/৪৫), কেদার যাদব (৯ ওভারে ২/৪১) ও রবীন্দ্র জাদেজা (৬ ওভারে ০/৩১)। লিটন দাসের উত্তাল উইলোবাজির তোড়ের মুখে দুই পেসার ভুবেনেশ্বর কুমার (৭ ওভারে ০/৩৩) জাসপ্রিত বুমরাহ (৮.৩ ওভারে ১/৩৯) খেই হারিয়ে ফেললেও চাহাল, কুলদ্বীপ, যাদবরা ঠিক রান গতি কমিয়ে ফেলেন।
ভারতীয় স্পিনারদের সুনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখেই ধীরে ধীরে বদলে যায় বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের চিত্র। চাহাল, যাদব, কুলদ্বীপ ও জাদেজা ৩৩ ওভারে ৪.৪৮ রান দিয়ে ৬ উইকেটের পতন ঘটিয়েই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রান চাকা স্লথ করে দেন। বাংলাদেশের স্পিনার মিরাজ, নাজমুল অপু আর রিয়াদ অমন ভূমিকা রাখতে পারলে হয়তো খেলার ফল অন্যরকম হতে পারতো।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম