যেখানে হোয়াটমোর-সিডন্স-হাথুরুর চেয়ে ব্যতিক্রম স্টিভ রোডস
ডেভ হোয়াটমোর, জেমি সিডন্স আর চন্ডিকা হাথুরুসিংহে- তিনজনের তুলনায় তার নাম-ডাক, সুনাম, সুখ্যাতি এবং পরিচিতি কম। বাংলাদেশের কোচ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে অর্থে তাকে কেউ চিনতেন না। ঠিক ‘লো প্রোফাইল’ বলা না গেলেও, বাস্তব সত্য হলো টাইগারদের নতুন কোচ স্টিভ রোডস আগে তিন প্রশিক্ষকের মতো হাই প্রোফাইল কোচ নন।
তা না হওয়াটা যে খুব দোষের, তাতে যে ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয়ে যাবে তাও নয়। সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের আগের তিন কোচের মধ্যে ডেভ হোয়াটমোর আর জেমি সিডন্সের পরিচিতি ও নাম-ডাক ছিল আগে থেকেই। ১৯৯৬’র বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কার কোচ ডেভ হোয়াটমোরকে সবাই এক নামেই চিনতো। জেমি সিডন্সর নাম ডাকও ছিল মোটামুটি।
সে তুলনায় কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহের তেমন পরিচিতি ছিল না। তাকেও লো প্রোফাইল কোচই ভাবা হয়েছে। বাংলাদেশের কোচ হবার পরই তাকে সবাই চিনেছে, জেনেছে। টাইগারদের কোচিং করিয়েই আজ বিশ্বজোড়া পরিচিতি খ্যাতি মিলেছে এ লঙ্কান কোচের।
স্টিভ রোডসও অনেকটা তেমন। তাকে হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষ চেনে। এক কথায় কোচ হিসেবে তার পরিচিতিও বেশ কম। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটেই যা কোচিং করিয়েছেন। ছিলেন ওস্টারশায়ারের কোচ।
স্টিভ রোডস শেষ পর্যন্ত কতদূর যাবেন, বাংলাদেশের কোচ হিসেবে হোয়াটমোর, সিডন্স ও হাথুরুসিংহের মতো সফল হবেন কি-না? তার অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের উন্নতি হবে কি না, টাইগাররা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে আরও ওপরে উঠবে কি উঠবে না- তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটা খবর হলো, এ ইংলিশ কোচের শুরুটা অন্যরকম। ঠিক হোয়াটমোর, সিডন্স কিংবা হাথুরুর মতো নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আগের তিন কোচের কারোই শুরু ভালো হয়নি। হাথুরুসিংহে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে নাকাল হয়ে ফিরেছিলেন। মানে তার অধীনে টিম বাংলাদেশ টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি, তিন ফরম্যাটে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরেছিল।
স্টিভ রোডস কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ক’দিনের মধ্যে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। তাই বুঝি তাকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। না না, বিষয়টা মোটেই তেমন নয়।
রোডসকে অন্যরকম মনে হবার কারণ ভিন্ন। একটু পিছন ফিরে তাকালেই পরিষ্কার হবে ডেভ হোয়াটমোর, জেমি সিডন্স আর চন্ডিকা হাথুরুসিংহে- তিন কোচই শুধু সাফল্যের পিছনে ছুটেছেন। জয়ের নেশায় তারা ‘তৈরি ছেলের পিতা’ হতে চেয়েছেন। তাদের কোচিং আমলে শুধু ‘ইনফর্ম’ প্লেয়াররা অগ্রাধিকার পেয়েছেন। ঘুরে ফিরে কয়েকজন ক্রিকেটারকে দিয়েই সব ফরম্যাটে দল সাজানো হয়েছে।
যে কারণে একটি সম্ভাব্য সেটআপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ডেভ, সিডন্স ও হাথুরু মনেপ্রাণে চেয়েছেন, যেসব ক্রিকেটার প্রতিষ্ঠিত, পরিণত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থিতু হয়ে গেছে এবং ফর্মে আছে- শুধু তাদের দলে রাখতে। তাতে কোচিং করানো তুলনামূলক সহজ হতো।
