অনুকূল কন্ডিশনে হয়নি, ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে হবে?
গায়ানার প্রোভিডেন্সের উইকেট যেন ছিল শেরে বাংলা, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পিচের ‘কার্বন কপি।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সারা বছর যেমন পিচে খেলে অভ্যস্ত, প্রায় ঐ ধরনের উইকেটই ছিল গায়ানায়। বাড়তি গতি, বাউন্স আর ম্যুভমেন্ট; কিছুই ছিল না। মোটা দাগে বলতে গেলে স্লো, নির্জীব উইকেট। পেসারদের বাড়তি কিছু মানে গতি সঞ্চার, বিপজ্জনকভাবে বল ওঠানো আর সুইং করার তেমন সুযোগ ছিল না। সে অর্থে পেসাররা কিছুই করতেও পারেননি। বরং স্পিনাররাই সাহায্য পেয়েছেন।
স্পিনারদের বল মাঝে মধ্যে একটু আধটু টার্নও করেছে। আর সময় গড়ানোর সাথে উইকেটের গতি কমে খানি স্লো‘ও হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় বাংলাদেশের কন্ডিশনের মতোই। যা হতে পারতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ বিজয়ের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, অমন অনুকূল পরিবেশে ক্যারিবীয়দের একদম হাতের মুঠোয় পেয়েও পর পর দুই ম্যাচে হারানো সম্ভব হয়নি।
এখন সেন্ট কিটসে গিয়ে কি আর জেসন হোল্ডারের দলের বিপক্ষে জেতা সম্ভব হবে? মাশরাফির দল কি শেষ হাসি হাসতে পারবে? নাকি এ বছরের শুরুতে ঘরের মাটিতে তিন জাতি টুর্নামেন্টের মত দৌর্দন্ড প্রতাপে শুরুর পর শেষটায় আবার হতাশাই হবে সঙ্গী?
এ প্রশ্নেরর উত্তর খুঁজতে গেলে সবার আগে বের করতে হবে সেন্ট কিটসের পিচের চরিত্র, গতি-প্রকৃতি ও ইতিহাস-পরিসংখ্যান। যা বাংলাদেশের জন্য খুব একটা আশা জাগানিয়া নয়। অন্তত প্রোভিডেন্সের মত তো নয়ই।
ইতিহাস জানাচ্ছে, সেন্ট কিটসের বাসেটেরের ওয়ার্নারপার্ক মাঠে এখন পর্যন্ত ১৭ টি ওয়ানডে হয়েছে। বাংলাদেশও এর আগে দুটি ম্যাচে অংশ নিয়েছে। প্রথমবার ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই। সাকিবের নেতৃত্বে টাইগাররা ৩ উইকেটে হারিয়েছিল উইন্ডিজ জাতীয় দলের মোড়কে খেলা ক্যারিবীয় ‘এ’ দলকে। ক্যারিবীয়দের ২৪৮ রানে অলআউট করে সাত বল আগে জয়ের বন্দরে পৌঁছে বাংলাদেশ। সাত নম্বরে নেমে ৭০ বলে হার না মানা ৫১ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এখন বাংলাদেশের ওয়ানডে স্কোয়াডটিতে আছে সেই দলের মাত্র চারজন-তামিম, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ ছিলেন ঐ ম্যাচের একাদশে।
তার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট আবার সেন্ট কিটসের বাসেটেরের ওয়ার্নারপার্ক মাঠে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে শেষ বারের মত মুখোমুখি হয় টাইগাররা। সেবার আর জয় ধরা দেয়নি। উল্টো ৯১ রানের বড় পরাজয় সঙ্গী থেকেছে মুশফিক বাহিনীর। প্রথম ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক ডোয়াইন ব্রাভো (১২৭ বলে ৮ ছক্কা ও ৭ বাউন্ডারিতে ১২৪) আর দিনেশ রামদিনের (১২১ বলে ১১ ছক্কা ও ৮ বাউন্ডারিতে ১৬৯) ঝড়ো জোড়া শতকে ৩৩৮ রানের পাহাড় সমান স্কোর করে বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ২৪৭ রানে আটকে যায় বাংলাদেশ । সে সময়ের অধিনায়ক মুশফিক (১১৩ বলে ৭২) আর তামিম (৬২ বলে ৫৫) সাধ্যমত চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল।
২০১৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এই মাঠে শেষ খেলার পর আর তিনটি মাত্র ওয়ানডে হয়েছে এখানে। সবগুলোই ২০১৬ সালের জুনে। এই মাঠে শেষ ওয়ানডে ম্যাচটি হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ জুন।
দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়ে ভরাডুবি ঘটেছিল উইন্ডিজের। হাশিম আমলার শতক (১১০) আর ডি কক (৭১ ) ও ডু প্লেসিসের (৭৩) জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে সাজানো প্রোটিয়াদের করা ৩৪৩ রানের বড় স্কোরের জবাবে ২০৪ রানে অলঅাউট হয়ে ১৩৯ রানের বিরাট ব্যবধানে হেরেছে স্বাগতিকরা। ফলটাই বড় না। লেগস্পিনার ইমরান তাহির এ ম্যাচে এক রেকর্ড গড়ে বসেন। ৪৫ রানে ৭ উইকেট শিকারি হন এ প্রোটিয়া লেগি।
তার আগে ঐ জুনেই এই মাঠে আরও দুটি ওয়ানডে হয়েছে। একটি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জিতেছিল স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান মারলন স্যামুয়েলসের দুর্দান্ত ম্যাচ জেতানো উইলোবাজিতে। চার নম্বরে নেমে ৮৮ বলে চার ছক্কা ও আট বাউন্ডারিতে ৯২ রানের দারুণ এক ইনিংস উপহার দেন স্যামুয়েলস। অস্ট্রেলিয়ার ২৬৫ রানের পিছু ধেয়ে ম্যাচের ২৭ বল আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ক্যারিবীয়রা। উসমান খাজা (৯৮), স্টিভেন স্মিথ (৭৪) জর্জ বেইলির (৫৫) তিন তিনটি হাফ সেঞ্চুরিও বিফলে যায়।
অন্যটিতে অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার। যে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ৩৬ রানে জয়ী হয়। শতরান করেন অজি ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার (১০৯) । এছাড়া ওসমান খাজা (৫৯ ) ও অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের (৫২) ব্যাটও পঞ্চাশ স্পর্শ করে। অস্ট্রেলিয়ার ২৮৮ রানের জবাবে প্রোটিয়ারা অলআউট হয় ২৫২ রানে।
তারও আগের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট কিটসের বাসেটেরের মাঠে ওয়ানডেতে সাত সাতবার তিনশোর বেশি রান হয়েছে। দশটি সেঞ্চুরিও হয়েছে। এই মাঠে ২০০৭ সালের ২৪ মার্চ আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ৩৭৭ রানের পাহাড় সমান স্কোরও আছে (ম্যাথিউ হেইডেন ১০১, রিকি পন্টিং ৯১, মাইকেল ক্লার্ক ৯২)।
আর ব্যক্তিগত সবচেয়ে বড় ইনিংসটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে (দিনেশ রামদিনের ১৬৯)। এছাড়া এই মাঠে নয় বার ব্যাটসম্যানদের ৯০‘র ঘরে পা রাখার রেকর্ডও আছে।
ইতিহাস জানাচ্ছে, এ মাঠে আগে ব্যাট করা উত্তম। হয়ে যাওয়া ১৭ ম্যাচের মধ্যে আগে ব্যাট করা দল জিতেছে ১২ বার। পাঁচ বার পরে ব্যাট করা দল হেসেছে শেষ হাসি।
এই স্টেডিয়ামে সবচেয়ে বেশি ২৬৫ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের। আবার সবচেয়ে কম ২৪১ রানকে জয়সূচক পুঁজিতে রূপান্তরিত করার রেকর্ডটিও ক্যারিবীয়দের। সেটা এই জুলাই মাসেই। তবে এখন থেকে ছয় বছর আগে, ২০১২ সালে।
সেন্ট কিটসের প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ২৮৫। আর দ্বিতীয় ইনিংসের গড় স্কোর ২০৯। যদিও গত দুই বছর আর খেলা হয়নি। তবে ইতিহাস, তথ্য-উপাত্ত জানান দিচ্ছে, প্রোভিডেন্সের চেয়ে সেন্ট কিটসের বাসেটেরের ওয়ার্নারপার্ক মাঠের বেশি ব্যাটিং বান্ধব। এখানকার মাঠ পাশের দিকে (দুইপাশে) ছোট, তাই সহজেই বাউন্ডারি হয়। ফলে রানও অনেক বেশি ওঠে। কাজেই ধরে নেয়া যায়, এ উইকেট তত স্লো হবে না। বল ব্যাটে আসবে। এবং হয়ত স্ট্রোক খেলাও প্রোভিডেন্সের চেয়ে তুলনামূলক সহজ হবে।
তার মানে জিততে হলে ব্যাটিংয়ের জোরেই জিততে হবে। ব্যাটসম্যানদের রান করতে হবে। এবং যেহেতু প্রথম ইনিংসের গড় রান ২৮০ +, আর পরে ব্যাট করা দলের গড় স্কোর ২১০‘র নীচে। তাই এখানে আগে ভাগে ব্যাট করাই উত্তম। রান তাড়ায় থাকতে পারে বাড়তি ঝুঁকি।
সেজন্য সবার আগে দরকার মাশরাফির টস জেতা। সেটাই যথেষ্ট নয়। ধরেই নেয়া যায়, উইকেট হবে ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। তাই ২৮০ কিংবা ৩০০ রানের বড় স্কোর গড়াও হবে সাফল্যের প্রথম শর্ত। দেখা যাক, ব্যাটসম্যানরা সুযোগ পেলে সে শর্ত পূরণ করতে পারেন কিনা!
আশার কথা, তামিম-সাকিব-মুশফিকরা বেশ ভালো ফর্মে আছেন। তার সঙ্গে তরুণ এনামুল হক বিজয়, সাব্বির রহমান ও মোসাদ্দেক হোসেনরা বড়দের সাথে কাঁধ মিলিয়ে পারফর্ম করতে পারলে সাফল্যের নতুন ইতিহাস রচিত হতেও পারে।
এআরবি/এমএমআর/পিআর