ফিনিশিংয়ের পথে যত বাধা স্নায়ুর দুর্বলতা!
সিরিজ জয়ের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে গায়নার প্রোভিডেন্সে। আগের অনেক ভুল, ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে সিরিজ পকেটে পুরে নেয়ার সহজ সুযোগ ছিল টাইগারদের। এক কথায় জয়ের সুঘ্রান নাকে এসে লাগছিল। জয়ের বন্দরটা দেখা যাচ্ছিল। একদম তার প্রায় হাত মেলানো দূরত্বে গিয়েও তা ছোয়া সম্ভব হয়নি।
শেষ মুহূর্তে ‘পানির’ মতো সহজ সমীকরণ ছিল। ৬ উইকেট হাতে, শেষ ১২ বলে ১৪ রান করতে পারলেই এক ম্যাচ আগেই সিরিজ হয়ে যেত মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহদের। কিন্তু ওই অতি সহজ কাজটিও করা সম্ভব হয়নি। শেষ ১২ বলে ১৪ রান করতে গিয়ে ১০ রানেই আটকে থাকা। তাই উল্টো ৩ রানে হেরে সিরিজে ১-১‘এ সমতা। এখন শেষ ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা।
আজ সেন্ট কিটসে তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটি এখন সিরিজ নির্ধারণী লড়াই হয়ে পড়েছে। টাইগাররা আজ সেন্ট কিটসের ওয়ার্নার পার্কে শেষ হাসি হাসতে পারবে? নাকি গায়নার প্রোভিডেন্সে হেলায় সুযোগ হারানোটাই শেষ পর্যন্ত হতাশা ও মনোঃকষ্টের কারণ হয়ে থাকবে সেটাই দেখার বিষয়।
এদিকে টেস্ট সিরিজের মতো আবারো বাংলাদেশের ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে টেস্টে যেমন ব্যাটসম্যানদের টেকনিক, স্কিল, টেম্পারমেন্ট, মেধা, মান ও সামর্থ্য নিয়ে ঢালাও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ওয়ানডে সিরিজে অমন নয়।
সীমিত ওভারের ফরম্যাটে দর্শক, ভক্ত ও সমর্থকদের একটাই প্রশ্ন, আচ্ছা বার বার তীরে গিয়ে তরী ডোবে কেন বাংলাদেশের? জয়ের খুব কাছে গিয়ে, একদম জয়ের সুবাতাস, সুঘ্রান নাকে পাবার পরও কেন তা স্পর্শ করতে পারছে না টাইগাররা? কেন ব্যাটিং ও বোলিংয়ে একদম শেষ দিকে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা?
শ্রীলঙ্কার মাটিতে তিন জাতি টি-টোয়েন্টি ট্রফি নিদাহাস ট্রফির পর গায়ানার প্রোভিডেন্সে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শেষ ওভারে গিয়ে ম্যাচ হাতছাড়া। তারও আগে ২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে এবং ২০১৬ সালে বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরে ভারতের সঙ্গে ৪ উইকেট অক্ষত থাকার পরও শেষ তিন বলে দুই রান করতে না পারার ক্ষত সারেনি এখনো। যা সমর্থকদের মনোঃকষ্টের কারণ।
এর সঙ্গে যোগ হলো গত ২৬ জুলাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৬ উইকেট হাতে থাকার পরও শেষ সাত বলে আট রান করতে না পারার বেদনা। ভক্তদের মনের ভেতরে রীতিমতো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অমন ম্যাচ হারার পর ব্যাটসম্যানদের বিশেষ করে মিডল অর্ডার ও লেট অর্ডারদের ম্যাচ ফিনিশ করার সামর্থ্যহয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।
অ্যান্টিগা ও জ্যামাইকা টেস্ট শেষে প্রশ্ন উঠেছিল টাইগার ব্যাটিং ও বোলিং সামর্থ্য নিয়ে। তামিম, লিটন, মুশফিক,সাকিব ও মাহমুদউল্লাহরা ফাস্ট ও বাউন্সি পিচে তত সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ নন। তাদের খেলতে সমস্যা হয়। সেটা কি টেকনিকে ঘাটতি কিংবা ত্রুটির কারনে?