কিন্তু এতে করে ফর্মের বাইরে থাকা অন্য ক্রিকেটাররা সেভাবে মূল্যায়িত হননি। একবার কেউ বাজে ফর্মের কারণে বা ইনজুরিতে পড়লে পরেরবার আর তাকে সেভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। ওই তিন কোচের লক্ষ্য ও পরিকল্পনাই ছিল, যেসব ক্রিকেটার ফর্মে আছে, যারা সবদিক থেকে তৈরি- শুধু তাদের দিয়েই দল সাজানো এবং খেলতে নামা।
কেউ একটি বা দুটি সিরিজ খারাপ খেললে তাকে বাদ দিয়ে যে ফর্মে আছে, তাকেই নেয়া হয়েছে। তাতে করে কিছু প্রতিভা অকালে ঝরে না গেলেও তাদের জাতীয় দলে ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। যেমন শাহরিয়ার নাফীস, নাঈম ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাকরা আর ফিরতে পারেননি।
কিন্তু শুরু দেখে মনে হচ্ছে স্টিভ রোডস ঠিক ওই পথে হাঁটতে চান না। তার চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন। তাই তিনি প্রথাগত পথে না হেঁটে এশিয়া কাপের আগে মাত্র দু’সপ্তাহের কিছু বেশি সময় হাতে পাবার পরও বলেছেন, আমি আরও কিছু ক্রিকেটারকে দেখতে চাই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে গড়-পড়তা তার ২০-২২ জন ক্রিকেটারকে কাছ থেকে দেখা হয়ে গেছে। তারপরও তিনি বলেছেন, এশিয়া কাপের আগে আমি ৩০ জনের ক্যাম্প করতে চাই। সেখানে আরও কিছু ক্রিকেটারকে দেখতে চাই যারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যায়নি। এই যে, বাকিদের খুঁটিয়ে দেখার চিন্তা, বিকল্প অনুন্ধানের ইচ্ছে- সেটাই রোডসের স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বলে মনে হচ্ছে।
তিনি পূর্বসুরির মতো হাতে পাওয়া তৈরি পারফরমারদের দিয়েই মাঠে নামতে নারাজ। আরও কোনো ভালো পারফরমার বা ভালো বিকল্প আছে কি-না? তা খুঁটিয়ে দেখতে আগ্রহী।
আর সে কারণেই এশিয়া কাপের ঠিক ১৮/১৯ দিন সময় আগেও ৩১ জনের প্রাথমিক ক্যাম্প। এ রকম অবস্থায় সারাজীবন বড়জোর গড় পড়তা ২০/২২ জনকে নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হতো।
এই যে ভিন্ন পথে হাঁটার প্রবণতা, যারা বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছে, তাদের সাথে আরও কেউ আছে কি-না? তাদের মান যাচাই, কাছ থেকে পরখ করার এই ইচ্ছেটাই দেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গল। এতে করে একসময় ছিলেন অথচ বর্তমানে মূল দলের বাইরে এবং সম্ভাবনায় তরুণদের জাতীয় দলে খেলার ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।
একই সঙ্গে জাতীয় দলে থাকা ক্রিকেটাররে মধ্যে ভালো করার তাগিদ বাড়বে। সচেতনতা বাড়বে। ভালো করার ইচ্ছে-প্রবণতা বাড়বে। আগের মতো কেউ আর নিজের অবস্থান নিশ্চিত ভাবতে পারবেন না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মাঝে ঘুরে-ফিরে সেই ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, এনামুল বিজয় ও সাব্বিররাই দলে ছিলেন। এবার তাদের সাথে মুমিনুল এবং ‘এ’ দলের হয়ে আয়ারল্যান্ডে ভালো খেলা তরুণ পেসার খালেদ, শরিফুল এবং ব্যাটসম্যান ফজলে মাহমুদকে ক্যাম্পে ডাকা হয়েছে। তার মানে, তারা দেশের বাইরে অনভ্যস্ত কন্ডিশনে আইরিশদের সাথে ভালো খেলার পুরস্কার পেয়েছেন।
এভাবে ‘এ’ দলে ভালো খেলা পারফরমারদের মূল দলে ক্যাম্পে ডাকার অর্থ তাদের উৎসাহিক করা। পাশাপাশি যারা মূল দলে থেকেও সেভাবে পারফরম করতে পারছেন না, তাদের ভালো খেলার বাড়তি তাগিদ তৈরি হওয়া।
দেখা যাক, এ ধারা আগামীতেও বজায় থাকে কি না!
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি