অবশেষে ‘টিম পারফরম্যান্সেই’ ধরা দিল ঐতিহাসিক সাফল্য
‘প্রতিদিন রোববার নয়’- অনেক পুরনো ও বহুল প্রচলিত প্রবচণটি কিন্তু ক্রিকেটেও ব্যবহৃত হয়। তবে ঘুরে-ফিরে, একটু অন্যভাবে। ভাবার্থটা এমন- সব দিন সমান নয়। প্রতিদিন সবাই ভালো খেলবেন না। সবার সবদিন ভালো যায় না।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ নির্ধারনী ম্যাচের আগে বাংলাদেশ সমর্থক-ভক্তদের মনে ও মুখে ওই প্রবচণটিই ঘুরেফিরে এসেছে। সবাই একটা কথাই বলেছেন, সব দিন তামিম রান করবেন- এমন নয়। প্রতিদিন তামিম আর সাকিবের ব্যাট কথা বলবে, তারাই ইনিংসকে মোটা তাজা করবেন, তাদের হাত ধরেই ২০ ওভার শেষে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে মজবুত অবস্থানে- এমন নয়। প্রতি খেলায় সাকিব ব্যাট ও বল হাতে নেতৃত্ব দেবেন, তার চৌকষ নৈপুণ্যেই দল জিতবে, তাও নয়। বাকিদেরও ভূমিকা আছে। অন্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। পারফর্ম করতে হবে। প্রয়োজনের সময় ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে উঠতে হবে।
এক কথায় ব্যক্তিনির্ভরতা কমিয়ে শুধু তামিম ও সাকিবের দিকে না তাকিয়ে সবাইকে কম বেশি ভাল খেলতে হবে। মোটকথা, ক্যারিবীয়দের তাদের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারাতে চাই টিম পারফরমেন্স। গড়পড়তাও কম-বেশি অবদান রাখতে পারলেই মিলবে জয়ের দেখা- এমন প্রত্যাশায় কাকডাকা ভোরে টিভির সামনে বসেছিলেন বাংলাদেশের কোটি সমর্থক।
সে আশা পূর্ণ হয়েছে। সাফল্যের জন্য যেমন টিম পারফরমেন্স প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়েছে। এদিন আর তামিম-সাকিবময় ব্যাটিং নয়। সাকিবের ম্যাচ জেতানো অলরাউন্ড পারফরমেন্সও আজ জয়ের মূল সোপান ছিল না। কম বেশি সবাই ভালো খেলার চেষ্টা করেছেন। সৌম্য সরকার আর মুশফিকুর রহীম ছাড়া সবাই কম বেশি অবদানও রেখেছেন।
আগের দিন যে তামিম (১৬৮.১৮ স্ট্রাইকরেটে ৪৪ বলে ৭৪) আর সাকিব (৩৮ বলে ৬০, ১৫৭.৮৯ স্ট্রাইকরেটে) ‘বিগ ফিফটি’ হাঁকিয়ে কার্যকর জুটি গড়ে দলের ১৭১ রানের প্রায় ৭০ ভাগের বেশি (১৩৪) রান তুলে দিয়েছিলেন, আজ তাদের কেউ তিরিশের ঘরেও যেতে পারেননি। তামিম ১৩ বলে ২১ আর অধিনায়ক সাকিব ২২ বলে ২৪ রানে সাজঘরে ফিরে গেছেন; কিন্তু তারপরও ২০ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর গিয়ে ঠেকেছে ১৮৪’তে। তা সম্ভব হতো না, যদি বাকিরা কেউ জ্বলে না উঠতেন।
পুরো সিরিজে রান না করা লিটন দাস খেলেছেন ৬১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। প্রায় দু’শো (১৯০.৬২) স্ট্রাইকরেটে সাজানো ওই ঝড়ো ইনিংসেই এলোমেলো হয়েছে ক্যারিবীয় বোলিং। আর মাঝে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৩০ প্লাস ইনিংস খেলেছেন, তাতেই এ সিরিজে সবচেয়ে লম্বা চওড়া স্কোর গড়ে উঠেছে। লিটনের ঝড়ো সূচনায় আগের দিনের মত আলো ছড়াতে না পারলেও দলকে শক্ত ভিত গড়ায় তামিমও রেখেছেন ছোট্ট কিন্তু কার্যকর ভূমিকা। প্রথম উইকেটে লিটন আর তামিম মাত্র ৪.৪ ওভারে ৬১ রানের জুটি গড়লেই বাংলাদেশ পেয়ে যায় শক্ত ভিত ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার রসদ।
একইভাবে মাহমুদউল্লাহর সাথে ৫.১ ওভারে ৪৪ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি তৈরি করেন অধিনায়ক সাকিবও। মাঝামাঝি থেকে ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দায়িত্বশীল ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের (১৬০.০০ স্ট্রাইকরেটে ২০ বলে ৩২ নটআউট) সাথে পুরোপুরি তাল মেলাতে না পারলেও তরুণ আরিফুলও (১৬ বলে ১৮*) সময়ের দাবি মেটানোর প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। তারই ফসল মাহমুদউল্লাহ আর তার (আরিফুলের) ষষ্ঠ উইকেটে ৩৮ রানের অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপ।