যে পিচে বল দ্রুত আসে, স্বাভাবিকের চেয়ে বাউন্স বেশি থাকে, গড়পড়তা বুক, মুখ, কাধ ও মাথা সমান উচ্চতায় উঠে আসে, একটু সুইং বা মুভও করে- তেমন পিচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানতারা মোটেই স্বপ্রতিভ নন। সেটা কি পর্যাপ্ত টেকনিক নেই বলে? নাকি অন্য কারনে?
বোলারদের সামর্থ্যও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সবুজ কচি ঘাসের ফাস্ট বোলিং ফ্রেন্ডলি পিচে ঠিক কোন লাইন ও লেন্থে বল করলে বাড়তি সুইং হবে, প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা বেকায়দায় পড়বেন, তাদের চাপে ফেলা যাবে- তা খুব ভাল আত্মস্থ করা নেই রুবেল হোসেন, কামরুল রাব্বি ও আবু জায়েদ রাহিদের। কেন তারা অনুকুল কন্ডিশনেও সমীহ জাগাতে পারলেন না? তা নিয়েও বেশ কথা হয়েছে। আর গত ৭২ ঘণ্টা যাবৎ চলছে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা।
সঙ্গে প্রশ্ন-সিনিয়ররা আর কত কাল টানবেন? ‘পঞ্চ পান্ডবের ওপর ভর করে আর কতদিন চলবে বাংলাদেশ? তরুণরা কবে উঠে আসবেন, দায়িত্ব নিয়ে কার্যকর অবদান রেখে দল জেতাবেন ?
আর দ্বিতীয় ম্যাচ শেষে দেখা দিয়েছে আরেক নতুন প্রশ্ন। বাংলাদেশের মিডল ও লেট অর্ডার ব্যাটসম্যানরা অনেক দূর এগিয়ে একদম শেষ দিকে মানে ফিনিশিং পয়েন্টে কেন বার বার ব্যর্থ হন? তবে কি ‘ফিনিশিংই’ একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় দুর্বলতা ?
জয়ের সাজানো মঞ্চে ওঠার শেষ ধাপটুকু অতিক্রম করতেই যত সমস্যা বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের? এটা কি কোন টেকনিক্যাল প্রবলেম? নাকি কায়দা-কৌশলের কোথাও ফাঁক-ফোকর আছে তাই।
বুধবার রাতে খেলা শেষে অমন প্রশ্নর মুখোমুখি হয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তার সোজা সাপটা জবাব, ‘আমার মনে হয়না এই ক্ষেত্রে টেকনিকে ঘাটতি আছে। আসলে টেকনিক-ট্যাকটিসেরও কিছু নেই। ১২ বলে ১৩ করতে টেকনিক আর ট্যাকটিস লাগেনা। ১২ বলে ২০ রান হলে বলতাম, সেখানে টেকনিক-ট্যাকটিসের ব্যাপার স্যাপার আছে। কিন্তু ১২ বলে ১৩/১৪ রান করতে আসলে কোন কায়দা-কৌশলের প্রয়োজন নেই।’
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? মাশরাফির ব্যাখ্যা, ‘ফিনিশিংয়ে নার্ভটা ঠিক রাখা খুব জরুরি। নার্ভ ঠিক রেখে ফিনিশ করতে পারলেই চলবে।’
তার মানে একদম শেষ দিকে কায়দা-কৌশল ছাপিয়ে স্নায়ুর যুদ্ধটাই বড়। বোঝাই যাচ্ছে বার বার সেই স্নায়ুর লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন টাইগাররা। স্নায়ু দুর্বলতার কারণে একদম ফিনিশিংয়ে গিয়ে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সে কারনেই অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরেও একদম তীরে গিয়ে তরী ডুবছে বারবার। যে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ সাহসী মাঝির মতো উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে শক্ত হাতে হাল ধরে রাখছেন। সেই তারাই কঠিন সংগ্রাম আর বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের পর একদম বন্দরে ভেড়ানোর ঠিক আগে স্নায়ু স্বাভাবিক রাখতে পারছেন না। তাইতো আগের দিন মুশফিকের ৬৮ রানের সংগ্রামী ইনিংসটি এক ফুলটসে নিভে গেছে।
এখন এই স্নায়ু ঠিক রাখার মোক্ষম দাওয়াই কি? এটাতো আর কোন কৌশল বা কায়দা নয় যে হাই প্রোফাইল কোচ এসে শিখিয়ে দেবেন? তাহলে উপায়? মনোবিদ বা মনোস্তাত্ত্বিকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া যে এই রোগ ভালো করার ওষুধ নেই।
এসএএস/এমএস