এই গড়পড়তা পারফরমেন্সগুলোই দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। তাতে ঢাকা পড়েছে সৌম্য সরকার (৪ বলে ৫) ও মুশফিকুর রহীমের (১৪ বলে ১২) অফ ফর্ম। সবার সন্মিলিত চেষ্টার ফসল ১৮৪ রানের লড়াকু স্কোর। যদিও বৃষ্টিতে পুরো খেলা হয়নি। তারপরও ১৭, ওভারে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধের আগেই বোলাররা জয়ের মঞ্চ প্রায় তৈরি করে ফেলেন।
সেখানে প্রথম ম্যাচের মত অধিনায়ক সাকিবই শেষ কথা নয়। প্রায় সবাই ভালো বল করার পাশাপাশি উইকেটও পেয়েছেন। বাঁ-হাতি মোস্তাফিজ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাটার মাস্টারের ৩.১ ওভারে (৩১ রানে) আউট হয়েছেন তিন ক্যারিবীয় ব্যাটিং স্তম্ভ আন্দ্রে ফ্লেচার, রভম্যান পাওয়েল ও আন্দ্রে রাসেল।
এছাড়া অধিনায়ক সাকিব নিয়েছেন মারলন স্যামুয়েলসের উইকেট। শুধু সাকিব নন, বাঁ-হাতি স্পিনার নাজমুল অপু ছাড়া যে কজন বোলিং করেছেন তারা সবাই অন্তত একটি করে উইকেট পেয়েছেন। নিজের বলে ফলোথ্রু’তে ফিল্ডিং করতে গিয়ে ব্যাটসম্যানের বুটের স্পাইকের আঘাতে হাতে ব্যাথা পেয়ে মাঠ ছাড়ার আগে মাত্র তিনটি ডেলিভারি করতে পেরেছিলেন আগের ম্যাচে তিন উইকেট পাওয়া এ বাঁ-হাতি স্পিনার।
ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং তোড় থামাতে নাজমুল অপুকে পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে বোলিংয়ে আনেন অধিনায়ক সাকিব; কিন্তু দুর্ভাগ্য অপুর। এক ওভারের তিন বল বাকি থাকতেই আহত হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়। তার ওই ওভারের বাকি তিন বল করতে এসে দ্বিতীয় বলেই উইকেট পেয়ে যান সৌম্য সরকার। বাঁ-হাতি এ জেন্টল মিডিয়ামের বলে আকাশে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন কারিবীয় ওপেনার চাডউইক ওয়ালটন।
শুধু ওই তিন বলই নয় সৌম্য বুদ্ধি খাটিয়ে ভাল জায়গায় বল ফেলে রানের গতি নিয়স্ত্রনে রাখেন। তাই অধিনায়ক সাকিব তাকে আরও দুই ওভার মানে ২.৩ ওভার বোলিং করান। তাতে রান ওঠে মাত্র ১৮। এছাড়া দুই পেসার আবু হায়দার রনি (তিন ওভারে ১/২৭) ও রুবেল হোসেনও (৪ ওভারে ১/২৮) বেশ মাপা বোলিং করেন।
তাদের সবার নিয়ন্ত্রিত ও সমীহ জাগানো বোলিংয়ের মুখেই ক্যারিবীয়রা শুরু থেকে ব্যাকফুটে। শুধু পাঁচ নম্বরে উইকেটে যাওয়া আন্দ্রে রাসেলছাড়া একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। সুঠামদেহী ও শক্ত-সামর্থ্য আন্দ্রে রাসেল শরীরের শক্তি কাজে লগিয়ে শেষ দিকে একের পর এক ছক্কা হাঁকিয়ে ও ২০০ প্লাস স্ট্রাইকরেটে ব্যাট চালিয়ে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন।
কিন্তু কাটার মাস্টারের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের মুখে আন্দ্রে রাসেলের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২২৩.৮০ স্ট্রাইকরেটে ছয় ছক্কায় ২১ বলে ৪৭ রান করা রাসেল মোস্তাফিজের লো ফুলটচকে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে পারেননি। সীমানার ফুট খানেক তা গিয়ে জমা পড়ে আরিফুলের হাতে। এরই সঙ্গে নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এ জয় হাতে গোনা ক’জন শীর্ষ তারকার ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কাঁধে ভরন করা জয় নয়। ‘টিম পারফরমেন্সের ফসল’। ফ্লোরিডায় সত্যিই নতুন ইতিহাস রচিত হলো। আয়ারল্যান্ডের মত দূর্বল ও আনকোরা দল ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এই প্রথম দু বা ততোধিক তিন ম্যাচের সিরিজ বিজয়ের কৃতিত্ব দেখালো টাইগাররা।
২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে আইরিশদের ৩-০’তে হোয়াইটওয়াশের পর আজই প্রথম তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ বিজয়ের উৎসবে মেতে উঠলো টাইগাররা। সবাই দেখলো, জানলো ও বুঝলো, ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এ ছোট ও সংক্ষিপ্ত পরিসরেও উঠে এসেছে। এবং সেটা সবার চেষ্টায়।
হাতে গোনা ক’জনার ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর ভর করে নয়। সবার সন্মিলিত প্রচেষ্টা মানে টিম পারফরমেন্সে। এই টিম পারফরমেন্সটাই যে সবাই চান!
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি